ক্রাইম

ইভ্যালির ‘প্রতারণা’, এলাকাছাড়া হওয়ার পর বাইক পেল যুবক

জনি রায়হান : তথ্যপ্রযুক্তির যুগে অনলাইনে কেনাকাটার দিকে বেশি ঝুঁকে পড়ছে মানুষ। অনলাইনে কেনাকাটায় মানুষের সময় ও শ্রম দুটোই বেঁচে যায়। তবে কিছু অনলাইন ব্যবসায়ীর নানা রকমের লোভনীয় অফারে আকৃষ্ট হয়ে অনেকেই হয়রানির শিকার হচ্ছেন। কেউ কেউ প্রি-অর্ডারের টাকা ফেরত পাবেন কি না তা নিয়েও শঙ্কিত। এমন নানা ধরনের অভিযোগ উঠেছে সাম্প্রতিক সময়ে ‘অল্প টাকা’য় পণ্যের অফার দিয়ে আলোচনায় আসা অনলাইন শপ ‘ইভ্যালির’ বিরুদ্ধে।

শুধু হয়রানি নয়, ইভ্যালিতে বাইক অর্ডার করে এক যুবকের ঘরবাড়ি, এমনকি এলাকাছাড়া হওয়ার ঘটনাও উঠে এসেছে দৈনিক মুক্ত আওয়াজঅনলাইনের অনুসন্ধানে।

ইভ্যালির আকর্ষণীয় অফারের প্রলোভনে পড়ে নিজের বন্ধুর জন্য বাইক অর্ডার করেছিলেন ওই যুবক। টাকাও পরিশোধ করেছিলেন। কিন্তু ইভ্যালি প্রায় দেড় মাসেও তাকে বাইক দেয়নি। ফলে গ্রাম্য সালিসের মুখে পড়তে হয় ওই যুবককে। সালিসের পর থেকে নিজের বাড়িতে পর্যন্ত ফিরতে পারেননি তিনি। ভয়ে ঘরবাড়ি ও এলাকা ছাড়তে হয় তাকে। বিষয়টি নিয়ে শতাধিকবার ইভ্যালির কাস্টমার কেয়ারে যোগাযোগ করেছিলেন ওই যুবক। কিন্তু কাস্টমার কেয়ার থেকে বার বার তাকে শুধুই সান্ত্বনার বাণী শোনানো হচ্ছিল। পরে বাধ্য হয়ে ইভ্যালির ফেসবুক রিভিউ গ্রুপে একটি পোস্ট দিয়েছিলেন তিনি। যোগাযোগ করেছিলেন ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গেও। কাজ হচ্ছিল না কিছুতেই।

ইভ্যালিতে বাইক অর্ডারের পর নিজের দুর্বিষহ অভিজ্ঞতার কথা দৈনিক মুক্ত আওয়াজঅনলাইনকে জানিয়েছেন ওই যুবক। বিষয়টি নিয়ে ইভ্যালির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মোহাম্মদ রাসেলের সঙ্গে কথা বলেছেন এই প্রতিবেদক। তিনি অকপটে স্বীকার করেন, ওই যুবকের বাইক না পাওয়ার কথাসহ পুরো বিষয়টা তিনি জানেন। কিন্তু ওই যুবকের বিষয়টি আলাদা করে দেখার সুযোগ নেই। কারণ, তার মতো অনেককেই সঠিক সময়ে বাইক দেওয়া সম্ভব হয়নি।

বাইক অর্ডার করে যুবকের দুর্বিষহ অভিজ্ঞতা প্রসঙ্গে ইভ্যালির সিইওর ভাষ্য, ‘এই ঘটনার জন্য আমরা স্পেশাল কোনো অ্যাকশন নিতে পারব না। কারণ তার হাতে খুব সহজ একটা উপায় ছিল। সে অর্ডারটি ক্যানসেল দিলে আমি তার ক্যাশটি স্পেশালি রিফান্ডের ব্যবস্থা করে দিতাম। সে যদি ক্যানসেল দিয়ে একটা মেইল করে সমস্যাটি বলতো তাহলে এত কিছু হতো না। তার এই ঘটনার জন্য যদি আমরা কাউকে আগে ডেলিভারি দিয়ে দেই, তাহলে তো সবাইকে দিতে হবে। কারণ অনেকেরই এমন সমস্যা আছে। তিনি আসলে অর্ডার ক্যানসেল করে নাই। এমন ঘটনার জন্য আমরা তাকে বেশি গুরুত্ব দেবো, সেটার সুযোগ নেই। আজকে এমন ঘটনায় উনি পড়েছেন কাল তো আরও একজন এমন সমস্যায় পড়তে পারেন।’

বাইক অর্ডার করে বাড়িছাড়া হওয়া কে সেই যুবক?

