নিজস্ব প্রতিবেদক ; মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে দায়ের করা মামলায় অপরাধ প্রমাণ হলে সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের সাজা হতে পারে চিত্রনায়িকা পরীমনির। একই সঙ্গে পরীমনির করা হত্যা ও ধর্ষণচেষ্টা মামলায় অভিযোগ প্রমাণ হলে ব্যবসায়ী নাসির ইউ মাহমুদের সর্বোচ্চ ১০ বছরের সাজা হতে পারে। দুই মামলার ধারা, অভিযোগ, এজাহারের বর্ণনাসহ আনুসঙ্গিক সব কিছু পর্যালোচনা করেই এমন মত দিয়েছেন আইনজ্ঞরা।
রাজধানীর বনানীর বাসায় গত ৪ আগস্ট অভিযান চালিয়ে পরীমনিকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। এ সময় তার কথিত মামা ও ম্যানেজার আশরাফুল ইসলাম দীপুকেও গ্রেপ্তার করা হয়। বাসা থেকে বিদেশি মাদকদ্রব্য জব্দের কথা জানায় পুলিশের বিশেষ এ বাহিনীটি। পরে আলোচিত ওই নায়িকার বিরুদ্ধে বনানী থানায় মদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা হয়। দুই দফা রিমান্ড শেষে কারাগারে পাঠানো হয়েছে পরীমনিকে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, পরীমনির বাসা থেকে বিপুল পরিমাণ মদের পাশাপাশি মরণনেশা এলএসডি ও আইসের মতো মাদক জব্দ করা হয়। এমনকি তার মদ্যপানের যে লাইসেন্সটি পাওয়া যায়, সেটিরও মেয়াদ নেই বলে জানিয়েছিল র্যাব। মামলার তদন্ত কর্তৃপক্ষ পুলিশের অপরাধ
তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) যদিও বিষয়টি এখানো নিশ্চিত করেনি। তদন্তে যদি দেখা যায়, সত্যিই পরীমনির লাইসেন্সের মেয়াদ নেই। এ ছাড়া তার বাসায় মাদক পাওয়ার বিষয়টি প্রমাণ হলে ২০১৮ সালের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন অনুযায়ী তার সর্বোচ্চ পাঁচ বছর সাজা হতে পারে।
সূত্র জানায়, মাদকদ্রব্য আইনের মামলাগুলো জামিনযোগ্য নয়। তবে নারী-শিশু ও প্রতিবন্ধীদের জন্য জামিনের বিশেষ ব্যবস্থা রয়েছে। সে সুযোগ নিয়ে পরীমনির জামিনের জন্য তার আইনজীবীরা চেষ্টা করবেন বলে জানা গেছে। এ বিষয়ে পরীমনির আইনজীবী প্যানেলের এক সদস্য আমাদের সময়কে বলেন, ‘আমাদের হাতে এখনো মদ খাওয়ার লাইসেন্সের কপি আসেনি। আমরা সেটি পেলে প্রয়োজনী ব্যবস্থার কথা ভাবতে পারব। লাইসেন্সের মেয়াদ থাকলে এক ধরনের, আর না থাকলে অন্য ধরনের বিষয় চিন্তা করা হবে।’
পাল্টে যাচ্ছে প্রতিক্রিয়া
ঢাকাইয়া চলচ্চিত্রের হালের নায়িকা পরীমনি মাদকসহ গ্রেপ্তারের পর তার বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। সদস্যপদ স্থগিত করে শিল্পী সমিতি। তবে দিন গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে উল্টে যাচ্ছে জনমত। নাগরিক সমাজের বিশিষ্টজনেরা নায়িকার ন্যায়বিচার চেয়ে বিবৃতি দিয়েছেন। ‘জাস্টিস ফর পরীমনি’ হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ নায়িকার পক্ষে চালানো হচ্ছে প্রচার। এ ছাড়া নায়ক শাকিব খান, শিল্পী আসিফ আকবরসহ অনেকেই পরীমনির পক্ষে দাঁড়িছেন বেশ শক্তভাবেই। গত শনিবার জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে পরীমনির মুক্তি চেয়ে মানববন্ধন করেন নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা। এমনকি তাকে গ্রেপ্তারে চালানো অভিযানের প্রক্রিয়া নিয়েও তীব্র সমালোচনা করেন তারা। বক্তারা এ সময় বলেনÑ পরীমনি আসলে নির্দিষ্ট কিছু ব্যক্তির টার্গেটে পরিণত হয়েছেন।
এ বিষয়ে পরীমনির আইনজীবী অ্যাডভোকেট মজিবর রহমান আমাদের সময়কে বলেন, ‘প্রথম দিকে পরীমনির পক্ষে জনমত ছিল প্রায় শূন্যের কোঠায়। এখন বেশিরভাগ মানুষই তার পক্ষে। এটি একটি ইতিবাচক দিক।’
