হামিদ উল্লাহ চট্টগ্রাম : চট্টগ্রামের একটি বড় শিল্প ও বাণিজ্যিক এলাকার চাঁদাবাজি এবং আন্ডারওয়ার্ল্ডের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে এক দশক ধরে যুবলীগের সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলেছে জামায়াত-শিবির ক্যাডাররা। পুলিশের ধরপাকড়ের মুখে দলবেঁধে বিদেশে পালিয়ে গেলেও তাদের চাঁদাবাজি কখনো বন্ধ হয়নি। জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশকে এসব তথ্য দিয়েছেন ঢাকা বিমানবন্দরে ধরা পড়া বিদেশ ফেরত শিবির ক্যাডার মো. সরোয়ার ওরফে বাবলা।
পাশাপাশি তিনি পুলিশকে জানিয়েছেন-পালিয়ে যাওয়া সব ক্যাডারই ইতোমধ্যে ভারত হয়ে বাংলাদেশে ফিরে এসেছেন। আর এমন খবরে রীতিমতো নড়েচড়ে বসেছে পুলিশ প্রশাসন। প্রশ্ন উঠেছে-পুলিশের নজরদারি এড়িয়ে কীভাবে দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসীরা দেশে ফিরলো। কীভাবে বছরের পর বছর তারা চাঁদাবাজি অব্যাহত রেখেছে।
চট্টগ্রামে ২০০০ সালের নৃশংসতম এইট মার্ডার মামলার প্রধান আসামি সাজ্জাদ খানের সহযোগী নুর নবী ওরফে ম্যাক্সন, মো. সরোয়ার, ফিরোজ, একরাম, মাহিন ও গিট্টু মানিক দীর্ঘদিন ধরে পাঁচলাইশ, চালিতাতলী, মুরাদপুরের কাটা গাড়ির মার্কেট ও অক্সিজেন এলাকায় চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করতো। ওই আন্ডারওয়ার্ল্ডে যুক্ত হতে বায়েজিদ এলাকার যুবলীগ নেতা দিদারুল আলম নিজ দলে ভেড়ান ফিরোজ ও একরামকে। এভাবে দিদারও চাঁদাবাজির সঙ্গে যুক্ত হন।
পুলিশ ও আদালত সূত্র জানায়, বিভিন্ন থানায় তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী ম্যাক্সনের বিরুদ্ধে ১১টি ও সরোয়ারের ৮টি এবং গিট্টু মানিকের বিরুদ্ধে ৬টি মামলা রয়েছে।
গত ৮ জানুয়ারি কাতার থেকে দেশে ফেরার পথে ঢাকা শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পুলিশের হাতে ধরা পড়েন শিবির ক্যাডার সরোয়ার। পরদিন পুলিশ তাকে চট্টগ্রামে তার বাড়িতে নিয়ে যায়। সেখানে তার দেখিয়ে দেওয়া জায়গা থেকে দেশি-বিদেশি তিনটি অস্ত্র ও গুলি উদ্ধার করে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে সরোয়ার পুলিশকে জানিয়েছেন, কাতারে পালিয়ে থাকা নুর নবী ম্যাক্সন ও একরাম এবং ভারত থেকে সাজ্জাদ খান সীমানা পার হয়ে বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশে ঢুকে পড়েছেন। তারা এখন দেশেই আছেন।
জানতে চাইলে চট্টগ্রামের পুলিশ কমিশনার মো. মাহাবুবর রহমান আমাদের সময়কে বলেন, আমরা শুনেছি। আমরা সতর্ক আছি। বাকি সব দেখা যাক।
এ দিকে গত বছরের ২৫ অক্টোবর বায়েজিদ থানা পুলিশ চাঁদাবাজির অভিযোগে ওয়াজেদিয়া এলাকা থেকে ছাত্রশিবিরের পাঁচ ক্যাডারকে অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার করে। বায়েজিদ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রিটন সরকার জানান, গ্রেপ্তারের পর তারা বলেছিলেন, সেইসময় কাতারে অবস্থান করা শিবির ক্যাডার নুর নবী ম্যাক্সন, মো. সরোয়ার ও যুবলীগ ক্যাডার একরামের কাছে টাকা পাঠানোর জন্য তারা বিভিন্ন স্থানে চাঁদাবাজি করছিলেন।
পুলিশ সূত্র জানায়, ২০০০ সালে নগরীর বহদ্দারহাটে ছাত্রলীগের আট নেতাকে ব্রাশফায়ারে হত্যা মামলার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি সাজ্জাদ খানকে পুলিশ ২০০১ সালে একে-৪৭সহ গ্রেপ্তার করে। তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত সরকারের আমলে ২০০৪ সালে সাজ্জাদ খান জামিন পান। আবার গ্রেপ্তার এড়াতে জেলগেট থেকে জামায়াতের তৎকালীন সংসদ সদস্য আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহেরের গাড়িতে করে কারাগার থেকে বের হন তিনি। এরপর ভারতে পালিয়ে যান।
সাজ্জাদের অনুপস্থিতিতে শিবির ক্যাডার নুর নবী ম্যাক্সন, মো. সরোয়ার, মাহিন, ফিরোজ ও একরাম তার আন্ডারওয়ার্ল্ডের নিয়ন্ত্রণ নেন। এর মধ্যে বায়েজিদ এলাকার যুবলীগ নেতা দিদারুল আলমের মাধ্যমে যুবলীগের কিছু নেতার সঙ্গে সখ্য গড়ে ম্যাক্সন ও সরোয়ার। ২০১১ সালের ৬ জুলাই বায়েজিদ থানার তৎকালীন ওসি একেএম মহিউদ্দিনের নেতৃত্বে পুলিশ একে-৪৭ রাইফেল ও গুলিসহ ম্যাক্সন, সরোয়ার ও গিট্টু মানিককে গ্রেপ্তার করে। ২০১৬ সালের ৩১ আগস্ট চট্টগ্রামের একটি আদালত ম্যাক্সন, সরোয়ার ও গিট্টু মানিককে অস্ত্র মামলায় ২১ বছর করে সশ্রম কারাদণ্ড দেন।
অন্যদিকে ফিরোজ ২০১১ সালে বায়েজিদ থানা পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন। জামিনে বের হয়ে একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ডাকাতির ঘটনায় ২০১৩ সালে পাঁচলাইশ থানা পুলিশ আবার তাকে গ্রেপ্তার করে। বর্তমানে জামিনে বের হয়ে পলাতক আছেন ফিরোজ। আর জামিনে বের হয়ে কাতার পালিয়ে যান ম্যাক্সন ও সরোয়ার ২০১৭ সালে।
এ দিকে নগরীতে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের ছাত্রী তাসফিয়া হত্যা মামলার এজাহারে নাম উঠে কথিত যুবলীগ ক্যাডার একরামের। তিনিও কাতারে পালিয়ে যান। সেখানে এক হয়ে ম্যাক্সন, সরোয়ার ও একরাম শুরু করেন চাঁদাবাজির কাতারপর্ব। গত বছরের শেষ দিকে নিজেদের মধ্যে মারামারির কারণে তিনজনকেই গ্রেপ্তার করে কাতার পুলিশ।
পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার সরোয়ারের তথ্য অনুযায়ী, জামিনে বের হয়ে ম্যাক্সন ও একরাম ভারত হয়ে স্থলসীমান্ত ব্যবহার করে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছেন।
Comment here