আকাশে রঙিন ঘুড়ির মেলা - দৈনিক মুক্ত আওয়াজ
My title
ঢাকাসমগ্র বাংলা

আকাশে রঙিন ঘুড়ির মেলা

নিজস্ব প্রতিবেদক : বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ। তেমনি এক পার্বণ পৌষসংক্রান্তি। পুরান ঢাকাবাসীর কাছে এ উৎসবের নাম ‘সাকরাইন’। পৌষের শেষ ও মাঘের প্রথম দিন আকাশ চলে যায় রঙবেরঙের ঘুড়ির দখলে। বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা হতেই পাল্টে যায় আয়োজনের রূপ। ঘুড়ি ছেড়ে ঢাকাবাসীর হাতে ওঠে আতশবাজি আর ফানুস। উচ্চতালে গানবাজনার সঙ্গে মধ্যরাত পর্যন্ত চলে আলোর খেলা।

পৌষসংক্রান্তিতে ঘুড়ি ওড়ানোর প্রচলন বহু আগের, সেই মুঘল আমল থেকে। বলা হয়ে থাকেÑ ১৭৪০ সালে নায়েব-ই-নাজিম নওয়াজেশ মোহাম্মদ খানের আমলে এই ঘুড়ি উৎসবের সূচনা। পুরান ঢাকার অধিবাসীরা আজও এটি উদযাপন করে আসছেন। সাকরাইনে নতুন ধানের চালের পিঠা-পুলি খেয়ে, ঘুড়ি উড়িয়ে আনন্দ-উৎসব করার রেওয়াজ। গতকাল মঙ্গলবার শীতও যেন মøান করতে পারেনি উৎসবের এই আনন্দ। সকাল থেকেই নানান রঙের বাহারি ঘুড়িতে ছেয়ে যায় নীল আকাশ। লক্ষ্মীবাজার, তাঁতীবাজার, শাঁখারিবাজার, ধূপখোলা, সদরঘাট, গোয়ালনগর, নারিন্দা, স্বামীবাগ, গে-ারিয়া, লালবাগ, বংশাল, সূত্রাপুর এবং আশপাশের অলিগলিতে ছড়িয়ে পড়ে উন্মাদনা। চক্ষুদার, ভোয়াদার, পানদার, কথাদার,

মালাদার, পঙ্খী, পঙ্খীরাজ, চলনদার, পেটিদার, পাংদার, প্রজাপতি, দাপস, চিল, কচ্ছপসহ বিভিন্ন নামের নানা আকৃতির ঘুড়ি কেনাবেচায়ও ছিল ধুম। সুতায় মাঞ্জা দেয়ার পর্ব তারা আগেই সেরে রেখেছিল। ভোরবেলা কুয়াশার আবছায়াতেই ছাদে ছাদে শুরু হয় ঘুড়ি ওড়ানো। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ে উৎসবের জৌলুস। পাল্লা দিয়ে চলে ঘুড়ির কাটা-কাটি খেলা। সন্ধ্যায় আধুনিক সাউন্ড সিস্টেমের সঙ্গে চলে আগুন নিয়ে খেলা, আতশবাজি আর ফানুসে নতুন এক রূপ নেয় রাতের আকাশ।

এতে কেবল স্থানীয়রাই নয়, নগরীর অনেক এলাকা থেকে ঘুড়ি উৎসবে যোগ দিতে আসেন বিভিন্ন বয়সীরা। দক্ষিণখান থেকে আসা বদিউল হক দেওয়ান বলেন, ‘আয়োজনে দিনের বেলায় ওড়ানো হয় ঘুড়ি, সন্ধ্যায় চলে আতশবাজি। সবমিলে এ যেন এক অন্যরকম উৎসব।’ ঘুড়ি উৎসব দেখতে উত্তরা থেকে এসেছিলেন বহ্নিÑ ‘সন্ধ্যায় আতশবাজির ঝলকানির সঙ্গে মুখ থেকে আগুন বের করার দৃশ্যটি সবচেয়ে আকর্ষণীয়। এর আগে আমি ভিডিওতে দেখেছিলাম। আজ (মঙ্গলবার) সশরীরে উপস্থিত হয়েছি এটি দেখার জন্য।’

অতীতে সাকরাইনে পুরান ঢাকায় শ্বশুরবাড়ি থেকে জামাইদের নাটাই, বাহারি ঘুড়ি উপহার দেওয়া এবং পিঠার ডালা পাঠানো ছিল অবশ্য পালনীয় অনুসঙ্গ। ডালা হিসেবে আসা ঘুড়ি, পিঠা আর অন্যান্য খাবার বিলি করা হতো আত্মীয়-স্বজন এবং পাড়া-প্রতিবেশীদের মাঝে। ৩২ বছর ধরে এ উৎসবের সাক্ষি খোদেজা খাতুন। মানিকগঞ্জে জন্ম হলেও তিনি পুরান ঢাকার পুত্রবধূ। তার ভাষ্যÑ ‘বিয়ের পর থেকেই সাকরাইন দেখছি। আগে বড় আয়োজন করে বাড়িতে বাড়িতে পিঠা-পুলির উৎসব চলতো। এখনো হয়, তবে এর ব্যাপ্তি অনেক কমে গেছে।’

নানা রঙে আর ঢঙে এ উৎসব উদযাপন হয় ভারত, নেপাল, থাইল্যান্ড, লাওস, ফিলিপাইন, কম্বোডিয়াসহ এশিয়ার বেশ কয়েকটি দেশে। বিভিন্ন বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে উদযাপিত উৎসবের নামও দেশভেদে ভিন্ন। নেপালে এ উৎসবকে বলে মাঘি, থাইল্যান্ডে সংক্রান, লাওসে পি মা লাও, মিয়ানমারে থিং ইয়ান, কম্বোডিয়ায় মহাসংক্রান, ভারতে মকরসংক্রান্তি এবং পশ্চিমবঙ্গে আউনি বাউনি। উত্তর ভারতীয়রাও ঘুড়ি উৎসবটিকে ‘সাকরাইন’ বলে। সেখানে সুন্দর সুন্দর ঘুড়ির মাধ্যমে সূর্যদেবতার কাছে নিজেদের ইচ্ছা ও আকুতির কথা জানানো হয়।

Comment here