জেলার বাস ঢুকতে পারবে না ঢাকায় - দৈনিক মুক্ত আওয়াজ
My title
সারাদেশ

জেলার বাস ঢুকতে পারবে না ঢাকায়

সানাউল হক সানী : রাজধানী ঢাকার গণপরিবহনে শৃঙ্খলা ফেরাতে পুরো পরিবহনব্যবস্থা ঢেলে সাজানো হচ্ছে। এ লক্ষ্যে গঠিত বাসরুট রেশনালাইজেশন কমিটি প্রায় দুবছর ধরে কাজ করছে। সম্প্রতি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান কমিটির কাছে সমীক্ষা রিপোর্ট পেশ করেছে। এতে বলা হয় বাসভাড়া নিয়ে নৈরাজ্য ঠেকাতে গণপরিবহনে স্মার্টকার্ডের মাধ্যমে ভাড়া পরিশোধের নিয়ম চালু করতে হবে। বিভিন্ন জেলা শহর থেকে আসা বাসগুলো রাজধানীতে প্রবেশের ক্ষেত্রে থাকবে নিষেধাজ্ঞা। রাজধানীর আশপাশে গড়ে তোলা হবে ১০টি টার্মিনাল। ২৯১ রুটের পরিবর্তে ৪২টি রুটে ২২টি কোম্পানির মাধ্যমে গণপরিবহন ব্যবস্থাপনার সুপারিশ করা হয়। নগরীতে চলাচলরত আড়াই হাজার কোম্পানির প্রায় ৩০ হাজার পরিবহনের পরিবর্তে ৯ হাজার ২৭টি গণপরিবহন পরিচালনার প্রস্তাব করা হয়েছে।

ঢাকা মহানগরীর যানজট নিরসনে বাসরুট রেশনালাইজেশন ও কোম্পানির মাধ্যমে বাস পরিচালনা পদ্ধতি প্রবর্তনের বিষয়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রয়াত মেয়র আনিসুল হক বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। সে আলোকে বাসরুট রেশনালাইজেশন করার জন্য ২০১৮ সালে ১০ সদস্যের কমিটি করে দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ওই কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন তৎকালীন দক্ষিণ সিটির মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন। বর্তমানে কমিটির আহ্বায়ক রয়েছেন দক্ষিণ সিটির মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস। রেশনালাইজেশন কমিটি ওই সময় বাস্তবতা সমীক্ষা করে প্রতিবেদন দিতে পরামর্শক নিয়োগ করেন। দীর্ঘ দুবছরের বেশি সময় ধরে সমীক্ষা করে কমিটি গত ১০ নভেম্বর প্রতিবেদন জমা দেয়।

২০১৭ সালের হিসাব অনুযায়ী বর্তমানে নগরীতে নিবন্ধিত বাসের সংখ্যা ৩০ হাজার ২৭৪টি। এর পর গত তিন বছরে আরও কিছু বাস রাজধানীতে যাত্রীসেবায় যুক্ত হয়েছে। এ অবস্থায় বিদ্যমান বাসগুলোর মূল্যায়নের মাধ্যমে কোম্পানিগুলোয় মালিকানার ভাগ নির্ধারণ করা হবে। এসব বাস ও মিনিবাস ক্রপ করা হলে সেগুলোর জন্য সরকার ক্ষতিপূরণ দেবে। এ ছাড়া নতুন বাস সংগ্রহের জন্য ৪-৫ শতাংশ সুদে ঋণ দেওয়ারও সুপারিশ করা হয়।

পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের সুপারিশ অনুযায়ী অতিরিক্ত ভাড়া বিড়ম্বনা ঠেকাতে স্মার্টকার্ডের মাধ্যমে বাসগুলোয় টিকিটিং সিস্টেম করা হবে। পাশাপাশি ভাড়া নীতিও প্রণয়ন করা হবে। এতে ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে ভাড়া আদায়ের সিস্টেম থাকবে না। ফলে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় বা যাত্রীদের সঙ্গে হেলপারদের বাগবিতণ্ডা হবে না।

বর্তমানে দুই সিটি করপোরেশন এলাকায় মাত্র তিনটি বাস টার্মিনাল রয়েছে। এগুলো হচ্ছে মহাখালী, সায়েদাবাদ ও গাবতলী। এর মধ্যে ৯ একর আয়তনের মহাখালী বাস টার্মিনালে ৫০০টি বাসের ধারণ ক্ষমতা থাকলেও তাতে প্রতিদিন ২ হাজার ৭৪৪টি বাস প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়। ১৩ একর আয়তনের সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালে ৩০০টি বাসের ধারণক্ষমতা থাকলেও তাতে চার হাজার ২০৯টি বাস প্রবেশের অনুমতি রয়েছে। আর ৩৯ একর আয়তনবিশিষ্ট গাবতলী বাস টার্মিনালে ৭০০টি বাস রাখার ধারণ ক্ষমতা থাকলেও তাতে প্রতিদিন দুই হাজার ৩৪৫টি বাস রাখা হচ্ছে।

