নিজস্ব প্রতিবেদক : বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার দেহ থেকে অপারেশনের মাধ্যমে সন্দেহজনক ‘ম্যালিগন্যান্ট’ ল্যাম্প অপসারণ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন তার সাবেক প্রেসসচিব মারুফ কামাল সোহেল। আজ সোমবার রাতে নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে দেওয়া এক পোস্টে এ কথা জানান তিনি।
পোস্টে খালেদা জিয়ার চিকিৎসা নিয়ে লুকোচুরির অভিযোগ তুলে তিনি লেখেন, ‘সবাই না জানলেও বেমালুম বুঝতে পাচ্ছে, তিনি ভালো নেই। তাঁর দেহ থেকে ‘ম্যালিগন্যান্ট’ বলে সন্দেহভাজন লাম্প অপারেশন করে অপসারণ করা হয়েছে। এটা খুবই গুরুতর ব্যাপার। এই সার্জারির সিদ্ধান্ত হুট করে একদিনে নেয়া হয়নি। কিন্তু তা গোপন রাখা হয়েছিল। অপারেশনের পরেও সবকিছু স্বাভাবিক ও খুব হালকা করে দেখানো হচ্ছে। এর পেছনে কী যুক্তি আমার মাথায় আসে না।’
খালেদা জিয়ার সাবেক এই প্রেস সচিব আরও লেখেন, ‘ম্যাডামের ব্যাপারে উনার অসংখ্য অনুসারীর মতন অন্ধকারে ও দূরে থেকে আমি আজ বেদনার্ত কণ্ঠে আবারও সেই বাক্যটি উচ্চারণ করতে চাই, বেগম খালেদা জিয়া কিন্তু এখনো অগণিত নেতা-কর্মীসহ কোটি কোটি মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার উৎস। কাজেই উনার যে-কোনো ব্যাপার লুকিয়ে চুরিয়ে, গোপন করে, কুক্ষিগত করে রাখার চিন্তা ছাড়ুন।’
বিএনপির নীতি-নির্ধারকদের উদ্দেশে তিনি লেখেন, ‘যারা সিদ্ধান্ত নেওয়ার মালিক তাদের প্রতি আমার সবিনয় নিবেদন পর্দার অন্তরালে রেখে উনাকে বিস্মৃতি ও অকার্যকারিতার দিকে ঠেলে দেবেন না দয়া করে। ম্যাডামের শারীরিক অবস্থা অসংখ্য মানুষের উদ্বেগের বিষয়। তাই স্বচ্ছতার সঙ্গে সবকিছু রাখুন পাদ প্রদীপের আলোয়। কেবল নিজেরা ইতিহাসের দায় না নিয়ে ম্যাডামের স্বাস্থ্যের ব্যাপারে দায়িত্বশীলদের দিয়ে নিয়মিত বুলেটিন প্রচারের ব্যবস্থা রাখুন। বর্তমান পরিস্থিতিতে বেদনার্ত হওয়া ও দোয়া করা ছাড়া আমার তেমন কিছু করার নেই। সেই সাথে সকলের কাছে মিনতি করি উনার জন্য অন্তরের সকল আকুতি ঢেলে প্রার্থনা করার।’
এদিকে, বিকেলে এক সংবাদ সম্মেলনে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জানান, রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে ছোট একটি অস্ত্রপচারের পর বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া সুস্থ ও বিপদমুক্ত রয়েছেন। মির্জা ফখরুল বলেন, ‘অপারেশনের পর খালেদা জিয়া সুস্থ আছেন। তিনি বড় ছেলে তারেক রহমান এবং ছোট ভাইয়ের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করেছেন। এ ছাড়া চিকিৎসকরাও বলেছেন, এখন তার বিপদের সম্ভাবনা নেই।’ সংবাদ সম্মেলনে খালেদা জিয়ার চিকিৎসক দলের সদস্য এজেডএম জাহিদ হোসেনসহ দলের নেতাকর্মীরা উপস্থিত ছিলেন।
এ সময় চিকিৎসক জাহিদ হোসেন বলেন, ‘উনার শরীরের এক জায়গা ছোট একটা লাম্প আছে। যেহেতু পরীক্ষা করা প্রয়োজন। এই লাম্পের ন্যাচার অব অরিজিন জানতে হলে বায়োপসি করা প্রয়োজন। সেজন্য আজকে উনার সেই ছোট একটা বায়োপসি করতে উনাকে ওটিতে (অপারেশন থিয়েটার) নেওয়া হয়। উনি সুস্থ আছেন।’ খালেদা জিয়ার চিকিৎসক দলের এই সদস্য আরও বলেন, ‘বায়োপসি পরবর্তীতে খালেদা জিয়ার সমস্ত প্যারামিটারগুলো এই মুহূর্তে স্টেবল আছে। উনি সার্জিক্যাল আইসিইউতে চিকিৎসাধীন আছেন। আপনারা সবাই দোয়া করবেন।’
