সারাদেশ

জব্দ গাড়ি নিয়ে ইয়াবা কারবারে কনস্টেবল

ইউসুফ সোহেল : ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি-পূর্ব) খিলগাঁও জোনাল টিমে দীর্ঘদিন ধরে গাড়িচালক হিসেবে কাজ করছেন ফেরদৌস হোসেন। তার কনস্টেবল নম্বর ১৬৯৪২। সহকর্মীদের সঙ্গে অভিযানে অংশ নিয়ে বিভিন্ন সময় পাকড়াও করেছেন অপরাধী, চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ী। এখন তার হাতেই পড়েছে হাতকড়া। অভিযোগ, ফেরদৌস নিজেই জড়িত মাদক কারবারসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে।

গাড়িতে করে মাদক বিক্রি করতে গিয়ে গত ১৪ জুলাই সকালে পুলিশের হাতেই ধরা পড়েন ফেরদৌস। পল্টনের রাজারবাগ-মধুমিতা অফিসার্স কোয়ার্টারের বিপরীত পাশের রাস্তা থেকে ১৯৬ পিস ইয়াবা ট্যাবলেট ও ১৭ বোতল ফেনসিডিলসহ তাকে গ্রেপ্তার করে পল্টন থানা পুলিশ। এ ঘটনায় অভিযানের নেতৃত্বদানকারী কর্মকর্তা বাদী হয়ে কনস্টেবল ফেরদৌস ও তার এক মাদকের কাস্টমারের (ইভান হোসেন) বিরুদ্ধে পল্টন থানায় মামলা করেন।

জানা গেছে, যে গাড়ি (সিলভার রঙের এক্স করোলা প্রাইভেটকার। নম্বর ঢাকা মেট্রো-গ২৭৩১৫১) থেকে মাদকগুলো জব্দ করা হয় সেই গাড়িটি ছিল পুলিশের অন্য একটি মামলায় জব্দকৃত! দীর্ঘদিন এই গাড়ি ব্যবহার করেই ফেরদৌস চালিয়ে আসছিলেন মাদকের কারবার। ফেরদৌস গ্রেপ্তারের পরদিনই প্রাইভেটকারটি চুরির অভিযোগ এনে তার বিরুদ্ধে মামলা করেছেন ডিবির খিলগাঁও জোনাল টিমের এক সদস্য।

গোয়েন্দা পুলিশের ডিবির খিলগাঁও জোনাল টিমের এডিসি সাহিদুর রহমান বলেন, কনস্টেবল ফেরদৌস এ টিমেই গাড়িচালক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে জব্দকৃত গাড়িটি কীভাবে তিনি বের করে নিয়ে গেলেন তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। মাদকসহ গ্রেপ্তারের পরদিনই তার বিরুদ্ধে গাড়ি চুরির অভিযোগে মামলা দায়ের করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।

এদিকে মাদক মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পল্টন থানার এসআই এনামুল হক আদালতে অভিযুক্ত কনস্টেবলের ৫ দিনের রিমান্ড চেয়ে তাকে ৪ দিন জিজ্ঞাসাদের অনুমতি পান। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে গত সোমবার তাকে আদালতে পাঠান তিনি।

জানা গেছে, সোর্স ও পুলিশের বরখাস্ত সদস্যদের নিয়ে ডিবির এক এডিসির গাড়িচালক কনস্টেবল ফেরদৌস গড়ে তুলেছিলেন শক্তিশালী সিন্ডিকেট। কী দিন, কী রাত ‘পুলিশ’ লেখা স্টিকার সংবলিত গাড়িতে কথিত অভিযানে বেরিয়ে পড়তেন সিন্ডিকেটের সদস্যদের নিয়ে। দাপিয়ে বেড়াতেন খিলগাঁও, রামপুরা, সবুজবাগ, পল্টন, মতিঝিল, শাহাবাগসহ কয়েকটি থানা এলাকা। কনস্টেবল হলেও অভিযানে পরিচয় গোপন করে কেউ বনে যেতেন ‘ইন্সপেক্টর’, কেউ হয়ে যেতেন ‘এসআই’ ও ‘এএসআই’। ভয়ভীতি দেখিয়ে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে তারা হাতিয়ে নিতেন টাকা। ঘুরে ঘুরে মাদক কারবারিদের কাছে সরবরাহ করতেন ইয়াবা-ফেনসিডিলসহ বিভিন্ন মাদকদ্রব্য। কিন্তু রহস্যজনক কারণে কনস্টেবল ফেরদৌস ছিলেন অধরা। বেপরোয়া। ইয়াবা-ফেনসিডিল না কিনেও কীভাবে তিনি বিশাল এই মাদকের চালান পেতেন তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।

