ইন্টারপোল পুলিশ কীভাবে কাজ করে? - দৈনিক মুক্ত আওয়াজ
My title
সারাদেশ

ইন্টারপোল পুলিশ কীভাবে কাজ করে?

নিজস্ব প্রতিবেদক :সংযুক্ত আরব আমিরাতের স্বর্ণ ব্যবসায়ী আরাভ খানের বিরুদ্ধে ইন্টারপোল ‘রেড নোটিশ’ জারি করেছে। পুলিশের মহাপরিদর্শক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন এ কথা নিশ্চিত করেছেন।

তিনি বলেছেন, ‘আরাভ খানের বিরুদ্ধে “রেড নোটিশ” জারি করার জন্য পুলিশের পক্ষ থেকে ইন্টারপোলের কাছে আবেদন করা হয়েছিল। ইন্টারপোল সেই আবেদন গ্রহণ করেছে।’

ইতোমধ্যে আরাভ খানের রেসিডেন্স পারমিশন বাতিল করার পাশাপাশি বিনা নোটিশে তাকে দেশ ছাড়তে নিষেধ করেছে সংযুক্ত আরব আমিরাত কর্তৃপক্ষ।

এরআগে এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক ও রিলায়েন্স ফাইন্যান্স লিমিটেডের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রশান্ত কুমার (পি কে) হালদারকে ধরতে পুলিশ রেড নোটিশ জারির আবেদন করে। তবে তার নাম এখনও ইন্টারপোলের বাংলাদেশি ‘ওয়ান্টেড পার্সন’ এর তালিকায় নেই।

ইন্টারপোল তার বিরুদ্ধে এই নোটিশ আদৌ জারি করবে কিনা সেটাও অনিশ্চিত।

তবে তিন বছর আগে লিবিয়ায় ২৬ জন বাংলাদেশি হত্যাকাণ্ডের পর মানব-পাচারকারীদের ধরতে ইন্টারপোলের সহযোগিতা চেয়েছিল বাংলাদেশ। তাদের মধ্যে এখন পর্যন্ত ছয়জনের বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারি করে ইন্টারপোল।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে- বিদেশে পালিয়ে থাকা আসামিদের ধরতে ইন্টারপোল পুলিশ কীভাবে কাজ করে?

ইন্টারপোল কি?
ইন্টারপোল বিশ্বের বৃহত্তম আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা। ইন্টারপোল বা ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল পুলিশ অর্গানাইজেশন একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা যার প্রধান কাজ আন্তর্জাতিক পুলিশকে সহায়তা করা।

এটি ৭ সেপ্টেম্বর ১৯২৩ সালে, ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল পুলিশ কমিশন নামে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ১৯৪৬ সালে বর্তমানের নামে পরিবর্তিত হয়। ফ্রান্সের লিয়নে এর সদর দপ্তর রয়েছে।

ইন্টারপোল আন্তর্জাতিক অপরাধের তিনটি প্রধান ক্ষেত্র: সন্ত্রাসবাদ, সাইবার অপরাধ এবং সংগঠিত অপরাধ নিয়ে কাজ করে। এটি বিশ্বব্যাপী আইন প্রয়োগকারীকে তদন্তমূলক সহায়তা, দক্ষতা এবং প্রশিক্ষণ প্রদান করে।

ইন্টারপোলের কার্যাবলী:
ইন্টারপোল আইন প্রয়োগকারী কর্মকর্তাদের জরুরী সহায়তা এবং অপারেশনাল কার্যক্রমে সহায়তা করে, বিশেষ করে পলাতক, জননিরাপত্তা এবং সন্ত্রাস, মাদক ও সংগঠিত অপরাধ, মানব পাচার ইত্যাদি।

আই-২৪/৭ নামক একটি পরিষেবা ইন্টারপোল দ্বারা পরিচালিত হয়, যা একটি গ্লোবাল পুলিশ কমিউনিকেশন সিস্টেম। সদস্য দেশগুলোর পুলিশ সংস্থাগুলোর একে অপরের সঙ্গে সংবেদনশীল এবং জরুরী পুলিশ তথ্য শেয়ার করার জন্য এটি গঠিত হয়েছে।