এক প্রশ্নের জবাবে জাহিদ হোসেন বলেন, ‘বায়োপসি মানে চিকিৎসা না। বায়োপসি মানে হচ্ছে ডায়োগনিস্টিক প্রক্রিয়ার একটি অংশ এবং এই প্রক্রিয়া পরবর্তীতে কী চিকিৎসা হবে সেই পরীক্ষার ওপর ভিত্তি করে নির্ধারিত হবে। উনার বয়স ৭৬ বছর। উনার আরও যেসব জটিলতা আছে সেগুলো মাথায় রেখে সুচিকিৎসা নিশ্চিত করার জন্য একটা ডেডিকেটেড ডেভেলপড সেন্টার প্রয়োজন রয়েছে বলে এভারকেয়ার হাসপাতালের মেডিকেল বোর্ড প্রাথমিকভাবে মতামত দিয়েছে।’ বায়োপসির প্রতিবেদন কবে নাগাদ পাওয়া যায় জানতে চাইলে অধ্যাপক জাহিদ বলেন, ‘বায়োপসির রেজাল্ট পেতে সায়েন্টিফিক্যালি ৭২ ঘন্টা, কোনো কোনো ক্ষেত্রে ১৫ দিন থেকে ২১ দিন সময় লাগে যুক্তরাষ্ট্রের মতো জায়গায়। কাজেই এর রেজাল্টের জন্য অপেক্ষা করতে হবে।’
সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘চিকিৎসকরা বার বার বলে আসছেন, তার (খালেদা জিয়া) যে মাল্টি ডিসিপ্লেনারি ডিজিস আছে এগুলোর পরিপূর্ণ চিকিৎসা এখানে করানোর কোনো অ্যান্ডভান্স সেন্টার নেই। এজন্য তার পরিবারের পক্ষ থেকে দেশের বাইরে নিয়ে যাওয়ার জন্য আবেদন করা হয়েছিল। দুর্ভাগ্য আমাদের যে এমন একটা দেশে বাস করি, সাবেক প্রধানমন্ত্রী তার সাধারণ মানুষের মতো চিকিৎসা পাওয়ার অধিকার আছে- এই অধিকারটুকু সরকার স্বীকার করেনি। তাকে বাইরে যাওয়ার অনুমতি দেয়নি।’
সোমবার দুপুর পৌনে ১টায় বিএনপির চেয়ারপারসনকে এভারকেয়ার হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটারে নেওয়া হয়। তিনি দীর্ঘদিন ধরে আর্থারাইটিস, ডায়াবেটিস, দাঁত ও চোখের সমস্যাসহ নানা জটিলতায় ভুগছেন। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে দেখতে গতকাল রোববার যুক্তরাজ্য থেকে দেশে আসেন তার প্রয়াত ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর স্ত্রী শর্মিলা রহমান। বিমানবন্দর থেকে তিনি সরাসরি রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে যান।
জানা যায়, দুপুর সাড়ে ১২টার পর ১০ তলার কেবিন ব্লক থেকে খালেদা জিয়াকে তিন তলার অস্ত্রোপচার কক্ষে নিয়ে আসা হয়। এ সময় মহাসচিব মির্জা ফখরুল ছাড়াও কোকোর স্ত্রী শর্মিলা রহমান, ব্যক্তিগত চিকিৎসক ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন উপস্থিত ছিলেন। গত ১২ অক্টোবর হাসপাতালে ভর্তি হন খালেদা জিয়া। সপ্তাহখানেক বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে খালেদা জিয়াকে। তবে পরিবার বা দলের পক্ষ থেকে খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্য পরিস্থিতি নিয়ে এতদিন কেউ কথা বলেননি। এবার তার চিকিৎসাকে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক বিষয়ের মধ্যে রাখা হচ্ছে বলে একাধিক নেতা বলেছেন।
গত এপ্রিল মাসে করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হন খালেদা জিয়া। বাসায় চিকিৎসা নিয়ে করোনা থেকে সেরে উঠলেও শারীরিক জটিলতা দেখা দেওয়ায় ২৭ এপ্রিল তাকে এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। একপর্যায়ে শ্বাসকষ্ট দেখা দিলে তাকে করোনারি কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) নেওয়া হয়। প্রায় দুই মাস তিনি সিসিইউতে ছিলেন। ১৯ জুন তিনি বাসায় ফেরেন। উল্লেখ্য, দুর্নীতির মামলায় কারাদণ্ড হলে ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়াকে কারাগারে পাঠানো হয়। এরপর ২০২০ সালের ২৫ মার্চ এক নির্বাহী আদেশে দণ্ড স্থগিত করে তাকে কারাগার থেকে সাময়িক মুক্তি দেওয়া হয়। পরে আরো তিনবার তার মুক্তির মেয়াদ বাড়ায় সরকার।
Comment here