আব্দুল্লাহ কাফি : কোভিড মহামারী ও ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের মধ্যে গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ায় বড় ধরনের ক্ষতির আশঙ্কা করছেন পোশাকশিল্পের উদ্যোক্তারা। তারা বলছেন, ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পণ্যমূল্য বাড়াতে তারা শিগগিরই বিদেশি ক্রেতাদের দ্বারস্থ হবেন। কিন্তু উদ্যোক্তাদের ভয়, দাম বাড়ানোর কথা বললে ক্রেতারা ক্রয়াদেশ বাতিল করে দিতে পারে। সে ক্ষেত্রে ক্রয়াদেশ চলে যেতে পারে আশপাশের দেশে।
পোশাকশিল্পের মালিকরা জানান, গত দেড় বছরে সুতার দাম বেড়েছে ৬২ শতাংশ, কনটেইনার ভাড়া বেড়েছে ৩৫ থেকে ৪৫ শতাংশ, ডাইসসহ রাসায়নিকের খরচ বেড়েছে ৬০ শতাংশ। গত বছরের শুরুতে মজুরিও বেড়েছে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ। সব মিলিয়ে গত ৫ বছরে পোশাকশিল্পে উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে ৪০ থেকে ৪৫ শতাংশ। এত খরচ বাড়ার পরেও ক্রেতারা এক টাকাও পণ্যমূল্য বাড়ায়নি। এর পর নতুন করে গ্যাসের দাম বাড়ানোয় উৎপাদন খরচ বাড়বে ৩৭ শতাংশ। নতুন করে এই খরচ বহন করা পোশাকশিল্প মালিকদের জন্য কঠিন হবে।
তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান গ্যাস আমদানির ভ্যাট ও ট্যাক্স প্রত্যাহারের জন্য সরকারকে অনুরোধ জানান। সিস্টেম লস কমিয়ে ও অবৈধ সংযোগ বন্ধ করে গ্যাসের মূল্য সমন্বয় সম্ভব বলেও মনে করেন তিনি।
ফারুক হাসান বলেন, ‘আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম তিন বছরে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। এর প্রভাবে কনটেইনার ও ফ্রেইট খরচ ছাড়াও পেট্রোকেমিক্যাল চিপসের দাম আরও বেড়ে যাবে। অন্যদিকে জ্বালানি সংকটের কারণে স্থানীয় পর্যায়ে অনেক কারখানায় ডিজেল দিয়ে জেনারেটর চালানো হচ্ছে। এতেও উৎপাদন ব্যয় বাড়ছে। এ ছাড়া সম্প্রতি গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধিতে উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে। ২০২৩ সালে প্রতি ঘনমিটারে গ্যাসের মূল্য ২০২২ সালের তুলনায় ১৫০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। সরকারের প্রতি আমাদের অনুরোধ, গ্যাস সরবরাহের ক্ষেত্রে রপ্তানিমুখী শিল্প হিসেবে পোশাক খাতকে যেন আরও গুরুত্ব দেওয়া হয়।’
তিনি বলেন, ‘২০২২ সালে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি ২৭ দশমিক ৬৪ শতাংশ বেড়েছে। এর কারণ, পণ্যের দাম ও দামি পোশাকের রপ্তানি বেড়েছে। বিজিএমইএ সভাপতি বলেন, পণ্যের এই মূল্যবৃদ্ধির সুফল উদ্যোক্তারা নিতে পারছেন না। অন্যদিকে নিরাপদ কর্মপরিবেশ ও সবুজ শিল্পয়ায়নে বিপুল বিনিয়োগ করলেও ক্রেতারা তার যথাযথ মূল্যায়ন করছেন না।’