ইন্টারপোল একটি ডেটাবেস সরবরাহ করে যা পুলিশ বিশ্বব্যাপী অ্যাক্সেস করতে পারে। এই ডাটাবেস সারা বিশ্বের পুলিশকে অপরাধ প্রতিরোধ ও তদন্তের জন্য প্রয়োজনীয় পরিষেবাগুলো অ্যাক্সেস করতে দেয়।

ডাটাবেসে অপরাধমূলক তথ্য যেমন ক্রিমিনাল প্রোফাইল, ক্রিমিনাল রেকর্ড, চুরির রেকর্ড, চুরি যাওয়া পাসপোর্ট, যানবাহন, আর্টওয়ার্ক এবং জালিয়াতি ইত্যাদি রয়েছে।

ইন্টারপোলের গঠন
ইন্টারপোলের সংবিধান অনুসারে, সংস্থাটি নিম্নলিখিত প্রশাসনিক বিভাগগুলো নিয়ে গঠিত:
সাধারন সভা (General Assembly)
জেনারেল সেক্রেটারিয়েট (General Secretariat)
কার্যনির্বাহী কমিটি (Executive Committee)
জাতীয় কেন্দ্রীয় ব্যুরো (National Central Bureaus)

১. সাধারণ পরিষদ (General Assembly):
সাধারণ পরিষদ হল ইন্টারপোলের সর্বোচ্চ পরিচালন সংস্থা, এটি প্রতিটি সদস্য দেশের প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত। সাধারণ পরিষদ বছরে একবার মিলিত হয় এবং প্রতিটি অধিবেশন প্রায় চার দিন স্থায়ী হয়। সদস্য দেশের পুলিশ প্রধান এবং মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা প্রতিনিধিত্ব করেন।

সাধারণ পরিষদ কাজের পদ্ধতি, নীতি, অর্থ, সংস্থান, অন্যান্য কার্যক্রম এবং প্রোগ্রাম সম্পর্কিত সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে।

২. কার্যনির্বাহী কমিটি (Executive Committee):
সাধারণ পরিষদ ১৩ সদস্যের কার্যনির্বাহী কমিটিকে নির্বাচন করে যার মধ্যে রয়েছে:

১ জন রাষ্ট্রপতি, ৩ সহ-সভাপতি, ৯ জন প্রতিনিধি নিয়ে এটি গঠিত।

৩. সাধারণ সচিবালয় (General Secretariat):
সাধারণ সচিবালয়ের কার্যকারিতার জন্য ৬টি আঞ্চলিক কার্যালয় রয়েছে:
আর্জেন্টিনা (দক্ষিণ আমেরিকা)
আইভরি কোট (পশ্চিম আফ্রিকা)
এল সালভাদর (মধ্য আমেরিকা)
কেনিয়া (পূর্ব আফ্রিকা)
থাইল্যান্ড (দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া)
জিম্বাবুয়ে (আফ্রিকা)

৪. জাতীয় কেন্দ্রীয় ব্যুরো (National Central Bureaus):
জাতীয় কেন্দ্রীয় ব্যুরো হল জেনারেল সেক্রেটারিয়েট, আঞ্চলিক অফিস এবং অন্যান্য সদস্য দেশগুলোর সাথে যোগাযোগের মাধ্যম যেখানে বিদেশী তদন্ত এবং পলাতকদের অবস্থান এবং আশংকা নিয়ে কাজ করে।

একটা সময় ছিল, যখন বড় ধরনের অপরাধ করে পার পেয়ে যাওয়া ছিল খুব সহজ। অপরাধীরা দেশের সীমানা পেরিয়ে গেলেই তাদের আর আটক বা গ্রেপ্তারের সুযোগ থাকতো না সেদেশের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর। এই সুযোগ বেশ ভালোই কাজে লাগাচ্ছিল বিভিন্ন মাফিয়া চক্র।

