আহা ঝাঁজে মরি! - দৈনিক মুক্ত আওয়াজ
My title
সারাদেশ

আহা ঝাঁজে মরি!

নিজস্ব প্রতিবেদক ও চট্টগ্রাম ব্যুরো : ‘পাগলা খাবি কি, ঝাঁজেই মরে যাবি…।’ জনপ্রিয় গানটির মতোই যেন হয়েছে পেঁয়াজের সাধারণ ক্রেতাদের অবস্থা। দীর্ঘ সময় স্থিতিশীল থাকার পর আবারও লম্বা পায়ে ছুটছে মসলা-পণ্যটি। এক লাফে কেজিতে দাম বেড়েছে ১০ থেকে ১৫ টাকা। কোথাও কোথাও আবার বেড়েছে ১৮ টাকা পর্যন্ত। গত শুক্রবারও ৪৫ টাকা কেজিতে বিক্রি হওয়া পেঁয়াজ কিনতে হচ্ছে ৫৫ থেকে ৬০ টাকায়।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, চাহিদার বিপরীতে নিত্যপণ্যটির বাজারে সংকট সৃষ্টি হওয়ায় এমন পরিস্থিতি। তবে ব্যবসায়ীদের অজুহাত মানতে নারাজ সাধারণ ভোক্তারা। হঠাৎ করেই এমন অস্বাভাবিক দাম বাড়ায় ক্ষুব্ধ অনেকেই। গতবারের মতো লাগামহীন হয়ে যাওয়ার আগেই বাজার তদারকির জোর দাবি তাদের।

সরবরাহ সংকটের অজুহাতে ভোগ্যপণ্যের পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জে প্রতিদিনই বাড়ছে পেঁয়াজের দাম। গত এক সপ্তাহ ধরে প্রতিদিন কেজিতে বেড়েছে আড়াই টাকা করে। সব মিলিয়ে বাড়ানো হয়েছে ১৮ টাকা। ব্যবসায়ীরা অবশ্য বলছেন, পণ্যটির দাম আরও বাড়বে, যদি ভারত থেকে পেঁয়াজ না আসে। গতকাল বুধবার সকালে পাইকারি বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত সপ্তাহে দেশীয় পেঁয়াজের দাম ছিল ৩০ টাকা কেজি। এখন সেটা ক্রমান্বয়ে বাড়তে বাড়তে ৪৮ টাকায় এসে ঠেকেছে। সপ্তাহ ব্যবধানে বেড়েছে ১৮ টাকা। গড় হিসাব করলে দেখা যায়, প্রতিদিন আড়াই টাকা হারে বাড়ছে। আর সপ্তাহ আগে মিয়ারমারের পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছিল ৪২ টাকা। গতকাল বুধবার বিক্রি হচ্ছে ৫৩ টাকা কেজি। খুচরা বাজারে ইতোমধ্যে পেঁয়াজের কেজি হয়ে গেছে ৫৭ টাকা।

শুধুই যে পেঁয়াজের দাম বাড়ছে তা কিন্তু নয়। সরবরাহ সংকটের অজুহাত দিয়ে রসুনের দামও বাড়িয়ে দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। গত সপ্তাহে রসুনের কেজি ছিল ১০০ টাকা, সেটা এখন বিক্রি হচ্ছে ১১৪ টাকায়। বেড়েছে ১৪ টাকা। খাতুনগঞ্জের হামিম এন্টারপ্রাইজের কর্মকর্তা মোহাম্মদ জমির উদ্দিন আমাদের সময়কে বলেন, ‘গত সপ্তাহের তুলনায় খাতুনগঞ্জের পাইকারিতেও পেঁয়াজের দাম বেড়েছে কেজিপ্রতি ১৮ টাকা। মূলত ভারতের পেঁয়াজ আমদানি বন্ধ ও মিয়ানমারেরটা সরবরাহ কম থাকায় দাম বেড়েছে। যদি ভারত ও মিয়ানমার থেকে পেঁয়াজ না আসে তা হলে পণ্যটির দাম আরও বাড়বে।’