সংগঠনের সহসভাপতি মো. শহীদুল্লাহ আজিম আমাদের সময়কে বলেন, ‘কারখানাগুলো বন্ধ হয়ে গেলে সবাই বিশ^াস করবেন যে কারখানা মালিকরা আর পারছে না। নতুন করে গ্যাসের দাম বাড়ার ফলে পণ্য উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে ৩৭ শতাংশ। মালিকরা এই ব্যয় পূরণ করবেন কীভাবে? ক্রেতারা কোনো কথাই শুনতে চায় না। পণ্যমূল্য বাড়ানোর জন্য আমরা বারবার তাদের অনুরোধ করেছি, কিন্তু ফলাফল শূন্য।’ তিনি বলেন, ‘চেষ্টা আমরা অব্যাহত রাখব। পণ্যমূল্য বাড়াতে শিগগিরই আবার তাদেরকে অনুরোধ জানানো হবে।’
গাজীপুরের চন্দ্রায় অবস্থিত ‘টাওয়েল টেক্স লিমিটেডের’ এমডি এম শাহাদাৎ হোসেন আমাদের সময়কে বলেন, ‘দাম বাড়ানোর কথা বললে ক্রেতারা পাশর্^বতী দেশে চলে যাওয়ার হুমকি দেয়। এভাবে আর কত দিন লোকসান দিয়ে কারখানা চালাবÑ বুঝতে পারছি না। গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির পর আমরা প্রতিযোগিতায় আরও পিছিয়ে পড়ব।’
এদিকে বেতন বাড়ানোর দাবিতে সরব হয়ে উঠছেন শ্রমিকরা। গার্মেন্টস শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নে ন্যূনতম মজুরি ২৪ হাজার টাকা করার দা?বি জানিয়েছে ‘সম্মিলিত গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশন’। বাংলাদেশ গার্মেন্টস শ্রমিক ঐক্য পরিষদের সভাপতি নাজমা আক্তার বলেন, ‘জিনিসপত্রের দাম বাড়ায় জীবনযাত্রার মান নিম্নমুখী।’
২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে সরকার গার্মেন্ট শ্রমিকদের সর্বনিম্ন মজুরি ৮ হাজার টাকা নির্ধারণ করে দেয়, যা আগে ছিল ৫ হাজার ৩০০ টাকা। নাজমা আক্তার ব?লেন, ‘গত পাঁচ বছরে সবকিছুর দাম বেড়েছে অস্বাভাবিক হারে। কিন্তু এ খাতে শ্রমিকদের নতুন মজুরি নির্ধারণ হয়নি।’
সম্প্রতি স্কটল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি অব আবেরডিন ও যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংস্থা ট্রেড জাস্টিস চ্যারিটি ট্রান্সফর্ম ট্রেডের যৌথ জরিপে উঠে আসে, বিশ্বের বড় বড় ব্র্যান্ড ও খুচরা বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো উৎপাদন খরচের চেয়ে কম দামে বাংলাদেশের কারখানা থেকে পোশাক আমদানি করেছে। করোনাকালের প্রায় দুই বছর এমন ঘটনা ঘটেছে। আবার করোনার সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে কারখানাগুলোকে বাড়তি খরচও করতে হয়েছিল ওই সময়।
২০২০ সালের মার্চ থেকে ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত জরিপটি চালানো হয়। এতে বাংলাদেশের রপ্তানিমুখী এক হাজার কারখানার তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়। কারখানাগুলোর মধ্যে ১৯ দশমিক ৬ শতাংশ ছোট (কর্মী সংখ্যা ১ থেকে ১২০ জন); ৫৭ দশমিক ৯ শতাংশ মাঝারি (কর্মী সংখ্যা ১২১ থেকে ১০০০) এবং ২২ দশমিক ৫ শতাংশ কারখানা বড় (কর্মী হাজারের বেশি)।
জরিপে দেখা যায়, ২০২০ সালের মার্চে কারখানাগুলোয় ৭ লাখ ৮৯ হাজার শ্রমিক কাজ করতেন। তখন করোনার কারণে তিন সপ্তাহের মতো কারখানা বন্ধ ছিল। তারপর শ্রমিক সংখ্যা কমে দাঁড়ায় ৫ লাখ ৮৯ হাজারে। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে আবার শ্রমিকের সংখ্যা বেড়ে ৭ লাখ ১৯ হাজার হয়।
Comment here