ধর্ষণচেষ্টা মামলায় অপরাধ প্রমাণ হলে
পরীমনি অভিযোগ করেছিলেন, ঢাকার অদূরে বিরুলিয়ায় ঢাকা বোট ক্লাবে গত ৮ জুন রাতে ব্যবসায়ী নাসির ইউ মাহমুদ ও তুহিন সিদ্দিকী অমি তাকে ধর্ষণ ও হত্যার চেষ্টা চালান। পরে ১৩ জুন তিনি নাসির, বন্ধু অমি ছাড়াও অজ্ঞাতনামা আরও চারজনের বিরুদ্ধে হত্যা ও ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগ এনে সাভার থানায় মামলা করেন। সে দিনই নাসির ও তুহিনকে আটক করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। চিত্রনায়িকা পরীমনির মামলায় তাদের গ্রেপ্তার দেখানো হয়। বর্তমানে নাসির ইউ মাহমুদ জামিনে রয়েছেন। এ ছাড়া মাদক উদ্ধারের ঘটনায় রাজধানীর বিমানবন্দর থানায় মামলা করে ডিবি পুলিশ। ইতোমধ্যে ওই মামলায় তদন্ত শেষে নাসির ইউ মাহমুদ ও অমিকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেছে ডিবি পুলিশ।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বোট ক্লাবে সেদিন রাতে সত্যিই কী ঘটেছিল, সেটি জানতে হলে পরীমনির দায়ের করা ধর্ষণচেষ্টা ও হত্যাচেষ্টার মামলাটির তদন্ত শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। কারণ সেখানকার সক্ষীরা কে কেমন সাক্ষ্য দেবেন সেটির ওপরই নির্ভর করছে অনেক কিছু। এ ছাড়া অন্যান্য প্রমাণও গুরুত্ব বহন করবে। পরীমনির আইনজীবী প্যানেলের এক সদস্য জানান, ওই মামলার সংশ্লিষ্ট আইনের সেকশন ১০ অনুযায়ী, পরীমনির সম্মতি ছাড়া তার গায়ে হাত দেওয়ার বিষয়টিও যদি শুধু প্রমাণ হয়, তা হলেও নাসির ইউ মাহমুদের সর্বোচ্চ ১০ বছরের সাজা হতে পারে।
স্মৃতিমনি থেকে পরীমনি
১৯৯২ সালের ১৫ ডিসেম্বর জন্ম শামসুন্নাহার স্মৃতি ওরফে স্মৃতিমনি ওরফে পরীমনির। গ্রামের বাড়ি পিরোজপুরের ভা-ারিয়া উপজেলার ইকড়ি ইউনিয়নের শিংখালী। মাত্র তিন বছর বয়সেই মাকে হারান এ নায়িকা। আগুনে পুড়ে মৃত্যু হয় তার মা সালমা সুলতানার। এর পর ব্যবসায়ী শত্রুতার জের ধরে হত্যার শিকার হন বাবা মনিরুল ইসলাম, যিনি ছিলেন একজন পুলিশ কনস্টেবল। বাবার মৃত্যুর পর নানার বাড়িতে থেকেই বড় হয়েছেন পরী।
দক্ষিণ সিংহখালী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বেলায়েত হোসেন জানান, তিন বছর বয়সেই মাহারা হন পরীমনি। মায়ের আদর স্নেহবঞ্চিত সে। মাতৃহারা পরীমনিকে তার নানা-নানি ও খালারা লালন-পালন করেছেন। পরীর নানি মরহুমা ফাতিমা বেগম দক্ষিণ সিংহখালী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাকালীন প্রধান শিক্ষিকা ছিলেন। তিনি আরও জানান, ছোট থেকে পরীমনি ভালো ছাত্রী ছিল। পঞ্চম শ্রেণিতে স্কুল থেকে একমাত্র সে-ই ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পায়। এখন পর্যন্ত ওই স্কুল থেকে আর কেউ বৃত্তি পায়নি। মা হারানো এতিম শিশুটিকে এলাকার সবাই অনেক আদর করত।
স্কুল শেষে স্থানীয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ডিগ্রি কলেজে ভর্তি হন পরীমনি। পড়ালেখা শেষ না করেই পাড়ি জমান ঢাকায়। এর পর রঙিন জগতে পা রাখেন। নিজেদের প্রয়োজনে তাকে ব্যবহার করেন কিছু প্রভাবশালী। সব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেই তৈরি করেন নিজের অবস্থান। তাই গ্রামের সহজ-সরল স্মৃতিমনি কীভাবে আজকের পরীমনি হয়ে উঠলেন? এর পেছনে কারা ছিলেন? যারা তাকে আজকের পরীমনি বানিয়েছেন তাদের বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি তুলেছেন নায়িকার স্বজনেরা।
Comment here