দৈনিক মুক্ত আওয়াজ ডেস্ক : বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আবদুল মোমেন সম্প্রতি তার ভারত সফর বাতিল ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল সফর স্থগিতের পর বিষয়টি নিয়ে দেশটিতে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়েছে। বাংলাদেশ এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দিয়েছে, প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও। কিন্তু তার পরও ভারতের গণমাধ্যমগুলো মনে করছে নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল (সিএবি) পাসের প্রতিক্রিয়ায়ই বাংলাদেশ এই দুই মন্ত্রীর সফর বাতিল করেছে, যা নিয়ে গত শুক্রবার এক বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে পশ্চিমবঙ্গের প্রভাবশালী গণমাধ্যম আনন্দবাজার পত্রিকা। ‘বিদেশ ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ভারত সফর আটকে বার্তা হাসিনার’ শীর্ষক প্রতিবেদনটি লিখেছেন অগ্নি রায়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, নয়াদিল্লির বিমানে ওঠার কয়েক ঘণ্টা আগে সফর বাতিল করেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আবদুল মোমেন। ভারতে ওশিয়ান সংলাপে যোগ দিতে তিন দিনের এই সফর বাতিলের কারণ হিসেবে তিনি জানিয়েছেন, বাংলাদেশে বিজয় দিবস এবং বুদ্ধিজীবী দিবস সামনেই। সেই অনুষ্ঠানগুলোয় উপস্থিত থাকতে হবে তাকে। একই সময়ে ওশিয়ান সংলাপের তারিখ পড়ায় তার আসা হচ্ছে না। একই দিন মেঘালয়ের মুখ্যমন্ত্রী কনরাড সাংমার আমন্ত্রণে শিলংয়ে যাওয়ার কথা ছিল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামালের।
রাতে তার মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, পরে ‘উপযুক্ত সময়ে’ মন্ত্রী এই সফরে যাবেন। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, যেসব অনুষ্ঠানের কারণ দেখিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সফর বাতিল করা হলো, সেগুলো বহু বছর ধরে ওই দিনেই হয়! ওশিয়ান সংলাপের দিনও স্থির হয়েছে মাসখানেক আগে। তা হলে সম্মতি দিয়েও শেষ মুহূর্তে কেন বিমানে উঠলেন না মোমেন? কূটনৈতিক সূত্রের বক্তব্য, এই সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। গত বুধবার রাতে ড. মোমেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বাসভবনে দেখা করতে গিয়েই এই নির্দেশ নিয়ে ফিরেছেন। সম্প্রতি ভারতের পার্লামেন্টে পাস হওয়া নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলটি যে ঢাকার রাজনৈতিক এবং সামাজিক পরিসরে গভীর অসন্তোষ তৈরি করেছে, তা এই সিদ্ধান্তে স্পষ্ট হয়ে গেল। মোদি সরকারকে ঢাকার এতটা কড়া বার্তা দিতে সাম্প্রতিককালে দেখা যায়নি বলে মনে করছেন কূটনীতিকরা।
অবশ্য সাংবাদিক বৈঠক করে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রবিশ কুমার বিশদভাবে বুঝিয়েছেন, কেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সফর বাতিল করা এবং সিএবি পাসের বিষয়টিকে পৃথকভাবে দেখা উচিত। ভারতীয় পার্লামেন্টের দুই কক্ষে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের বক্তৃতা উদ্ধৃত করে রবিশ তার সবিস্তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তার বক্তব্য, অমিত শাহ স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে, ভারত সরকার মনে করে সামরিক শাসন এবং খালেদা জিয়ার সময়েই বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচার হয়েছিল। এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু এবং তার কন্যা শেখ হাসিনার ভূমিকার প্রশংসাই করেছেন তিনি।
কিন্তু ঘটনার গতি থেকে স্পষ্ট যে, বাংলাদেশের অসস্তোষ গভীরে। গত বুধবার রাতে সিএবি পাস হওয়ার পর ড. মোমেন তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেছিলেন, ‘ভারতের নিজের দেশে অনেক সমস্যা রয়েছে। ওরা নিজেদের মধ্যে লড়াই করুক, তাতে আমাদের কিছু যায় আসে না। বন্ধু দেশ হিসেবে আমরা আশা করছি ভারত এমন কিছু করবে না, যাতে বন্ধুত্ব নষ্ট হয়। বাংলাদেশের মতো খুব কম দেশই রয়েছে, যেখানে এত সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রয়েছে। উনি (অমিত শাহ) আমাদের দেশে কয়েক মাস থাকলেই দেখতে পাবেন, এখানকার সম্প্রীতি নজির হতে পারে।’ বাংলাদেশ সূত্রের বক্তব্য, বিল পাসের সময় যেভাবে বারবার পাকিস্তানের সঙ্গে একই বন্ধনীতে বাংলাদেশকে রেখে সংখ্যালঘু নিপীড়নের দিকটি তুলে ধরা হয়েছে, তা শেখ হাসিনা সরকারের জন্য বিড়ম্বনার।
ঢাকা সূত্রের বক্তব্য, অমিত শাহ এ কথাও বলেছেন, একাত্তরের পরও সে দেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে। ঢাকা মনে করে, কার সময় কী ঘটেছে সেই কাদা বারবার ছোড়ায় সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়ে সার্বিকভাবে একটি বার্তা গেছে। আওয়ামী লীগের কট্টর ইসলামি অংশকে ভারতবিরোধিতার জিগির তোলায় উদ্বুদ্ধ করার পক্ষে তা যথেষ্ট। ভারতবিদ্বেষী প্রচারের ইন্ধন জোগাতে শুরু করেছে বিএনপিও।
গত অক্টোবরে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে যে কূটনৈতিক কর্মকর্তারা ভারতে এসেছিলেন, তাদের মতে আসাম ও পশ্চিমবঙ্গ থেকে মুসলিমদের ফেরত পাঠানোর আতঙ্ক তৈরি হয়েছে বাংলাদেশের জনমানসে। ঘরোয়া রাজনীতিতে তা শেখ হাসিনার পক্ষে অনুকূল নয়। আওয়ামী লীগের ইসলামপন্থি অংশ ভারতবিরোধী প্রচার শুরু করলে ভারত-বাংলাদেশ কৌশলগত ও বাণিজ্যিক আদান-প্রদান বাধার মুখে পড়তে পারে বলে তাদের আশঙ্কা। মাঝখান থেকে চীনের প্রতি নির্ভরতা বাড়বে ঢাকার।
Comment here