নজরুল ইসলাম : নতুন বছরে আন্দোলনে গতি বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে বিএনপির। এরই অংশ হিসেবে দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তি ও বিদেশে চিকিৎসার দাবিতে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টিতে নতুন বছরে বেশ কিছু জনসম্পৃক্ত কর্মসূচি করা, তৃণমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত বিএনপি ও অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের পুনর্গঠন কাজে আরও গতি আনার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলটি। এ ছাড়াও গুরুত্বপূর্ণ পদ থেকে ‘ব্যর্থ ও সন্দেহভাজন’দের সরিয়ে যোগ্য এবং জিয়া পরিবারের বিশ্বস্তদের বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হবে। দলীয় শৃঙ্খলা ধরে রাখতে শীর্ষ নেতৃত্ব আপাতত কঠোর থাকবেন।
বিএনপির একাধিক সূত্র জানায়, দলীয় শৃঙ্খলা ও সাংগঠনিক শক্তি বৃদ্ধির পাশাপাশি বৃহত্তর ঐক্য বা মঞ্চ তৈরিতেও দায়িত্বশীল নেতারা আরও তৎপর হবেন। নতুন বছরেই রাজনৈতিক দল ও নানা শ্রেণি পেশার মানুষদের নিয়ে জাতীয় ঐক্য গঠন প্রক্রিয়া দৃশ্যমান করতে চায় বিএনপি। খালেদা জিয়ার বিদেশে উন্নত চিকিৎসার দাবিতে চলমান আন্দোলনকে নিরপেক্ষ সরকার গঠনের আন্দোলনে রূপ দেওয়া যায় কিনা তা নিয়েও কাজ করবে দলটি। নেতারা মনে করেন, ২০২১ সাল ছিল বিএনপির জন্য সংকটপূর্ণ বছর। বিএনপি চেয়ারপারসন গুরুতর অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি। সরকার তাকে বিদেশে উন্নত চিকিৎসার সুযোগ দিচ্ছে না। কিন্তু এ ইস্যুতে চলমান আন্দোলনে নেতাকর্মীদের অংশগ্রহণে বেশ আশাবাদী দলটি।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, খালেদা জিয়াকে মুক্ত, জনগণের ভোটাধিকার ফিরিয়ে আনা ও গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে আন্দোলনের কোনো বিকল্প নেই। চলমান আন্দোলনকে অতি অল্প সময়ের মধ্যে একটা দুর্বার গণআন্দোলনে পরিণত করা হবে এবং রাজপথেই ফয়সালা হবে।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, খালেদা জিয়ার মুক্তি ও বিদেশে উন্নত চিকিৎসার দাবিতে নানা বাধার পরও এ পর্যন্ত ১০টি সাংগঠনিক বিভাগীয় শহর ও বিভিন্ন জেলায় সমাবেশ করেছে বিএনপি। বাকি থাকা জেলাগুলোয়ও এ কর্মসূচি পালন করা হবে। এ সমাবেশ উপজেলা, পৌরসভা পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার চিন্তা করা হচ্ছে।
বিএনপির গুরুত্বপূর্ণ এক নেতা বলেন, এসব কর্মসূচির মধ্য দিয়ে কোন নেতার কী ভূমিকা, কার কেমন সক্ষমতা দেখা হবে। বিশেষ করে যারা বিগত সময় জাতীয় সংসদ নির্বাচন করেছেন এবং যারা করতে চান তাদের সক্ষমতাও দেখতে চায় দলের শীর্ষ নেতৃত্ব। তৃণমূল পর্যায়ের দায়িত্বশীল নেতাদের সক্ষমতাও দেখা হচ্ছে। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান প্রতিটি কর্মসূচিতে কার কী ভূমিকা তা পর্যবেক্ষণ করছেন। এরই মধ্যে কয়েকটি জেলা কমিটির ব্যাপারে তিনি সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছেন। ব্যর্থতার কারণে বর্তমান নেতৃত্ব সরিয়ে সংশ্লিষ্ট জেলায় নতুন নেতৃত্ব আনার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।
বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা জানান, চূড়ান্ত আন্দোলন হবে ভোটাধিকার ও গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার দাবিতে। এ জন্য একটি বৃহত্তর ঐক্যের নতুন ফর্মুলা দাঁড় করানোর চিন্তা করছে বিএনপি। নতুন ফর্মুলা অনুযায়ী, ২০-দলীয় জোট ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট- এ জোট কাঠামো থেকে বেরিয়ে একটি অভিন্ন মঞ্চ করার চিন্তা করা হচ্ছে।