রাজধানীর কারওয়ানবাজারে গতকাল বিকাল নাগাদ দেশি পেঁয়াজের কেজি বিক্রি হয়েছে ৫৫ টাকা। এ বাজারের খুচরা ব্যবসায়ী মো. জুয়েল মিয়া বলেন, ‘গত শনিবার থেকে পেঁয়াজের দাম কয়েক দফা বেড়েছে। গতকাল (মঙ্গলবার) আড়তে ৫৫ টাকার নিচে পেঁয়াজ কিনতে পারিনি। আজও বিক্রি হয়েছে ৫০ থেকে ৫২ টাকা কেজি দরে। এ দামে কিনে আজ (বুধবার) খুচরায় বিক্রি করছি ৫৫ টাকা কেজিতে। অনেকে বাছাই করা পেঁয়াজ বিক্রি করছে ৫৮ টাকা কেজি পর্যন্ত। গতকাল (মঙ্গলবার) বিক্রি করেছি ৬০ টাকা কেজি।

গত শুক্রবারে বিক্রি করেছি ৪৫ টাকা এবং এর আগে বিক্রি করেছি ৪০ টাকা কেজি।’ পাইকারি প্রতিষ্ঠান বিক্রমপুর বাণিজ্যালয়ের ব্যবসায়ী মো. ফয়েজ আহমেদ বলেন, ‘নতুন পেঁয়াজ ওঠার পর দাম অনেক কমে এসেছিল। কিন্তু বর্তমানে পাবনা, কুষ্টিয়া, মাগুরা, ফরিদপুরসহ অন্যান্য অঞ্চলের স্থানীয় হাটেও পেঁয়াজ বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। এসব এলাকায় স্থানীয়ভাবে প্রতি কেজি পেঁয়াজের দাম পড়ছে ৫০ টাকারও বেশি। স্বাভাবিকভাবেই সে পেঁয়াজ রাজধানীর আড়তে বিক্রি হচ্ছে ৫২ থেকে ৫৪ টাকা পর্যন্ত। গতকাল এ দামে বিক্রি হলেও আজ দাম কিছুটা কমেছে। এ বাজারের আড়তে ৪৮ থেকে ৫০ টাকা কেজি দরে পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে।’

মালিবাগ বাজারের গাজী স্টোরের ব্যবসায়ী মো. রুবেল হোসেন বলেন, ‘গত দুদিনে আড়তে দাম আরও বাড়তি ছিল। গতকাল এ বাজারে ৬০ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে পেঁয়াজ। আজও কিছু দোকানে এই দামে বিক্রি হয়। তবে আজ আড়তে দাম একটু কমেছে। আজ (বুধবার) যারা কিনেছেন তারা খুচরায় ৫৫ টাকা বিক্রি করছেন। আজ আমি ৫২ টাকা কেজি দরে পেঁয়াজ সংগ্রহ করেছি। এ পেঁয়াজ ৫৫ টাকার নিচে বিক্রি করা সম্ভব নয়।’ ওই বাজারে এসে পেঁয়াজের এমন দাম শুনে চোখ কপালে উঠে যায় মো. নজরুল ইসলাম ফরিদের। বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের এ চাকরিজীবী বলেন, ‘শুক্রবারেও তো ৪৫ টাকা কেজি পেঁয়াজ কিনলাম। আজ সে পেঁয়াজ ৫৫ থেকে ৬০ টাকা চাওয়া হচ্ছে। কয়েকদিনের মধ্যে এত দাম বাড়ে কীভাবে। বাজার দেখার কী কেউ নেই? কিছুদিন আগেই তো নতুন পেঁয়াজ উঠেছে বাজারে।’

