নাদিম খান নিলয় বংশাল থানা প্রতিনিধি :হিজরি ৬১ সনের ১০ মহররম মহানবীর (সা.) দৌহিত্র হযরত ইমাম হোসেন (রা.) কারবালার প্রান্তরে ইয়াজিদ বাহিনীর হাতে শাহাদাত বরণ করেন। এই শোক ও স্মৃতিকে স্মরণ করে সারাবিশ্বে মুসলমানরা আশুরা পালন করেন। আর এরই স্মরণে নির্মাণ করা হয় হোসেনী দালান। এটি মোগল সম্রাট শাহজাহানের আমলে নির্মাণ করা হয় । ১৭শ শতকে নির্মিত এই দালানটি পুরান ঢাকায়। মোগল আমলের ঐতিহ্যের নিদর্শন হিসেবেও এ স্থাপনাটি টিকে আছে। হোসেনী দালান শিয়া মুসলিমদের মসজিদ এবং কবরস্থান হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এটাকে ইমামবাড়াও বলা হয়। আবার অনেকে হুস্নী দালান বা হোসায়নি দালানও বলে থাকেন। এটি শিয়া সম্প্রদায়ের অন্যতম ধর্মীয় উৎসব মহররম পালনের প্রধান কেন্দ্রভূমি।
হায় হোসেইন, হায় হোসেইন মাতমের মধ্যদিয়ে পবিত্র আশুরার ঐহিত্যবাহী তাজিয়া মিছিল এখান থেকে বের হয়। এছাড়াও শিয়া সম্প্রদায়ের বিভিন্ন ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান পালন করা হয়। হোসেনী দালানের দক্ষিণাংশে রয়েছে একটি বর্গাকৃতির পুকুর। এর উত্তরাংশে কবরস্থান রয়েছে। দালানটি সাদা বর্ণের এবং এর বহিরাংশে নীল বর্ণের ক্যালিগ্রাফি বা লিপিচিত্রের কারূকাজ রয়েছে। একটি উঁচু মঞ্চের ওপর ভবনটি নির্মিত। মসজিদের অভ্যন্তরেও সুদৃশ্য নকশা বিদ্যমান। মোগল সম্রাট শাজাহানের আমলে এটি নির্মিত হয় বলা হলেও এর নির্মাণকাল নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতপার্থক্য আছে। স্থাপত্যটির দেয়ালের শিলালিপি থেকে জানা যায়, শাহ সুজার সুবেদারির সময় তার এক নৌ-সেনাপতি মীর মুরাদ এটি নির্মাণ করেন। হিজরী ১০৫২ সনে (১৬৪২ খ্রিস্টাব্দ) প্রথমে তাজিয়া কোণা নির্মাণ করেন তিনি। আর পুরো স্থাপত্যটি তারই পরিবর্ধিতত রুপ বলে বিভিন্ন উপাত্তে পাওয়া যায়। তবে কিছুকাল পরে এটি ভেঙে যায় এবং নায়েব-নাজিমরা নতুন করে তা নির্মাণ করেন। দৈনিক মুক্ত আওয়াজকে সোহান রেজা নামক একজন শিয়া এলাকাবাসী জানান , ১৮৩২ সালেও আদি স্থাপত্যটি টিকে ছিল। ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে দুই দফায় এর সংস্কার করা হয়।
১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে ভবনটি প্রায় বিধ্বস্ত হয়। পরে খাজা আহসানউল্লাহ লক্ষাধিক টাকা ব্যয় করে তা পুন:নির্মাণ ও সংস্কার করেন। ১৯৯৫ ও ২০১১ তে আবারো দক্ষিণের পুকুরটির সংস্কার করা হয়। ইরান সরকারের উদ্যাগে ২০১১ খ্রিস্টাব্দে পুরো হোসেনী দালানের ব্যাপক সংস্কার সাধন ও সৌন্দর্যবর্ধন করা হয়। ইরান সরকার এতে আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা প্রদান করে। ইরানের স্থপতিবিদ ও শিল্পীরা এতে অংশগ্রহণ করেন। ফলে ইরানের ধর্মীয় স্থাপনার বাহ্যিক রূপ ও নান্দনিকতা এ সংস্কার কাজে প্রতিফলিত হয়েছে। সংস্কারের আগে ভেতরে রং-বে রঙের নকশা করা কাঁচের মাধ্যমে যে সৌন্দর্য ফুটিয়ে তোলা হয়েছিল, তা পরিবর্তন করে বিভিন্ন আয়াত ও মুদ্রা লিখিত নীল রঙের টাইলস লাগানো হয়েছে। একইভাবে এর পূর্বদিকের ফটকে এবং উত্তর দিকের চৌকোনা থামগুলোয় আয়াত ও সুরা লিখিত নীল রঙের টাইলস লাগানো হয়েছে। টাইলসগুলো ইরান থেকে আমদানি করা এবং এতে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে ইরানের ধর্মীয় শিল্পকলা ক্যালিগ্রাফি। এটি ইমাম হোসেনের স্মৃতি হিসেবেই আজো পরিচিতি পাচ্ছে। এই দালান শিয়াদের জন্য অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এখান থেকে ১০ মহররম আশুরার দিনে প্রধান মিছিল তাজিয়া মিছিল বের করা হয়।
এটিকে আমরা মঞ্জিল গাশত বলে থাকি। এ মিছিলের পুরোটি সাজানো হয় কারবালার শোকের নানা প্রতিকৃতি নিয়ে। মিছিলের মূল দায়িত্বে থাকে হোসাইনি ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন। এই মিছিলে বুক চাপড়ে, জিঞ্জির দিয়ে শরীরে আঘাত করে মাতম প্রকাশ করা হয়। এ ছাড়াও যে যার মতো করে মিছিলের অংশগ্রহণকারীরা বিভিন্ন নিশান বহন করেন। মিছিলে শোকের গান বাজানো হয়। দুটি ঘোড়া রাখা হয়। ইমাম হোসেন যখন কারবালায় যান তখন ঘোড়া ছিল এক রকম, যুদ্ধ শেষে রক্তে ভেজা ছিল ঘোড়া|
তারই স্মরণে রক্ত রং দিয়ে ঘোড়াকে সাজানো হয়। শান্তি ও সম্প্রীতির ধর্ম ইসলামের সুমহান আদর্শকে সমুন্নত রাখতে ইমাম হোসেনের (রা.) এই আত্মত্যাগ মানবতার ইতিহাসে সমুজ্জ্বল হয়ে রয়েছে। তারই একধরনের স্মৃতি হিসেবে পুরান ঢাকায় দাঁড়িয়ে আছে হোসনী দালান। কারবালার এই শোকাবহ ঘটনা ও পবিত্র আশুরার শাশ্বত বাণী সবাইকে অন্যায় ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে অনুপ্রেরণা জোগায়। সত্য ও সুন্দরের পথে চলার প্রেরণা জোগায়।
Comment here