ঝুঁকি এড়াতে কমিটিতে নেই পরিবর্তন - দৈনিক মুক্ত আওয়াজ
My title
রাজনীতি

ঝুঁকি এড়াতে কমিটিতে নেই পরিবর্তন

মুহম্মদ আকবর : দেশের অন্যতম প্রাচীন দল আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলনে প্রতিবারই কোনো না কোনো চমক থাকে। গত শনিবার দলের ২২তম সম্মেলনের মধ্য দিয়ে ৮১ সদস্যবিশিষ্ট কমিটির মধ্যে ৪৮ জনের নাম ঘোষণা হয়েছে। তাতে তেমন কোনো পরিবর্তন বা চমক নেই। আছে পদোন্নতি, অবনতি ও রদবদল।

সম্মেলনের দ্বিতীয় অধিবেশনে কাউন্সিলরদের মাধ্যমে দলের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হওয়ার পর আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা জানান, সামনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন, তাই এবারের সম্মেলনে তেমন পরিবর্তন করা হচ্ছে না। জানা গেছে, আগামী জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে কমিটির গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে নতুন কাউকে এনে ঝুঁকি তৈরি করতে চায়নি ক্ষমতাসীন দলটি।

এদিকে ৩৩টি শূন্য পদ পূরণের লক্ষ্যে জাতীয় সম্মেলনের দুদিনের মাথায় আজ সোমবার প্রথম সভায় বসছেন ক্ষমতাসীন দলটির সভাপতিম-লীর সদস্যরা। সন্ধ্যা ৭টায় প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে এ সভা অনুষ্ঠিত হবে। এতে সভাপতিত্ব করবেন দশমবারের মতো নির্বাচিত দলের সভাপতি শেখ হাসিনা। সঞ্চালনা করবেন তৃতীয়বারের মতো নির্বাচিত দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। দলের দপ্তর সম্পাদক ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া স্বাক্ষরিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ওবায়দুল কাদের সংশ্লিষ্ট সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে সভায় উপস্থিত হওয়ার জন্য অনুরোধ জানিয়েছেন। গঠনতন্ত্রের রীতি অনুযায়ী কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের শূন্য পদগুলোর মধ্যে ২৮টি সদস্য পদে নেতা নির্বাচনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে এ সভায়। এ ছাড়া দুজন সভাপতিম-লীর সদস্য, তিনজন বিষয়ভিত্তিক সম্পাদকের বিষয়ে আলোচনা হতে পারে বলে জানা গেছে। অবশিষ্ট এই ৩৩টি পদের দিকে তাকিয়ে আছে পদপ্রত্যাশীরাও। অনেকে পদ পেতে শেষ মুহূর্তে চেষ্টা করে যাচ্ছেন।

কমিটি বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গত কমিটির পরিবর্তন না হলেও দুজন নেতার প্রয়াণ, তিনজনের পদোন্নতি হওয়ায় সদস্য পদে আরও চারটি পদ খালি থাকে। অন্যদিকে সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য পদে দুটি ও বিষয়ভিত্তিক সম্পাদক পদে তিনটি খালি থাকায় সবমিলে ৯টি পদে আসতে পারেন গত কমিটির বাইরের পদপ্রত্যাশীরা। এ নয়টি নতুন মুখ নিয়ে রয়েছে কৌতূহল। জানতে চাইলে দলের সভাপতিম-লীর অন্যতম সদস্য লে. কর্নেল (অব) ফারুক খান আমাদের সময়কে বলেন, গণভবনে দলের সভাপতিম-লীর সভায় দলের শূন্য পদের সিদ্ধান্ত হবে।

এমন বাস্তবাতায় রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনা- সবমিলে কেমন হয়েছে বা হচ্ছে আওয়ামী লীগের বর্তমান কমিটি। এ কমিটিই বহাল থাকলে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের কী লাভ হবে? আওয়ামী লীগ নেতাদের ভাষ্য, গত কমিটি সারাদেশে সম্মেলনের মধ্য দিয়ে কমিটি গঠন ও অভ্যন্তরীণ কোন্দল নিরসনে ভূমিকা রেখেছে। পুরো দেশের আওয়ামী লীগ রাজনীতি আছে তাদের নখদর্পণে। ফলে নতুন করে কাউকে দলে এনে দায়িত্ব দিলে তারা নিজস্ব বলয় তৈরি করতে পারেন যা দলের জন্য শুভকর নয়; এতে নতুন করে আবার সংকট দেখা দিতে পারে। তাই ক্ষমতাসীন দলটি এই মুহূর্তে এ ধরনের ঝুঁকি নিতে নারাজ।

আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাকে দলের নেতাকর্মীরা বলে থাকেন ‘ক্রাইসিস ম্যানেজার’। দেশে কিংবা বৈশ্বিক সংকটে তিনি ভূমিকা রেখে দল এবং দেশকে নিরাপদে রাখেন বলেও মত তাদের। ঘাতকের বুলেটে সপরিবারে জাতির পিতাকে হারানোর পর ঝুঁকি নিয়ে ১৯৮১ সালে দেশে আসার পর থেকে আজ অবধি বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা সংকট মোকাবিলা করেই যাচ্ছেন। ফলে তার বিকল্প আজ পর্যন্ত গড়ে ওঠেনি বলে মনে করেন আওয়ামী লীগ নেতারা।

অন্যদিকে দলের সভাপতি শেখ হাসিনা দলের সাধারণ ওবায়দুল কাদেরকে সঙ্গে রেখে মানবতাবিরোধীদের বিচার, সন্ত্রাসবাদ-জঙ্গি দমন, দলে ও দলের বাইরে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতিগ্রহণ করেছেন। একই সময়ে যোগাযোগ খাতে উন্নয়নের রূপরেখা তৈরি এবং তা বাস্তবায়নে রীতিমতো বিপ্লব ঘটিয়েছেন তারা। পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, শত সেতু ও শত রাস্তা উদ্বোধন, কর্ণফুলী টানেলসহ যুগান্তকারী কাজ করেছেন। এ ছাড়া স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী এবং বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ পালন করেও উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন দলের এই শীর্ষ নেতা। আগামী নির্বাচনে যেসব চ্যালেঞ্জ রয়েছে তা মোকাবিলায় এ দুজন পারঙ্গম বলে মনে করেন আওয়ামী লীগ নেতারা।

ঘোষিত কমিটি বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, দলে সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য পদ থেকে নুরুল ইসলাম নাহিদ, আবদুল মান্নান খান ও রমেশ চন্দ্রকে সরানো হয়েছে। সাংগঠনিক সম্পাদক পদ থেকে সরানো হয়েছে সাখাওয়াত হোসেন শফিককে। অন্যদিকে সদস্য পদ থেকে সভাপতিম-লীর সদস্য পদে আনা হয়েছে ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিনকে। ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ পদ থেকে পদোন্নতি দিয়ে সাংগঠনিক সম্পাদক করা হয়েছে সুজিত রায় নন্দীকে। উপপ্রচার থেকে ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে আমিনুল ইসলাম আমিনকে। এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দলের সভাপতিম-লীর এক সদস্য আমাদের সময়কে বলেন, যে তিনজন সভাপতিম-লীর সদস্যকে সরানো হয়েছে তারা দলে পুরোপুরি সক্রিয় ভূমিকা রাখেননি। নির্বাচনকে সামনে রেখে দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে নিষ্ক্রিয় সদস্যকে এ পদে রাখা যৌক্তিক মনে করেননি দলের সভাপতি শেখ হাসিনা। অন্যদিকে সাখাওয়াত হোসেন শফিক সাংগঠনিক সম্পাদক থাকাকালে রংপুর বিভাগের গাইবান্ধা, নীলফামারী ও দিনাজপুরসহ বিভিন্ন স্থানে তার বিরুদ্ধে কমিটি বাণিজ্য এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তার আপত্তিকর ভিডিও প্রকাশসহ নানা অভিযোগ আছে। নির্বাচনমুখী কমিটিতে দলের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে এমন একজনকে রাখাটা নিরাপদ মনে করছে না হাইকামান্ড। যে কারণে করোনা এবং প্রাকৃতি দুর্যোগকালে অবিরাম কাজ করে যাওয়া ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক সুজিত রায় নন্দীকে শফিকের জায়গায় সাংগঠনিক পদে নেওয়া হয়।

কমিটিতে বড় পরিবর্তন না হলে আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের কী লাভ এ বিষয়ে জানতে চাইলে দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফরউল্যাহ আমাদের সময়কে বলেন, ‘আমরা কমিটি করি বা পরিবর্তন করি, যাতে দল বা সংগঠন আরও মজবুত হয়, রাজনৈতিক কার্যক্রম বেগবান হয়। যারা এখন আছে তারা সবাইকে চিনে জানে। নতুন এলে চেনা জানায় একটু জটিল হয় সে দৃষ্টি থেকেই নেত্রী বলেছেন, এক বছর পরই নির্বাচন তাই এবারের সম্মেলনে খুব বড় পরির্তন হবে না।’

এ বিষয়ে দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম আমাদের সময়কে বলেন, ‘বর্তমানে যে ইউনিটি আছে তা আরও জোরদার হবে। যেখানে একটা টিমওয়ার্ক গড়ে উঠেছে, সেখানে নতুন টিমওয়ার্ক গড়তে সময় লাগবে। আমাদের হাতে এত সময় নেই। এভাবেই নেত্রী বিবেচনা করেছেন।’