ইভ্যালিতে বাইক অর্ডার করে ঘরবাড়ি ছাড়া হওয়া সেই যুবক জানান, তার নাম মিজানুর রহমান মিশু। গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জ জেলার বত্রিশ গ্রামে। তিনি পেশায় একজন মোবাইলের দোকানদার। তার একটি মোবাইল সার্ভিসিংয়ের দোকান আছে। সেই দোকানে কম্পিউটার থাকায় সেখান থেকে অনলাইনের অনেক কাজও করেন তিনি। আর অনলাইনের মাধ্যমেই জানতে পারেন ইভ্যালি সম্পর্কে। পরে ইভ্যালির ফেসবুক পেজের মাধ্যমে তাদের নানা অফারের আপডেট পেতেন তিনি।

যেভাবে বাইক অর্ডার করে বিপদে পড়েন

ঘটনার বর্ণনা দিয়ে দৈনিক আমাদের সময় অনলাইনকে মিজানুর রহমান বলেন, ‘আমরা কয়েক বন্ধু মিলে এক জায়গায় বসে ফেসবুক চালাচ্ছিলাম। হঠাৎ ফেসবুকে ইভ্যালির বাইকের একটা অফারের পোস্ট পেলাম। তখন আমি ও আমার পাশের বাড়ির এক বন্ধু মিলে বিষয়টি নিয়ে ভাবছিলাম। পরে সেই বন্ধু বলল যে আব্বা একটা বাইক কিনতে চাচ্ছে। বাইক কেনার জন্য কিছু টাকাও জোগাড় করেছে। আমি তখন ওই বন্ধুকে বললাম চল তাহলে কাকার সঙ্গে কথা বলি। এরপর আমরা কাকার সঙ্গে কথা বললাম। কাকা সব শুনে রাজি হয়ে আমাদের হাতে এক লাখ ৪৬ হাজার ৬০০ টাকা তুলে দিলো। টাকা দিয়ে আমাকে বলল, বাবা আমি কিন্তু অনলাইন বুঝি না। তুমিই সব বুঝবা। এরপর আমি ৩৫% ডিসকাউন্টে বাইকটা অর্ডার করি। আর তখন শনির দশা মনে হয় আমার কপালে ঝাঁপাইরা পড়ে।’

মিজানুর রহমান আরও বলেন, ‘বাইক অর্ডার করার কয়েক দিন পর তা প্রসেসিংয়ে যায়। মানে ১৩ অক্টোবর আমি জানতে পারি যে প্রসেসিংয়ে গেছে। অথচ ১৫ অক্টোবরের মধ্যে আমার বাইক ডেলিভারি পাওয়ার কথা ছিল। তারাই বলেছিল ১৫ দিনের মধ্যে ডেলিভারি পেয়ে যাব। কিন্তু ১৫ দিনের মধ্যে বাইক না পাওয়ায় গ্রামের ওই প্রতিবেশী কাকা আমাকে নিয়ে গ্রামে সালিস বসায়। সালিসে বসেই আমি ইভ্যালিতে কল দেই। তখন অ্যানি আপা নামে একজন কলটি ধরেন। তাকে সব কিছু খুলে বলায় তিনি জানান যে আরও ১৫ দিন সময় লাগবে। মানে ৩০ অক্টোবরের মধ্যে বাইকটি বুঝে পাবো। তখন সালিস থেকে আমাকে বলা হয়, ১৫ দিনের মধ্যে যদি আমি ওই কাকাকে বাইক দিতে না পারি তাহলে আমাকে টাকা ফেরত দিতে হবে।’