রাজধানীতে পেঁয়াজের অন্যতম বড় পাইকারি বাজার শ্যামবাজারেও একদিনের ব্যবধানে পেঁয়াজের দাম অনেক বেড়েছে। আজমীর ভা-ারের ব্যবসায়ী তপু সেন আমাদের সময়কে বলেন, ‘সপ্তাহের ব্যবধানে গতকাল (মঙ্গলবার) দেশি পেঁয়াজের দাম কেজিতে প্রায় ২০ টাকা বেড়ে যায়। এদিন পাইকারিতে পেঁয়াজ বিক্রি হয় ৫০ থেকে ৫২ টাকা পর্যন্ত। গত সপ্তাহে যা ছিল ৩০ থেকে ৩২ টাকা। তবে আজ পেঁয়াজের দাম কমেছে। আজ বিক্রি করছি ৪০ থেকে ৪২ টাকা কেজি দরে।’ তপু সেন আরও বলেন, ‘করোনার কারণে পেঁয়াজের আমদানি বন্ধ ছিল। ব্যবসায়ীরা পেঁয়াজ আমদানির জন্য এলসি (ঋণপত্র) খুলতে পারছিলেন না। অপরদিকে আবহাওয়ার কারণে রাজধানীতে পেঁয়াজের সরবরাহও কমেছে। আবার আমদানি কম থাকায় বিভিন্ন অঞ্চলের স্থানীয় হাটেও দাম বেড়ে গেছে। তবে ব্যবসায়ীরা এখন এলসি খুলতে পারছেন। তাই দাম কমতে শুরু করেছে আবার। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে দাম কমে আসবে বলে ধারণা করছি আমরা।’

শ্যামবাজারের মিতালী বাণিজ্যালয়ের ব্যবসায়ী কানাই সাহা বলেন, ‘ভারতের সঙ্গে স্থলসীমান্ত দিয়ে চলাচল বন্ধের মেয়াদ ১৪ জুন পর্যন্ত বাড়ানোর কারণে আমদানি-রপ্তানিসহ অন্যান্য বাণিজ্যিক কার্যক্রমও বন্ধ থাকবে। এ ধারণা থেকে অনেক ব্যবসায়ী হঠাৎ পেঁয়াজের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন। তা ছাড়া আমদানির জন্য এলসি খুলতে পারছিলেন না ব্যবসায়ীরা। তাই দাম বেড়েছিল।’ একই কথা বলেন চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জের মায়ের দোয়া স্টোরের মালিক রনি বিশ্বাস, ‘সরকার ভারতীয় পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি দেবে এ কথা শুনার পরও পেঁয়াজের দাম কমছে না। উল্টো বাড়ছে। এ ছাড়া আজকে (বুধবার) মিয়ানমারের ৫০ ট্রাক পেঁয়াজ বাজারে প্রবেশ করেছে। দাম কিছুটা কমতে পারে। ভারতীয় পেঁয়াজও বাজারে এলে দাম কমবে।’

কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সহসভাপতি এসএম নাজের হোসাইন বলেন, ‘ব্যবসায়ীদের কারসাজির কারণেই পেঁয়াজের দাম হঠাৎ বৃদ্ধি পেয়েছে। পাশাপাশি সরকারের কোনো সংস্থা থেকেই আসলে বাজার মনিটরিং করা হচ্ছে না। ফলে ব্যবসায়ীরা ইচ্ছামতো বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে।’ তিনি বলেন, ‘এখন শুধুই যে পেঁয়াজের দাম বাড়ছে তা কিন্তু নয়। এর সঙ্গে রসুনের দামও বাড়ছে। প্রশাসনের কাছে দাবি জানাচ্ছি, বাজার তদারকি করে মজুদদারদের বিরুদ্ধে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। না হলে এসব পণ্যের দাম গত বছরের মতো লাগামহীন হয়ে যাবে।’

বাজার তদারকি করার ইঙ্গিত দিয়ে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ মমিনুর রহমান বলেন, ‘ভোগ্যপণ্যের বাজার তদারকি করার জন্য আমাদের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের একটি দলকে প্রস্তুত করা হয়েছে। তারা খুব শিগগিরই বাজার তদারকি শুরু করবে। এ ছাড়া কারও বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়া গেলে তাকে আইনের আওতায় আনা হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘বাজার তদারকি করার সময় অবশ্যই ব্যবসায়ীদের পণ্য ক্রয়ের রশিদ কিংবা চালান রশিদ দেখাতে হবে।’

 

Comment here