২৪ ডিসেম্বর দলের ২২তম সম্মেলনের মধ্য দিয়ে সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক, সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, সাংগঠনিক ও বিষয়ভিত্তিক সম্পাদক পদে মোট ৪৮ জনের নাম ঘোষণা করা হয়েছে। যদিও যুগ্ম সাধারণ পদে চারজনের মধ্যে কে আগে, কে পরে এ নিয়ে কিছুটা আলোচনা রয়েছে। তবুও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পদে যে চারজনের নাম ছিল তারাই আছেন। এ ছাড়া ঘোষিত ৪৮ পদে নতুন কাউকে আনা হয়নি। অবনতি, পদন্নোতি এবং একই পদে রদবদলের বিষয় ছাড়া ভিন্ন কিছু নেই। সে হিসেবে ধরে নেওয়া হচ্ছে কেন্দ্রীয় সদস্য যারা আছেন, তাদের মধ্য থেকে বড় পরিবর্তন আসার সম্ভাবনা নেই।

গত কমিটিতে কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদে ছিলেন- আবুল হাসনাত আব্দুল্লাহ, নূরুল ইসলাম ঠাণ্ডু, দীপঙ্কর তালুকদার, মো. আমিরুল আলম মিলন, বেগম আখতার জাহান, ডা. মুশফিক হোসেন চৌধুরী, এবিএম রিয়াজুল করিব কাওছার, প্রফেসর মেরিনা জাহান, পারভীন জামান কল্পনা, হোসনে আরা লুৎফা ডালিয়া, সফুরা বেগম রুমি, সানজিদা খানম, আনোয়ার হোসেন, আনিসুর রহমান, সাহাবুদ্দিন ফরাজী, ইকবাল হোসেন অপু, মো. গোলাম কবীর রাব্বানী চিনু, মারুফা আক্তার পপি, রেমন্ড আরেং, গ্লোরিয়া সরকার ঝর্ণা, মোহাম্মদ সাইদ খোকন, আজিজুস সামাদ আজাদ ডন, সৈয়দ আবদুল আউয়াল শামীম, বিপুল ঘোষ।

কারা আছেন আলোচনায় : জানা গেছে, আগের কমিটি ঠিক রেখেও শূন্য পদগুলো পূরণ করতে হলে নতুন করে ৯ জনকে আনতে হবে। সেই ৯ জনের মধ্যে কারা থাকতে পারেন এ নিয়ে চলছে আলোচনা। এ আলোচনায় রয়েছেন ২০১৯ সালের সম্মেলনে বাদ পড়া বর্তমান নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, পানিসম্পদ উপমন্ত্রী একেএম এনামুল হক শামীম ও শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল। তাদের দলের যে কোনো জায়গায় নেওয়া হতে পারে বলে মনে করেন আওয়ামী লীগ নেতারা।

এ ছাড়া আলোচনায় রয়েছেন বঙ্গবন্ধু উত্তরসূরি সজীব ওয়াজেদ জয়, সায়েমা ওয়াজেদ পুতুল ও রাদওয়ান মুজিব ববি। বঙ্গবন্ধু পরিবারের তরুণ সদস্যদের রাজনীতি আসার বিষয়ে জানতে চাইলে দলের সভাপতিম-লীর একজন সদস্য আমাদের সময়কে বলেন, আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্যরা আসাটাই স্বাভাবিক। না আসাটা বরং হতাশার। এ দলের চেতনা এবং গন্তব্য এবার ছাড়া আর কে ভালো বুঝবে। জয়, পুতুল, ববি সরাসরি রাজনীতিতে যুক্ত না হলেও আওয়ামী রাজনীতির রক্ত প্রতিনিয়ত তাদের শরীরে প্রবাহিত হয়।

দলে ঠাঁই পেতে আলোচনায় রয়েছেন ছাত্রলীগের সাবেক নেতাদের মধ্যে ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ব্যারিস্টার সাজ্জাদ হোসেন, ছাত্রলীগের সাবেক সহসভাপতি আবদুল মতিন, এএইচএম মাসুদ দুলাল, আবদুল মতিন, প্রশান্ত ভূষণ বড়ুয়া, আশরাফ আলী, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সীমান্ত তালুকদার, সাবেক আন্তর্জাতিক সম্পাদক সালাহউদ্দিন মাহমুদ চৌধুরী, সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক খলিলুর রহমান খলিল, মনিরুজ্জামান মনির, সাবেক দপ্তর সম্পাদক কাজী নাছিম আল মোমিন রূপক।

জাতীয় চার নেতার পরিবারের মধ্যে শহীদ ক্যাপ্টেন এমন মনসুর আলীর নাতি শেহেরিন সেলিম রিপন এমবিই অথবা তানভীর শাকিল জয়, শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলামের কন্যা ডা. জাকিয়া নূর লিপিকে কেন্দ্রে আনা হতে পারে। এ ছাড়া শহীদ এইচএম কামরুজ্জামানের ছেলে খায়রুজ্জামান লিটন ও শহীদ তাজউদ্দীন আহমদের কন্যা সিমিন হোসেন রিমিকে পুনরায় দলে রাখা হতে পারে বলে অনেকে মনে করেন।

 

Comment here