আসামি ৯৯, হাসিনা ছাড়া কাউকেই চেনেন না বাদী - দৈনিক মুক্ত আওয়াজ
My title
সারাদেশ

আসামি ৯৯, হাসিনা ছাড়া কাউকেই চেনেন না বাদী

ইউসুফ সোহেল : বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে কেন্দ্র করে গত ২১ জুলাই সকাল থেকেই রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকায় বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থী-জনতার বিপরীতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, আওয়ামী লীগ ও দলটির অঙ্গ-সংগঠনের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে ত্রিমুখী সংঘর্ষ ঘটে। দুপুরের পর তা ছড়িয়ে পড়ে শনির আখড়া ও রায়েরবাগ এলাকায়। এর মধ্যেই জীবিকার সন্ধানে ব্যাটারিচালিত রিকশা নিয়ে বের হয়েছিলেন ওবায়েদুল ইসলাম। সন্ধ্যায় দনিয়ার গোয়ালবাড়ি এলাকায় অনাবিল হাসপাতালের সামনে যাত্রীর জন্য অপেক্ষায় ছিলেন তিনি। এ সময় গুলিবিদ্ধ এক কিশোরকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য তাকে অনুরোধ করেন দুজন পথচারী। ওবায়েদুল সেই কিশোরকে অটোরিকশায় তুলতে গিয়ে তার মুখ দেখে আঁতকে ওঠেন। তিনি দেখতে পান- সেই কিশোর তারই বুকের ধন আল আমিন। তার আহাজারিতে ভারী হয়ে ওঠে পুরো এলাকা। হৃদয়বিদারক এই দৃশ্য মুহূর্তেই ভাইরাল হয়ে যায় নেট দুনিয়ায়।

আল আমিন হত্যাকা-ের ঘটনায় গত ১ সেপ্টেম্বর রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থানায় মামলা (নম্বর-৭) করেছেন ওবায়েদুল ইসলাম। মামলার এজাহারে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও দলটির অঙ্গ-সংগঠনের ৯৯ জন নেতা-কর্মীর নাম উল্লেখ ছাড়াও অচেনা ১৫০ জনকে আসামি করা হয়। কিন্তু আসামির তালিকায় কোনো পুলিশ সদস্যের নাম নেই। অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত ১ সেপ্টেম্বর ডেমরা থানার ভেতরে পুলিশ অর্ধেক লেখা একটি পৃষ্ঠার নিচে স্বাক্ষর নিয়ে বাসায় পাঠিয়ে দেয় নিরক্ষর বাদী ওবায়েদুল ইসলামকে। গত সোমবার থানা থেকে এজাহারের কপি হাতে পেয়ে আকাশ থেকে পড়েন তিনি। আধা পৃষ্ঠার সেই কাগজ তিন পৃষ্ঠা করে তাতে আসামি হিসেবে শেখ হাসিনাসহ ৯৯ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে।

ওবায়েদুল ইসলামের অভিযোগ, এজাহারে উল্লেখ করা ৯৯ জন আসামির মধ্যে শেখ হাসিনা ছাড়া কাউকেই চেনেন না তিনি। শেখ হাসিনাকেও চেনেন টিভির বদৌলতে। মামলা না করলে সরকারিভাবে নিহতের তালিকায় শহীদ কিশোর আল আমিনের নাম ওঠানো যাবে না, এমনকি অনুদানও পাওয়া যাবে না- এই ভয় দেখিয়ে ওবায়েদুলকে দিয়ে মনগড়া মামলা করিয়েছে স্থানীয় একটি মহল। শুধু তাই নয়, বাদীর সঙ্গে যেন যোগাযোগ করা না যায়, সেজন্য এজাহারে তার মোবাইল নম্বর না দিয়ে উল্লেখ করা হয় একটি ভুয়া নম্বর- ০১৯২৩০৩৬৬৭৪। গতকাল এই নম্বরে ফোন দিলে সেটি বন্ধ পাওয়া যায়। এজাহারে তিন জেলার ৫ জনকে আসামি করা ছাড়াও ঢাকার ৩ আওয়ামী লীগ নেতার রক্ষিতা বানিয়ে আসামির তালিকায় তুলে দেওয়া হয় ৩ নারীর নামও। সরকারিভাবে নিহতের তালিকায় শহীদ আল আমিনের নাম ওঠানোর কথা বলে ঢাকা মহানগর দক্ষিণের ৬১নং ওয়ার্ড বিএনপির (যাত্রাবাড়ী ও কদমতলী থানার আংশিক) আহ্বায়ক মো. শাহ আলম তার অনুসারী শিশিরকে দিয়ে থানায় পাঠিয়ে এই মামলা করেছেন বলে দাবি করেন ওবায়েদুল।