যেভাবে হয়েছিলেন বাড়িছাড়া

ভুক্তভোগী ওই যুবক বলেন, ‘ইভ্যালির বেঁধে দেওয়া সেই ১৫ দিনও গত ৩০ অক্টোবর শেষ হয়ে যায়। কিন্ত আমি বাইক বা টাকা কোনোটাই ফেরত পাচ্ছিলাম না। তখন আমি সেই কাকার ভয়ে বাড়ি যেতে পারতাম না। একটা ভুলের জন্য বাড়ি ছাড়া হয়েছিলাম। এলাকায় যেতে পারতাম না। বাইরে বাইরে থাকা খাওয়া অনেক কষ্টের ও কঠিন জীবনযাপন করেছি। আমি তাদের কাস্টমার কেয়ারে হাজার বার কল দিয়েছি। কিন্তু কেউই কোনো সাহায্য করেনি। সবাই শুধুমাত্র সামনের সপ্তাহ দেখিয়েছে।’

যেভাবে বাইক পেলেন সেই যুবক

ইভ্যালিতে বাইক অর্ডার করে এলাকাছাড়া  হওয়ার পরের দিনগুলো অনেক কষ্টে পার হচ্ছিল মিজানুর রহমানের। ইভ্যালিতে বার বার যোগাযোগ করেও যখন কোনো ফায়দা হচ্ছিলো না, তখন বাধ্য হয়ে ইভ্যালির একটি ফেসবুক রিভিউ গ্রুপে এই ঘটনাটি তুলে ধরে একটি পোস্ট দেন তিনি। সেখানে অনেকেই নানা ধরনের মন্তব্য করেন।

ওই যুবকের এই অভিযোগের বিষয়ে দৈনিক মুক্ত আওয়াজঅনলাইনের পক্ষ থেকে ইভ্যালির ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নজরে বিষয়টি আনা হয়। পাশাপাশি ওই যুবকও তার পরিচিতজনের মাধ্যমে ইভ্যালি কর্তৃপক্ষের কাছে ঘটনাটি জানান। এরপর তাকে ঢাকায় ডাকা হয় বাইক বুঝে নিতে।

মিজানুর রহমান বলেন, ‘তাদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে ঘটনাটি জানানোর পরেই আমাকে কাস্টমার কেয়ার থেকে ফোন দিয়ে তেজগাঁও টিভিএস শো রুম থেকে বাইকটি সংগ্রহ করতে বলা হয়। যদিও  নিয়ম অনুযায়ী বাইকটি আমার নিজস্ব ঠিকানায় ডেলিভারি দেওয়ার কথা ছিল। এরপর আমি ঢাকায় এসে দিনভর অপেক্ষা শেষে তেজগাঁও শো রুম থেকে বাইকটি বুঝে নেই।’

এমন অভিযোগ আরও আছে

ইভ্যালি থেকে বাইক অর্ডার করে হয়রানির শিকার হওয়া এবং রিফান্ডের টাকা ফেরত না পাওয়ার অভিযোগ তুলেছেন অনেকেই। ইভ্যালির ইন্সট্যান্ট হেল্প অ্যান্ড রিভিউ নামে একটি ফেসবুক গ্রুপে তোফায়েল আহমেদ  নামে এক ব্যক্তি অভিযোগ করেছেন, টাকা নেওয়ার ৩ মাস পেরিয়ে গেলেও তাকে বাইক দেয়নি ইভ্যালি।

পরে তোফায়েল আহমেদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি দৈনিক মুক্ত আওয়াজঅনলাইনকে বলেন, ‘আগস্টের ১৯ তারিখ টিভিএস এর একটি বাইক অর্ডার করেছিলাম, ৩ মাস হতে চলল। এখনো বাইক পাই নাই। ইভ্যালিতে কল দিলেই বলে সময় দেন দেখতেছি। আমার বাইক কুমিল্লায় আসার কথা থাকলেও কুমিল্লায় নাকি কালারের স্বল্পতার জন্য আমার বাইক দিতে পারতেছে না। নিজ উদ্যোগে টিভিএসের মাহাদি ভাইয়ের সাথে কথা বলি। তিনি জানান, বাইক রেডি আছে। ঢাকার  ইস্কাটনে এলে যে কোনো সময় বাইক পেয়ে যাব। পরে আমার উনার কথার ভিত্তিতে গত শনিবার আমি কুমিল্লা থেকে ইস্কাটন যাই। যাওয়ার পরই টিভিএসের মাহাদি লাপাত্তা, ফোনই পিক করে না। ইস্কাটনের ম্যানেজারও জানান, তিনি কিছু জানেন না। পরে ইভ্যালির কাস্টমার কেয়ারে অনেকবার ফোন দেওয়ার পর ইভ্যালির মাহাদি ভাই আমার সঙ্গে কথা বলেন। তিনি আমাকে জানান, আমার অর্ডার অনুযায়ী কালো রঙের বাইক গতকাল পর্যন্ত স্টকে অ্যাভেইলেবল নাই। এরপর রবিবার আমাকে আপডেট জানানোর কথা। কিন্তু সারা দিন কেউই ফোন ধরছিল না। বিকেলে আমাকে ফোন করে জানানো হয়, সোমবারের মধ্যে তারা একটা সমাধান দেবে।’

