কাস্টমস কর্মকর্তা সেজে যেভাবে ‘ভয়ানক প্রতারণা’ করতেন তারা - দৈনিক মুক্ত আওয়াজ
My title
জাতীয়

কাস্টমস কর্মকর্তা সেজে যেভাবে ‘ভয়ানক প্রতারণা’ করতেন তারা

কাস্টমস কর্মকর্তা সেজে প্রতারণার মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া এক চক্রের ছয় সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ান (র‌্যাব)। র‌্যাবের অনুসন্ধান ও জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে এসেছে তাদের প্রতারণার ভয়ানক সব কৌশল। শুধু তা-ই নয়, প্রতারণা করার সুবিধার্থে নিজেদের মধ্যে ‘সুনির্দিষ্ট’ সাংগঠনিক কাঠামোও তৈরি করেছে ওই চক্র।

মঙ্গলবার রাত ৮টা থেকে বুধবার সকাল ৬টা পর্যন্ত র‌্যাব-৪ এর একটি দল রাজধানীর মিরপুর এলাকায় অভিযান পরিচালনা প্রতারক চক্রের ছয় সদস্যকে গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় এক বা একাধিক প্রতারণার মামলা রয়েছে। তারা কাস্টমস কর্মকর্তা সেজে নানা কৌশলে মানুষের কাছে থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিতেন।

গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা হলেন, মো. নুরুল হক (৫৭), মো. শেখ আলম (৪৩), মো. ফিরোজ আলম (৫৭), মো. মোশারফ হোসেন (৫৪), মো. মাসুদ রানা (৪৩) ও মো. রেনু মিয়া ওরফে রনি (৩৮)। গ্রেপ্তারের সময় তাদের কাছ থেকে  সহকারী কাস্টমস কমিশনারের দুটি র‌্যাঙ্ক ব্যাজ, সাদা শার্ট ছয়টি,বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ২০টি ভিজিটিং কার্ড এবং প্রতারণার কাজে ব্যবহৃত আটটি মুঠোফোন জব্দ করা হয়। র‌্যাব-৪ এর অধিনায়ক (সিও) পুলিশের অতিরিক্ত উপ-মহাপরিদর্শক চৌধুরী মুঞ্জুরুল কবির এসব তথ্য জানিয়েছেন।

প্রতারক চক্রের কৌশল সম্পর্কে চৌধুরী মুঞ্জুরুল কবির বলেন,’কাস্টমসসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরি দেওয়া ও বিভিন্ন ব্যবসার নামে প্রতারণা করে আসছে এই চক্র। তারা পাঁচ ভাগে বিভক্ত হয়ে অপরেশন চালায়। সহকারী কাস্টমস কমিশনার, কমিশনারের ভাই, শ্যালক বা ভাগ্নে পরিচয়ে বিভিন্ন লোককে কাস্টমস বিভাগে চাকরি দেওয়ার নামে অর্থ হাতিয়ে নিয়ে প্রতারণা করতো।

র‌্যাব-৪ এর এই অধিনায়ক জানান, পরিকল্পনা অনুযায়ী চুক্তিবদ্ধ চাকরি প্রার্থীকে সুবিধাজনক জায়গায় দেখা করতে বলতো প্রতারকরা। পরে সহকারী কমিশনারের র‌্যাঙ্ক-ব্যাজ লাগানো পোশাক (ইউনিফর্ম) পরে দামি ব্র্যান্ডের গাড়িতে প্রার্থীর সঙ্গে দেখা করতো। বিশ্বাস অর্জনের পর ভুক্তভোগীদের কাছে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিয়ে নিজেদের মুঠোফোন বন্ধসহ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে হাওয়া হয়ে যেত তারা।

চৌধুরী মুঞ্জুরুল কবির বলেন, প্রতারক চক্রটি ছোট-বড় ব্যবসায়ী ও কোম্পানিকে টার্গেট করতো। টার্গেট করা ব্যবসায়ী বা প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে তাদের মাঠ পর্যায়ের দালালরা যোগাযোগ করে সখ্যতা গড়ে তুলতো। একপর্যায়ে টার্গেটকৃত ব্যক্তিকে কাস্টমসের সহকারী কমিশনার ও তার ভাই-ভাগ্নে পরিচয়ে না প্রস্তাব দেওয়া হতো।

প্রতারকদের প্রস্তাবে বলা হতো, কাস্টমসের আটক করা সোনার বার-বিস্কুট, জাপানি যন্ত্রাংশ, কটন সুতা, গোল্ডেন সুতা, সোনার চেইন,ল্যাপটপ, টিভি, মুঠোফোন ও কাগজসহ বিভিন্ন পণ্য কম দামে বিক্রি করা হবে। টার্গেটকৃত ভুক্তভোগী প্রস্তাবে রাজি হলে ‘ভুয়া’ চুক্তিনামা তৈরি করে নির্ধারিত মূল্যের একটি অংশ আদায় করা হতো। পরে চুক্তির পণ্য সরবরাহ করার একটি কাল্পনিক তারিখ দিয়ে একপর্যায়ে এসে বলা হতো, চুক্তির আগে মোটা অঙ্কের টাকা পরিশোধ না করলে মালামাল সরবরাহ করা যাবে না। পরে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিয়ে সটকে পড়তো প্রতারকরা।