ফেরদৌসের বিরুদ্ধে দায়ের করা মাদক মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়, ইয়াবা বেচাকেনা হচ্ছে এমন খবরে ১৪ জুলাই সকাল সাড়ে ৯টার দিকে শান্তিনগর পীর সাহেবের গলিতে অভিযান চালায় পল্টন থানার এসআই সোমেন কুমার বড়–য়া ও তার টিমের সদস্যরা। পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে পালানোর সময় ইভান হোসেন নবাব নামে এক মাদক ব্যবসায়ীকে ১৯ পিস ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার করা হয়। জব্দ করা হয় মাদক বহনে ব্যবহৃত তার সিলভার রঙের এক্স করলা প্রাইভেটকার।

ইয়াবা প্রাপ্তির উৎস ও তার সহযোগী মাদক ব্যবসায়ীদের বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদে নবাব জানান, দীর্ঘদিন ধরে ডিবির কনস্টেবল ফেরদৌস হোসেনের কাছ থেকে ইয়াবা ট্যাবলেট কিনে পল্টন থানাসহ আশপাশ থানা এলাকায় বিক্রি করছেন তিনি। নবাবের তথ্যের ভিত্তিতে সকাল সোয়া ১০টার দিকে মধুমিতা অফিসার্স কোয়ার্টারের বিপরীত পাশের রাস্তা থেকে কনস্টেবল ফেরদৌসকে সিলভার রঙের এক্স করোলা প্রাইভেটকারসহ আটক করা হয়। তল্লাশি চালিয়ে জব্দ করা হয় ১৯৬ পিস ইয়াবা ও ১৭ বোতল ফেনসিডিল। পরবর্তীতে পুলিশ জানাতে পারে ফেরদৌস ঢাকা মহানগর পুলিশের রাজারবাগ পরিবহন শাখা থেকে প্রেষণে ডিবির খিলগাঁও জোনাল টিমে নিয়োজিত। পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদে ফেরদৌস মাদক কারবারে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে বলেন, দীর্ঘদিন ধরে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ইয়াবার চালান সরবরাহ করে আসছিলেন তিনি ও নবাব।

মামলার বাদী এসআই সোমেন বড়ুয়া গতকাল আমাদের সময়কে বলেন, সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে ওই দুজনকে মাদকসহ গ্রেপ্তার করা হয়। তারা যে দীর্ঘদিন ধরে মাদক কারবারে জড়িত তার তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে। পুলিশ কনস্টেবলের কাছ থেকে জব্দকৃত গাড়িটি আগে থেকেই কোনো মামলায় ডিবি পুলিশের কাছে জব্দ ছিল কিনা এমন প্রশ্নে কোনো মন্তব্য করতে অপারগতা প্রকাশ করে সোমেন বড়–য়া বলেন, বিষয়টি তদন্ত কর্মকর্তাই ভালো বলতে পারবেন।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই এনামুল হক বলেন, চার দিনের রিমান্ড শেষে গত সোমবার আসামিকে আদালতে পাঠানো হয়েছে। রিমান্ডে এই মাদক সিন্ডিকেটের বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য মিলেছে। তবে তদন্তের স্বার্থে এর বেশি বলা যাচ্ছে না। জব্দকৃত গাড়িটি আদৌও কোনো মামলায় জব্দ হিসেবে তালিকায় উল্লেখ ছিল কিনা তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। গাড়িটির বিষয়ে যাচাই করতে বিআরটিএতে চিঠি পাঠানো হয়েছে। চিঠির উত্তর পেলে এ বিষয়ে জানা যাবে।

Comment here

Facebook Share