বারবার এভাবে অপরাধীদের কাছে পরাজিত হওয়ার হতাশা থেকেই চিন্তা আসে একটি আন্তর্জাতিক বাহিনী গড়ে তোলার। ১৯১৪ সালে মোনাকোতে ইন্টারন্যাশনাল কংগ্রেস অফ জুডিশিয়াল পুলিশের প্রথম বৈঠকে এ বিষয়ে আলোচনা হয়। এই সমস্যাকে বৈশ্বিকভাবে মোকাবেলা করার ব্যাপারে বৈঠকে একমত হন অংশগ্রহণকারীরা। সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, ‘আন্তর্জাতিক অপরাধীদের দমন করা হবে আন্তর্জাতিকভাবেই।’

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ এই উদ্যোগের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো তৈরিকে দীর্ঘায়িত করে। কিন্তু ১৯২৩ সালে সংস্থাটির দ্বিতীয় কংগ্রেসে ভিয়েনায় ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল পুলিশ কমিশন স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। পরবর্তীতে এই সংস্থারই নামকরণ হয় ইন্টারপোল।

কিন্তু সংস্থাটির কোনো আইনি কাঠামো না থাকায় সদস্য রাষ্ট্রগুলোর ওপর এর তেমন কর্তৃত্বও ছিল না। শুধু গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ এবং বিভিন্ন দেশের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর মধ্যে যোগাযোগ রক্ষাই ছিল এর প্রধান কাজ।

ইন্টারপোলের কাজের ধরণ
সদস্য রাষ্ট্রগুলোর অভ্যন্তরীণ বা দেশগুলোর মধ্যকার রাজনৈতিক বিষয়ে যাতে ইন্টারপোল নাক না গলাতে পারে, সেজন্য সংস্থার প্রতিষ্ঠাকালীন মূলনীতিতে বলা হয়, এই সংস্থা ‘রাজনৈতিক, সেনা সম্পর্কিত, ধর্মীয় ও জাতিগত’ বিষয় ছাড়া অন্য বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করবে। মূলত জঙ্গিবাদ, যুদ্ধাপরাধ, মাদক চোরাচালান, মানবপাচার, শিশু পর্নোগ্রাফি, দুর্নীতির মতো অপরাধ নিয়েই কাজ করে ইন্টারপোল।

নানা রঙের নোটিশ:
অপরাধীদের অপরাধ বিষয়ে বিভিন্ন দেশের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে সতর্ক করতে নানা রঙের নোটিশ ব্যবহার করে থাকে ইন্টারপোল। সবচেয়ে বিপদজনক হিসেবে চিহ্নিত করা হয় রেড নোটিশকে। রেড নোটিশকে এই সংস্থাটির আন্তর্জাতিক গ্রেপ্তারি পরোয়ানার সমতুল্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই ব্যবস্থায় মুহূর্তের মধ্যে ১৯০ সদস্য রাষ্ট্রের পুলিশের কাছে চলে যায় অপরাধীদের অপরাধ, সর্বশেষ অবস্থান এবং অন্যান্য বিষয়ে প্রয়োজনীয় তথ্য।

প্রসঙ্গত, হত্যা ও বিস্ফোরক রাখার অভিযোগে অভিযুক্ত জিসান আহমেদকে ২০১৯ সালের অক্টোবরে দুবাইয়ে গ্রেপ্তার করা হয় এবং গ্রেপ্তারের পর এ বিষয়ে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়।

কর্মকর্তাদের মতে, ঘটনার পর পুলিশ অভিযুক্তকে ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া শুরু করে, কিন্তু জিসান দুবাইতে জামিন পেয়ে যুক্তরাজ্যে পালিয়ে যায়।

ঢাকা আওয়ামী লীগ নেতা জাহিদুল ইসলাম টিপুকে হত্যার ঘটনায় সন্দেহভাজন একজনের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে আসামি সুমন সিকদার ওরফে মুসার নাম প্রকাশের পর শুরু হয় আরেকটি আন্তঃদেশিয় অভিযান।