এ চিন্তা থেকে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন নিয়ে দলগুলোর সঙ্গে রাষ্ট্রপতির চলমান সংলাপে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছে বিএনপি। দলটির নেতারা মনে করেন, খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসা ইস্যুতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে এক ধরনের ঐক্যের সৃষ্টি হয়েছে। নতুন করে রাষ্ট্রপতির সংলাপ নিয়ে নিবন্ধিত বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মনোভাব বুঝতে পারা যাবে মনে করছেন তারা।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য আমাদের সময়কে বলেন, নতুন বছরটি বিএনপির জন্য নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ২০২৩ সালে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে। ওই নির্বাচনের আগে যদি নিরপেক্ষ সরকারের দাবিটি আদায় করা সম্ভব না হয় তা হলে দল হিসেবে বিএনপিকে আরও সংকটের মধ্যে পড়তে হবে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বরচন্দ্র রায় বলেন, কোনো আন্দোলনে জনসম্পৃক্ততা না থাকলে সেই আন্দোলন চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া যায় না। চলমান আন্দোলন কর্মসূচিতে যেভাবে মানুষ অংশ নিচ্ছে তাতে আমরা আশাবাদী। সব শঙ্কা উড়িয়ে দিয়ে ভয়ের পরিবেশ থেকে মানুষ জেগে উঠেছে। আশা করি, এ সরকারের পতন ঘটিয়ে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা করে মানুষের ভোটাধিকার, গণতান্ত্রিক অধিকার ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে।
গত ১৪ সেপ্টেম্বর থেকে ৯ অক্টোবর পর্যন্ত ১০ দিনে দলের নেতা ও পেশাজীবীদের সঙ্গে ৪৫ ঘণ্টার রুদ্ধদ্বার সভা করে বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব। এটি ছিল দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতে বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির প্রথম এবং বড় আকারের সাংগঠনিক সভা। বিএনপির নেতাকর্মীরা মনে করেন, তারেক রহমান দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হওয়ার পর তার সভাপতিত্বে কয়েক ধাপে নির্বাহী কমিটির এ সভা দলকে জেগে উঠতে সহায়তা করেছে। গয়েশ্বরচন্দ্র রায় বলেন, কেউ কেউ মনে করেছিলেন খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতে বিএনপি পথ হারিয়ে ফেলবে। এ সভার মধ্য দিয়ে বিএনপিতে তারেক রহমানের নেতৃত্বে আরও শক্ত ও মজবুত হয়েছে।
বিএনপির কেন্দ্রীয় দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, সারাদেশে দলের ৮১টি সাংগঠনিক জেলার মধ্যে এ পর্যন্ত ৫৫টিতে কমিটি করা গেছে। এ ছাড়া কৃষক দল ও জাতীয়তাবাদী সামাজিক সাংস্কৃতিক সংস্থার (জাসাস) নতুন কমিটি হয়েছে। সারাদেশে যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল ও ছাত্রদলের বিভিন্ন পর্যায়ে আহ্বায়ক কমিটি গঠন প্রায় ৮০ ভাগ সম্পন্ন হয়েছে। মহিলা দলের জেলা কমিটি গঠনও অনেক দূর এগিয়েছে। পুনর্গঠনের কাজ নতুন বছরেই শেষ করা সম্ভব হবে বলে মনে করেন নেতারা। বিএনপির দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, নতুন কমিটিগুলোতে মাঠের পরীক্ষিত কর্মী, বিশেষ করে জিয়া পরিবারের প্রতি আনুগত্য দেখেই পদ দেওয়া হচ্ছে। ২০২৩ সালের সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে দলে নানা প্রতিকূলতার আশঙ্কা বিবেচনায় নিয়ে এ পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।
Comment here