নিজস্ব প্রতিবেদক ; নানা অপকর্মের কারণে গ্রেপ্তার আওয়ামী যুব মহিলা লীগের নরসিংদী জেলার সাধারণ সম্পাদক পদ থেকে সম্প্রতি বহিষ্কৃত শামীমা নূর পাপিয়া ওরফে পিউ বেড়ে উঠেছিলেন সাধারণ একটি পরিবারে। তার বাবা একটি অটো গ্যারেজের মালিক। কিন্তু ২০১৪ সালে যুব মহিলা লীগের নেতৃত্ব পাওয়ার পর মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যে কোটি কোটি টাকা ছাড়াও বিপুল সহায় সম্পত্তির মালিক হয়ে যান পাপিয়া। কীভাবে? ১৫ দিনের রিমান্ডে থাকা পাপিয়া জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেনÑ তার আঁচলে বাঁধা পড়েছিলেন বড় নেত্রী ও প্রভাবশালীরা। তাদের বদৌলতেই প্রতিষ্ঠিত হয় তার প্রতিপত্তি। আর সেই প্রতিপত্তির জোরেই নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে অল্প সময়ে ব্যাপক
বিত্তবৈভবের মালিক বনে গেছেন তিনি।
আওয়ামী যুব মহিলা লীগের ঢাকা মহানগর উত্তরের সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য (এমপি) সাবিনা আক্তার তুহিনের সঙ্গে হাত মিলিয়ে টেন্ডার ও চাকরিপ্রত্যাশীদের জন্য তদবিরের নামে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিতেন পাপিয়া। তার এসব তদবিরের নেপথ্যে রয়েছেন যুব মহিলা লীগের আরও দুই শীর্ষ নেত্রী। পাপিয়াকে কাজে লাগিয়ে প্রভাবশালী এসব রাজনীতিকও তাদের আখের গুছিয়েছেন। পাপিয়ার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে তাদের সম্পর্কেও ইতোমধ্যে অনুসন্ধান শুরু হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্রের খবরÑ রিমান্ডের দ্বিতীয় দিনে গতকাল পাপিয়া এসব তথ্য জানিয়েছেন।
তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, রাজধানী ঢাকা ও নরসিংদীতে মাদকবাণিজ্যে পাপিয়াকে মদদ দিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন কতিপয় রাজনৈতিক নেতা। এ তালিকায় রয়েছেন সরকারি কর্মকর্তাও। আর যুব মহিলা লীগের নেত্রী সাবিনা আক্তার তুহিনের সম্পৃক্ততার কথা পাপিয়া স্বীকার করেছেন; দুজনের চ্যাটিংয়েও এ বিষয়ক তথ্য পাওয়া গেছে। এ ছাড়া যুব মহিলা লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির দুই শীর্ষ নেত্রীর পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়ার কথা জানিয়েছেন পাপিয়া। তাকে জিজ্ঞাসাবাদের সময় একাধিক ভিকটিমকে মুখোমুখি করা হয়। পাপিয়া তাদের ব্ল্যাকমেইল করার কথাও স্বীকার করেন।
তদন্ত সূত্র জানায়, পাপিয়া ঢাকা ও নরসিংদীতে একাধিক ফ্ল্যাট-প্লট ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের মালিক হলেও একটি অটো গ্যারেজের মালিক তার বাবা কষ্টে জীবনযাপন করেন। বাবার খোঁজ নিতেন না পাপিয়া। সূত্র জানায়, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি ও নারীদের দিয়ে অনৈতিক কার্যক্রমের পাশাপাশি ব্ল্যাকমেইল করে পাপিয়া এবং তার স্বামী গড়ে তুলেছেন সম্পদের পাহাড়। অনৈতিক কার্যকলাপের ভিডিও ধারণ করে ধনাঢ্য ব্যক্তিদের কাছ থেকে অর্থ হাতিয়ে নিতেন তারা। র্যাব-পুলিশের একাধিক সূত্র জানায়, পাপিয়ার উত্থানের পেছনে রয়েছে কালো অধ্যায়। কয়েকজন প্রভাবশালীর মাধ্যমে নরসিংদীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বৈধ-অবৈধ গ্যাস সংযোগ, লাখ লাখ টাকার বিনিময়ে চাকরি, দেশি-বিদেশি সুন্দরী নারীদের সাপ্লাই দিয়ে বড় বড় টেন্ডার কাজ বাগিয়ে নেওয়া, মাদককারবারসহ অনেক অপকর্মই করেছেন পাপিয়া।