২০২২ সালের ৮ মে মুসা ওমানে যাওয়ার পর বিষয়টি মাস্কাটের ইন্টারপোল ডেস্ককে অবহিত করে ঢাকা। মুসার ওমান সফর বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জন্য নতুন সুযোগ নিয়ে আসে। কর্মকর্তাদের মতে, সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে গ্রেপ্তারে মাস্কাট অনেক বেশি প্রতিক্রিয়াশীল।

এদিকে আরাভকে ফিরিয়ে আনা প্রসঙ্গে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের (এনএইচআরসি) চেয়ারম্যান ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ গণমাধ্যমকে বলেন, ‘সংযুক্ত আরব আমিরাতের সঙ্গে বাংলাদেশের কোনো প্রত্যর্পণ চুক্তি নেই। তবে যেহেতু আরাভের অবস্থান শনাক্ত করা গেছে, এক্ষেত্রে কান্ট্রি-টু-কান্ট্রি যোগাযোগ অগ্রাধিকার পেতে পারে।’

তিনি পরামর্শ দেন, বাংলাদেশ সরকারের উচিত সংযুক্ত আরব আমিরাত কর্তৃপক্ষকে জানানো যে, রবিউল ওরফে আরাভ বাংলাদেশের আইন প্রয়োগকারী সংস্থার দ্বারা একজন চিহ্নিত অপরাধী।

তিনি বলেন, ‘যেহেতু তার বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি মামলা এবং চার্জশিট দাখিল করা হয়েছে, পুলিশ সহজেই প্রমাণ করতে পারবে সে একজন অপরাধী।’

ভারতীয় পাসপোর্ট নিয়ে আরাভের দুবাই পালিয়ে যাওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এটি আরাভের আরেকটি অপরাধ। ভারতকে এই বিষয়ে অবহিত করা উচিত এবং ভারতীয় পাসপোর্ট বা জাতীয়তা পাওয়ার জন্য নথিপত্র জাল করায় তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে।’

তিনি আরও বলেন, ‘আরাভ ভারতীয় পাসপোর্ট নিয়ে দুবাই গেলেও তাকে ফিরিয়ে আনতে তেমন সমস্যা হওয়ার কথা নয়, কারণ বাংলাদেশের অনুরোধে ভারত চাইলেই তার পাসপোর্ট বাতিল করতে পারে।’

কামাল উদ্দিন আহমেদ আরও জানান, ২০১৩ সালে সংযুক্ত আরব আমিরাতের সঙ্গে সাজাপ্রাপ্ত আসামিদের ফিরিয়ে আনার বিষয়ে একটি চুক্তি হয়েছিল। কিন্তু আরাভ এখনও কোনো মামলায় দোষী সাব্যস্ত বা সাজাপ্রাপ্ত না হওয়ায় তাকে এই চুক্তির আওতায় আনা যাবে না।

পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, ভারত ও থাইল্যান্ড ছাড়া বিশ্বের কোনো দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের কোনো বন্দি বিনিময় বা প্রত্যর্পণ চুক্তি নেই।

তবে এনসিবি ডেস্কের তথ্যানুসারে, ইন্টারপোলের রেড নোটিশ জারির পর ২০০৯ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে অন্তত ১৬ জনকে গ্রেপ্তার করে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে।

এর মধ্যে দুজনকে যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, মালয়েশিয়া, সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে এবং বাকি ছয়জনকে ইরান, নিউজিল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ আফ্রিকা, কাতার এবং ওমান থেকে ফেরত পাঠানো হয়।

পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, বাংলাদেশে ফেরত আসা পলাতকদের বেশিরভাগই খুনের আসামি।

বাংলাদেশ সরকার অভিযুক্ত লোকদের দেশে ফেরত পাঠানোর অনুরোধ করার পর ইন্টারপোল কর্তৃক জারিকৃত সক্রিয় রেড নোটিশের সংখ্যা বর্তমানে ৬২ তে দাঁড়িয়েছে।

তবে, রেড নোটিশ জারি করা সত্ত্বেও অনেক অভিযুক্তকে এখনও খুঁজে বের করে দেশে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়নি।

 

Comment here