তাহমিদ পুলক নামের আরেক যুবক গত ১২ নভেম্বর ইভ্যালির ফেসবুক পেজে লিখেছেন, ‘ভাই, ২ মাসের বেশি হইলো বাইক অর্ডার দিলাম। এখনো দেওয়ার কোনো নাম নাই!’

অভিযোগ প্রমাণিত হলে ব্যবস্থা

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে  জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মো. আব্দুল জব্বার দৈনিক মুক্ত আওয়াজ অনলাইনকে বলেন, ‘এমন অফারের নামে কোনো ক্রেতা হয়রানি বা প্রতারণার শিকার হয়ে অভিযোগ দায়ের করলে এবং তদন্তে সেটি প্রমাণিত হলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

ই-ক্যাবের বক্তব্য

এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ই-ক্যাব) সাধারণ সম্পাদক আব্দুল ওয়াহেদ তমাল দৈনিক মুক্ত আওয়াজঅনলাইনকে বলেন, ‘আমরা সরাসরি এখনো কোনো ক্রেতার এমন অভিযোগ পাইনি। তবে ফেসবুক এবং অনলাইনের মাধ্যমে ইভ্যালির কিছু সমস্যার বিষয় আমাদের নজরে এসেছিল। আমরা সেগুলো ইভ্যালিকে জানিয়েছি। তারা সেটার ব্যবস্থা নিয়েছে।’

আব্দুল ওয়াহেদ আরও বলেন, ‘ইভ্যালি বা অন্য অনলাইন শপগুলো আসলে অন্যের পণ্য বিক্রি করে থাকে। আবার সেই পণ্যগুলো ডেলিভারি দিতে বিভিন্ন কুরিয়ার কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে হয়। তাই এখানে ভুল ত্রুটিগুলো কার, সেটা সঠিকভাবে দেখাতে হবে। আর কোনো ভোক্তা যদি এমন প্রতারণা বা হয়রানির শিকার হয় তবে তারা ভোক্তা অধিকারে অভিযোগ করতে পারেন। তারা বিষয়টি আমলে নিয়ে দোষ কার সেটি সঠিকভাবে তদন্ত করেন।’

দেশের এমন অনলাইন শপের পণ্য কেনা-বেচার জন্য সরকারের একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালা তৈরি করা প্রয়োজন বলেও মন্তব্য করেন ই-ক্যাবের সাধারণ সম্পাদক।

ইভ্যালির বক্তব্য      

এই বিষয়ে ইভ্যালির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মোহাম্মদ রাসেল দৈনিক মুক্ত আওয়াজ অনলাইনকে বলেন, ‘আমাদের একটা প্রতিশ্রুতি থাকে যে ১৫ দিনের মধ্যে আমরা একটি পণ্য ডেলিভারি দিয়ে দেব। ডেলিভারির এই সময়টা আমরা নরমালই বিক্রি করার জন্যই দিয়ে থাকি। কিন্তু যখন কোনো অফার হয় তখন সাধারণ অর্ডারের চেয়ে বহুগুণ বেশি অর্ডার হয়। কারণ তারাও একটু কম মূল্যে পণ্যটি পায় ও ভালো একটা ডিসকাউন্ট পায়। একইসঙ্গে আমরাও এক সাথে অনেক বেশি বিক্রি করতে পারি। এই সময়টায় অনেক সুবিধার কারণেই আমাদের ভল্যিউম হাই হয়ে যায়। তখন ডেলিভারির ক্ষেত্রে কিছুটা সমস্যা হয়।

Comment here

Facebook Share