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক এমপি ও যুব মহিলা লীগ ঢাকা উত্তরের সভাপতি সাবিনা আক্তার তুহিন আমাদের সময়কে বলেন, পাপিয়ার সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল দলীয় একজন নেত্রী হিসেবে। এটি তো আমার অপরাধ ছিল না। তার সঙ্গে আমার চ্যাটিং অথবা কথা হয়েছে দলীয় প্রয়োজনে। কিন্তু গত ১৪ মাস ধরে আমার সঙ্গে তার কথা হয় না। কারণ পাপিয়া আমার কাছে কিছু টাকা ধার চেয়েছিল। সেটি নিয়ে তার সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হয়। সর্বশেষ গত ১৬ ডিসেম্বর তার সঙ্গে আমার কথা হয়। ম্যাসেঞ্জারের কথোপকথন আমি ডিলিট করিনি। সব আছে। আমার দোষ আমি সবার সঙ্গে ছবি তুলি। পরিবার ও রাজনীতিকে এক করে ফেলেছিলাম আমি। পাপিয়ার সঙ্গেও একটু ফ্যাশন করে ছবি তুলেছিÑ এটিই কি আমার অপরাধ? কিন্তু কোনো কিছু প্রমাণ হওয়ার আগে এভাবে আমার মানসম্মান শেষ করে দেওয়া হচ্ছে। এসব ‘অপবাদ’ ঘোচাতে প্রয়োজনে তিনি দলীয় দায়িত্ব ছেড়ে দিতে চান বলেও জানান।
এ বিষয়ে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লে. কর্নেল সারোয়ার বিন কাশেম আমাদের সময়কে বলেন, পাপিয়ার সহযোগী হিসেবে যাদের নামে তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যাবে, তাদেরও আইনের আওতায় আনা হবে।
দুর্নীতি দমন কমিশনও (দুদক) গতকাল জানিয়েছে, পাপিয়া-সুমনের সম্পদের বিষয়ে অনুসন্ধান চালানো হবে এবং তাদের দুর্নীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত মর্মে কারও নাম এলে তার বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে। গতকাল বুধবার বিকালে রাজধানীর সেগুনবাগিচায় দুদকের প্রধান কার্যালয়ে কমিশন সচিব দিলওয়ার বখত সাংবাদিকদের এসব তথ্য জানান।
গত ২২ ফেব্রুয়ারি দেশত্যাগের সময় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে পাপিয়া ও সুমন এবং তাদের দুই সহযোগী সাব্বির খন্দকার ও শেখ তায়্যিবাকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। এ সময় তাদের কাছ থেকে ৭টি পাসপোর্ট, নগদ ২ লাখ ১২ হাজার ২৭০ টাকা, ২৫ হাজার ৬০০ টাকার জাল মুদ্রা, ১১ হাজার ৯১ মার্কিন ডলারসহ বিভিন্ন দেশের মুদ্রা জব্দ করা হয়। পরবর্তী সময়ে তাদের আবাসস্থলে অভিযান চালিয়ে একটি বিদেশি পিস্তল, দুটি ম্যাগাজিন, ২০ রাউন্ড গুলি, পাঁচ বোতল বিদেশি মদ, নগদ ৫৮ লাখ ৪১ হাজার টাকা, ৫টি পাসপোর্ট, ৩টি চেক, বিদেশি মুদ্রা, বিভিন্ন ব্যাংকের ১০টি ভিসা কার্ড ও এটিএম কার্ড জব্দ করে র্যাব।
এদিকে গ্রেপ্তারের পর যুব মহিলা লীগ থেকে পাপিয়াকে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করা হয়। আর জাল টাকা উদ্ধার, অস্ত্র ও মাদকের পৃথক তিনটি মামলায় পাপিয়া ও সুমনের প্রত্যেককে ১৫ দিন করে রিমান্ড দেন আদালত। তারা এখন বিমানবন্দর থানায় আছেন এবং গতকাল ছিল তাদের রিমান্ডের দ্বিতীয় দিন।
Comment here