ছাত্র-জনতার আন্দোলন চলাকালে রিকশায় লাশ টানতে গিয়ে হঠাৎ ছেলের মরদেহ পাওয়ার হৃদয়বিদারক সেই দৃশ্য দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমে প্রকাশ করা হলেও বিএনপি নেতা শাহ আলম তার কর্মী শিশির ও পুলিশকে দিয়ে মামলার এজাহারে উল্লেখ করিয়েছেন- ছাদ থেকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে আল আমিনকে। আর সরাসরি গুলি করে এই হত্যাকা- ঘটিয়েছেন এজাহারে উল্লেখ করা ৩ নারী, ঢাকার বাইরে থাকা পাঁচজনসহ ৯৯ জন আসামি। তাদের হত্যার হুকুম দিয়েছেন শেখ হাসিনা। অথচ ছাত্রদের ওপর গুলিবর্ষণে যাদের সরাসরি সম্পৃক্ততা রয়েছে সেই সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, পুলিশের সাবেক আইজি, স্থানীয় ডিসি (ওয়ারী বিভাগ), তিন থানার ওসিসহ অন্যান্য পুলিশ সদস্যের নাম এজাহারে লেখা হয়নি।

অভিযোগ ভিত্তিহীন দাবি করে বিএনপি নেতা মো. শাহ আলম গত সোমবার আমাদের সময়কে বলেন, রিকশাচালকের সঙ্গে তার কোনো পরিচয় নেই। গত ২১ জুলাই আল আমিনের মৃত্যুর পর সহানুভূতির হাত বাড়িয়ে দিতে এসেছিলেন তিনি। এ হত্যা মামলা করার কোনো প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত নন দাবি করে তিনি বলেন, আমাকে বিতর্কিত করতে একটি মহল এ ধরনের অপপ্রচার চালাচ্ছে। অভিযুক্ত শিশিরের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করা হলেও সাড়া দেননি তিনি।

যুবলীগের ক্যাডার উল্লেখ করে এজাহারে ৩৪ নম্বর আসামি করা হয়েছে এসএ জান্নাত শেখ নামে এক যুবককে। তাকে অনেক খুঁজেও পাওয়া যায়নি। তবে জান্নাত শেখের ভাই মামুন শেখ আমাদের সময়কে বলেন, আমার ভাই রাজনীতির সঙ্গে জড়িত না। মামলায় নাম আসার পর থেকে আমরা আশঙ্কার মধ্যে আছি। উদ্দেশ্যমূলকভাবে কোনো একটি পক্ষ আমার ভাইকে ফাঁসিয়েছে। বাদী নিজেই বলছেন আমার ভাইকে তিনি চেনেন না।

ওবায়েদুল ইসলাম বলেন, একমাত্র সন্তান আমিনের মৃত্যুর পর শোকে পাথর হয়ে গেছে তার মা সেলিনা বেগম। ছেলের শোক কাটিয়ে উঠতে পারিনি আমিও। এই পরিস্থিতিতে বিএনপি নেতা শাহ আলম ভাই এসে বললেন, মামলা না করলে সরকারি খাতায় শহীদ হিসেবে আমিনের নাম উঠবে না; আর নাম না উঠলে অনুদানও পাবেন না। তার কথায় রাজি হই। কেন মিথ্যা মামলা করা হলো বুঝতে পারছি না। এখন সেই বিএনপি নেতাকে ১০ বার ফোন করলে একবারও ধরেন না। ধরলেও বলেন, মামলা আপনি করেছেন, আমি কী জানি। এ অবস্থায় কী করব? কাজে যেতেও সাহস পাচ্ছি না।

আল আমিনের মা সেলিনা বেগম বলেন, মামলায় নাম দেওয়ার কারণে আসামিরা যদি আমাদের ওপর হামলা করে তখন কী করব? ছেলে হারিয়েছি, এখন ছেলের বাপরেও হারানো লাগে কি-না সেই চিন্তায় রাতে ঘুম হয় না।

যাত্রাবাড়ী থানার ওসি মোহাম্মদ মাইনুল ইসলাম আমাদের সময়কে বলেন, মামলার এজাহার নিয়ে সেদিন থানায় ওবায়েদুল ইসলামসহ আরও অন্তত ৪০ জন থানায় এসেছিল। বাদীর এজাহার কালবিলম্ব না করে মামলা হিসেবে গ্রহণ করা হয়। এখন যদি বাদী বলেন, আসামিদের কাউকেই তিনি চেনেন না- তাহলে বিষয়টি রহস্যজনক। কেউ উদ্দেশ্যমূলকভাবে বাদীকে দিয়ে এমন কাজ করিয়ে থাকলে তা তদন্তে জানা যাবে। বাদী না চাইলে আদালতে গিয়ে মামলা না চালানোর আর্জি দিলেই হয়তো সহজ সমাধান পাওয়া যেতে পারে।

আল আমিন হত্যা মামলায় এখনও কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়নি বলেও জানান এই পুলিশ কর্মকর্তা।

Comment here