সব মিলিয়ে রাজধানীতে অবস্থিত ৩টি টার্মিনালে দেড় হাজার বাসের ধারণ ক্ষমতা রয়েছে। কিন্তু তাতে প্রতিদিন ৯ হাজার ২৯৮টি বাস রাখা হয়। বাকি বাসগুলো নগরীর বিভিন্ন সড়কেই পার্কিং করা হয়। ফলে যানজট লেগেই থাকে। এ অবস্থায় নতুন করে ১০টি টার্মিনালের প্রস্তাব করা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে কেরানীগঞ্জের বাঘৈর (৩৩.৬৩ একর), হেমায়েতপুর (৩৬.৫০ একর), উত্তরার বিরুলিয়া (১৪.৫৩ একর), গাজীপুর (১১.৭০ একর), নবীনগর চন্দ্রা রোডের বাইপাইল (৪০.৪০ একর), কাঞ্চন এলাকা (২৪.২৪ একর), কাঁচপুর উত্তর (১৫.৪৬ একর), কাঁচপুর দক্ষিণ মদন (২৭.৭১ একর) আটিবাজারের ভাওয়াল (২৫.৭৮ একর) এবং ভুলতা (২৪.২২ একর)।

প্রস্তাবনায় বলা হয়, বর্তমানে প্রায় আড়াই হাজার কোম্পানির পরিবর্তে মাত্র ২২টি কোম্পানির মাধ্যমে ৯ হাজার ২৭টি বাস পরিচালিত হবে। এর মধ্যে ছয় হাজার ৪৫৭টি বাস ও ২ হাজার ২৭০টি মিনি বাস থাকবে। তার মধ্যে ৩ হাজার ৭৬১টি সম্পূর্ণ নুতন বাস রাখা হবে। এসব কোম্পানিতে গণপরিবহন মালিকরা শেয়ারহোল্ডার হিসেবে থাকবেন। সঠিকভাবে পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রতিটি কোম্পানিতে ৫০০টির কম গণপরিবহন রাখা হবে। এ কোম্পানিগুলোকে আইনের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণের জন্য কর্তৃপক্ষ গঠনের সুপারিশ করা হয়েছে। কোম্পানিগুলোর মধ্যে পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়ের ভারসাম্য রক্ষা করা হবে। ৫ বছরের বেশি সময়ের বাস রাখা হবে না।

বর্তমানে রাজধানীতে ২৯১টি রুটে গণপরিবহন পরিচালিত হচ্ছে। নানা রঙের পরিবহনের মধ্যে এসব রুটের গণপরিবহন বেছে নেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। এতে নগরীর সড়কগুলোয় বিশৃঙ্খলা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। ফলে যানজটসহ কোম্পানিগুলোর মধ্যে যাত্রী তোলার জন্য প্রতিযোগিতা দেখা দেয়। তাতে ঘটছে দুর্ঘটনা। এ অবস্থায় নির্দিষ্ট ৬টি রঙের গণপরিবহন পরিচালনার পাশাপাশি নগরীতে রুটের সংখ্যা ৪২টিতে কমিয়ে আনার প্রস্তাব করা হয়েছে। বাসরুট রেশনালাইজেশনের জন্য জেলা পর্যায়ের কোনো বাস রাজধানীতে প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না। এ জন্য রাজধানীর প্রবেশমুখগুলোয় পর্যাপ্ত টার্মিনাল ও নিরাপদ এবং আরামদায়ক পরিবহন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হবে। আরবান এরিয়া, সাব-আরবান এরিয়া এবং ঢাকা চাকা এ তিনটি ক্লাস্টারিং করা হয়েছে। এটি রাজধানীর মধ্যে জেলা পর্যায়ের পরিবহন প্রবেশ কমিয়ে দেবে। ফলে যানজট হ্রাসের পাশাপাশি যানবাহনে গতিও বাড়বে।

আরবান ক্লাস্টার গোলাপি : এ রঙের ৮৮৩টি বাস পরিবহনগুলো ১ থেকে ৪নং রুটে চলাচল করবে। বর্তমানের ২৯১টি রুটের মধ্যে ২৩টি রুটকে ভেঙে এ চারটি রুট করা হয়েছে।