প্রতারক চক্রের সাংগঠনিক কাঠামো : কার কী কাজ

এই প্রতারক চক্র সম্পর্কে র‍্যাব জানায়, প্রতারক চক্রের প্রতিটি সদস্য প্রতারণাকে তাদের পেশা হিসেবে গ্রহণ করায় তাদের একটি সুনির্দিষ্ট সাংগঠনিক কাঠামো রয়েছে। প্রতারণার উদ্দেশ্যে নিজেদের পাঁচটি পর্যায়ে বিভক্ত করে কার্যক্রম পরিচালনা করতেন তারা।

১. কাস্টমস অফিসার (সহকারী কমিশনার) : কাস্টমস প্রতারণা চক্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র সহকারী কমিশনার। তিনি কাস্টমসের সহকারী কমিশনারের র‌্যাঙ্ক ও ব্যাজ সম্বলিত সাদা পোশাকের ইউনিফর্ম পরে দামি গাড়িতে মার্জিতভাবে বসে থাকেন। তিনি প্রয়োজন সাপেক্ষে টার্গেট ব্যক্তি বা ভিকটিমের সঙ্গে মতবিনিময় করেন।

২. কাস্টমস অফিসারের সহকারী (সুপারিনটেনডেন্ট) : কাস্টমস সহকারী কমিশনারের একজন সহকারী অফিসার থাকেন যিনি নিজেকে ‘সুপারিনটেনডেন্ট’ হিসেবে পরিচয় দেন। যখন টার্গেট ব্যক্তি বা ভিকটিম প্রতারক চক্রের পূর্ব নির্ধারিত উপযুক্ত ও নিরাপদ স্থানে আসেন, তখন দামি ব্রান্ডের গাড়িতে বসে থাকা কাস্টমস সহকারী কমিশনারের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। এরপর টার্গেট ব্যক্তির সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের লিখিত ভূয়া চুক্তি করান তিনি।

৩. কাস্টমস অফিস সহকারী : ব্রোকারের কাজ থেকে প্রাপ্ত তথ্যাদি যাচাই-বাছাই করার জন্য টার্গেট ব্যক্তি বা ভিকটিমের কাছে গিয়ে পরিচিত হন কাস্টমস অফিস সহকারী নিজেই। এরপর কাস্টমস কর্তৃক জব্দকৃত বিভিন্ন বৈদেশিক মালামাল স্বল্পমূল্যে কেনার লোভনীয় অফার দিয়ে  তাদের প্রলুব্ধ করেন। কাস্টমসের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য মোবাইল নম্বর দিয়ে আসেন। একইসঙ্গে টার্গেট ব্যক্তির ব্যক্তিগত মোবাইল নম্বর এনে তাদের কাস্টমসের সহকারী কমিশনারের সঙ্গে সাক্ষাতের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেন। বিশ্বস্ততা অর্জনের জন্য প্রয়োজনে টার্গেট ব্যক্তিকে বিমানবন্দর অথবা স্থলবন্দর এলাকা ঘুরিয়ে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করেন তিনি।

৪. ব্রোকার : প্রতারক চক্রটির মাঠ পর্যায়ের কর্মচারী হলেন ব্রোকার। তিনি দেশের বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে টার্গেট ব্যক্তি বা ভিকটিমকে চিহ্নিত করেন। এক্ষেত্রে বিভিন্ন ছোট-বড় ব্যবসায়ী,ভাঙ্গারী ব্যবসায়ী,বিভিন্ন কোম্পানির ডিলার,শিক্ষিত বেকার যুবক,চাকরীপ্রত্যাশীদের লক্ষ্য করে কার্যক্রম শুরু করেন।  টার্গেট ব্যক্তি বা ভিকটিমের যাবতীয় তথ্য,মোবাইল নম্বর কাস্টমস অফিসকে জানান ব্রোকার।

৫. ড্রাইভার : বিশ্বাস অর্জনের লক্ষ্যে কাস্টমসের লোগো সম্বলিত দামি ব্রান্ডের গাড়িতে এসে কাস্টমসের সহকারী কমিশনারসহ প্রতারক চক্রেরে সঙ্গে টার্গেট ব্যক্তি বা ভিকটিমের সাক্ষাতের ব্যবস্থা করেন দেন একজন ড্রাইভার। সাক্ষাতের উপযুক্ত স্থানও নির্ধারণ করেন তিনি।

Comment here