নীল রঙের এক হাজার ৪৩৩টি বাস চলবে ৫ থেকে ৮নং রুটে। পুরনো ২১টি রুট ভেঙে এ চারটি রুট করা হয়েছে।

মেরুন রঙের এক হাজার ১০৮টি বাস ৯ থেকে ১৩নং রুটে চলবে। পুরনো ৩৫টি রুট ভেঙে এ ৫টি রুট করা হয়েছে।

কমলা রঙের এক হাজার ১২২টি বাস ১৪ থেকে ২০নং রুটে চলবে। পুরনো ৪৭টি রুট ভেঙে এ সাতটি রুট করা হয়েছে।

সবুজ রঙের এক হাজার ৪৩৩টি বাস ২১ থেকে ২৮নং রুটে চলবে। পুরনো ৫৪টি রুট ভেঙে এই ৮টি রুট করা হয়েছে।

বেগুনি রঙের এক হাজার ৮৯টি বাস ২৯ থেকে ৩৪নং রুটে চলবে। পুরনো ৩৩টি রুট ভেঙে এ ছয়টি রুট করা হয়েছে।

নর্থ। এ অংশের এক হাজার ৮৯টি বাস ৩৫-৩৭নং রুটে চলবে। পুরনো ৪০টি রুট ভেঙে এ তিনটি রুট করা হয়েছে।

নর্থ-ওয়েস্ট। এ অংশে ৯৯২টি বাস ৩৮ থেকে ৪০নং রুটে চলাচল করবে। পুরনো ৩০টি রুট ভেঙে এই তিনটি রুট করা হয়েছে।

সাউথ। এ পরিবহনটি ৪১ ও ৪২নং রুটে চলবে। এতে পরিবহনের সংখ্যা থাকবে ৯৯টি। পুরনো ৫টি রুট ভেঙে এ দুটি রুট করা হয়েছে।

ঢাকা চাকা : এতে ৫২টি বাস চলবে। রুট হবে নতুন বাজার-পুলিশ প্লাজা। এ বাসগুলো বর্তমানেও একই রুটে চলছে।

এ বিষয়ে বাস রুট রেশনালাইজেশন কমিটির সভাপতি ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস বলেন, বাসরুট রেশনালাইজেশন কমিটির কাছে একটি প্রাথমিক রিপোর্ট ‘বাস সার্ভিস, রুট রিস্ট্রাকচারিং অ্যান্ড ক্লাসটারিং’ প্রদান করা হয়েছে। সেই রিপোর্ট আমরা পুঙ্খানুপুঙ্খ পর্যালোচনা করেছি। বর্তমানে ঢাকা শহরে ২৯১টি রুটে ২৫০০ বাস মালিকের বাস চলাচল করছে। সেগুলোকে সন্নিবেশ করে ৪২টি রুট এবং ২২টি কোম্পানি করার প্রাথমিক প্রস্তাবনা করা হয়েছে। এ প্রস্তাবনা বাস্তবায়ন হলে বর্তমান বাস মালিকরা কোম্পানিগুলোর শেয়ারহোল্ডার হবেন।

বাসরুট রেশনালাইজেশন বাস্তবায়নের মাধ্যমে আন্তঃজেলা বাসগুলোকে আর ঢাকা মহানগরের মধ্যে ঢুকতে দেওয়া হবে না জানিয়ে শেখ তাপস এ সময় বলেন, বাইরের বাসগুলো ঢাকা শহরের সীমান্তবর্তী এলাকায় নির্ধারিত আন্তঃজেলা বাস টার্মিনালে যাত্রী নামিয়ে তাদের নির্ধারিত গন্তব্যে চলে যাবে। তার পর সেসব টার্মিনাল থেকে সিটি সার্ভিস বা এমআরটি বা সেবা প্রদানকারী বাহনের মাধ্যমে যাত্রীরা নিজ গন্তব্যে যাতায়াত করবে। এতে করে ঢাকা শহরের ওপর গাড়ির চাপ কিছুটা হলেও কমবে। তিনি বলেন, কমিটির অংশীজন (কমিটির সদস্যরা) ডিটিসিএর সহযোগিতায় নিজেদের মধ্যে বসে এ প্রতিবেদনের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচার-বিশ্লেষণ করে প্রস্তাবিত ক্লাস্টার রুটগুলো আরও সুনির্দিষ্ট করবেন। সবার সহযোগিতায় এবং সমন্বয়ের মাধ্যমে ক্লাস্টার রুটগুলোকে চূড়ান্ত করতে পারলে তা এ কার্যক্রমে একটি বড় অগ্রগতি হবে বলে আমি মনে করি।

 

Comment here