প্রাণের পর প্রাণ ঝরে, সরে না কেমিক্যাল - দৈনিক মুক্ত আওয়াজ
My title
ঢাকাসমগ্র বাংলা

প্রাণের পর প্রাণ ঝরে, সরে না কেমিক্যাল

গোলাম রাব্বানী : পুরান ঢাকার চকবাজার। রাজধানীর ব্যবসাবাণিজ্যের অন্যতম প্রাণকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত এ এলাকার ঘুম ভাঙে সাতসকালে। এর পর বেলা যত বাড়ে, ততই বাড়ে জনসমাগম, বাড়ে কর্মব্যস্ততা। পুরো এলাকা প্রাণচাঞ্চল্যে মুখর থাকে সেই মধ্যরাত অব্দি। কিন্তু চকবাজারের চিরচেনা এ দৃশ্যপট উধাও হয়ে গেছে। চারপাশ সুনসান, স্তব্ধ। নীরবতা গ্রাস করেছে পুরো এলাকা। ভয়াল সেই নীরবতা ভেদ করে মাঝে মাঝেই ভেসে আসছে শোকার্ত মানুষের বিলাপ।

দোকানপাট, দালানকোটা, আসবাবপত্র-চারপাশে যা কিছু চোখে পড়ে, সব পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। শুধু তাই নয়। পুড়ে ছাই হয়ে গেছে কত কত মানুষও। কারও ভাই পুড়ে মরেছে, কারও আবার বাবা। কেউবা ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম। ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি চকবাজারের চুড়িহাট্টায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পর এমন ভয়াল পরিস্থিতিই দেখা গিয়েছিল। চকবাজার পরিণত হয়েছিল এক মৃত্যুপুরীতে, কেড়ে নিয়েছিল ৭১টি প্রাণ।

আজ ২০ ফেব্রুয়ারি সেই মর্মান্তিক কাণ্ডের এক বছর হলো। অনেকের মনেই হয়তো দুঃসহ সেই স্মৃতি এখন ধূসর; হয়তো বা সেই স্মৃতির ওপর জমে গেছে সময়ের শ্যাওলা। কিন্তু যারা স্বজন হারিয়েছেন? তারা আজও কাঁদছেন। প্রিয় মানুষের এমন প্রস্থানে তাদের কান্না থামবে না কোনোদিন।

চকবাজার মৃত্যুপুরীতে পরিণত হওয়ার পর কি হয়েছিল? সরকারের উচ্চপর্যায়সহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল- অল্প সময়ের মধ্যেই পুরান ঢাকার ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা থেকে ঝুঁকিপূর্ণ ও দাহ্য রাসায়নিকের দোকান, কারখানা ও গুদাম সরিয়ে নেওয়া হবে। ঘোষণার পর যারপরনাই তৎপরতাও শুরু হয়েছিল। এর পর? যা হওয়ার তা-ই হয়েছে।

দিন যত গেছে সেই তৎপরতা ততই কমেছে এবং কমতে কমতে এক সময় থেমে গেছে। চকবাজার যেমন ছিল তেমনই আছে, তেমনই আছে পুরান ঢাকা। কিছুই সরেনি, কিছুই নড়েনি। ২০১০ সালের ৩ জুন নিমতলীতে অগ্নিকাণ্ডে ১২৪ জনের মর্মান্তিক মৃত্যুর পরও এমনটাই ঘটেছিল। প্রাণের পর প্রাণ ঝরে, পুরান ঢাকা থেকে ঝুঁকিপূর্ণ কেমিক্যাল সরে না। গণমাধ্যমের সংবাদে ও মানুষের মনে দগদগে ঘায়ের মতো এসব স্মৃতি যত শুকিয়ে যায়, কর্তৃপক্ষের দায়দায়িত্বও ততই ফুরিয়ে যায়।

গত ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি চুরিহাট্টা অগ্নিকাণ্ডের পর রাসায়নিকবিরোধী যে অভিযান শুরু হয়, তা থেমে যায় এক পক্ষকালের মধ্যেই। ২০১৯ সালের ৪ মার্চের পর হয়নি এ সংক্রান্ত আর কোনো অভিযান। ফল? পুরান ঢাকার লাখ লাখ মানুষ মূলত বোমার ওপর ভাসছেন। গত ১১ ডিসেম্বরও কেরানীগঞ্জের প্রাইম পেট অ্যান্ড প্লাস্টিক ইন্ডাস্ট্রিজ কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে ২২ জন নিহত হন।

গত কয়েক বছরে কেমিক্যালের কারণে যত অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে, সব কটিই পুরান ঢাকায়। জানা গেছে, লালবাগ, চকবাজার, হাজারীবাগ, কামরাঙ্গীরচর, বংশাল, কোতোয়ালি, শ্যামপুর ও কদমতলী এই আট থানায় বর্তমানে কেমিক্যালের প্রায় ২৫ হাজার অস্থায়ী দোকান, কারখানা ও গুদাম রয়েছে।

মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখানে যে কেমিক্যাল পল্লী গড়ার কথা জোরেশোরে শোনা যাচ্ছিল, আর্থিক সংকটের কারণে সেটি এখন এগোচ্ছে না। কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কের ভূমি অধিগ্রহণে অর্থসংকটে পড়েছে বিসিক। তাই দ্রুত ভিত্তিতে চলতি অর্থবছরে বরাদ্দের অতিরিক্ত ৮২০ কোটি টাকা চেয়েছে শিল্প মন্ত্রণালয়। গত বছরের ২৯ অক্টোবর এ সংক্রান্ত একটি চিঠি পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে।

বিসিকের অধীনে বাস্তবায়নাধীন কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক, মুন্সীগঞ্জ (প্রথম সংশোধিত) শীর্ষক প্রকল্পটির আওতায় ৩০৮ দশমিক ৩৩ একর ভূমি অধিগ্রহণ করা হবে। সংশোধিত উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব অনুযায়ী এ প্রকল্পে ভূমি অধিগ্রহণ বাবদ ১ হাজার ২ কোটি টাকার প্রয়োজন। এর মধ্যে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ভূমি অধিগ্রহণ বাবদ জেলা প্রশাসককে ১০৩ কোটি ৭৪ লাখ টাকা অগ্রিম দেওয়া হয়েছে।

চলতি অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) প্রকল্পটির অনুকূলে বরাদ্দ রয়েছে ৮০ কোটি টাকা। জমির মূল্য বাবদ মূলধন খাতে ৮২০ কোটি ৫৩ লাখ টাকা অতিরিক্ত বরাদ্দ প্রয়োজন।

এ প্রসঙ্গে পরিকল্পনা কমিশনের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা জানান, কোনো একটি প্রকল্পে একবারেই এত টাকা বরাদ্দ দেওয়ার মতো তহবিল নেই। তাই আগামী বছরে বরাদ্দের জন্যও অপেক্ষা করতে হবে।

সূত্র জানায়, প্রথম দিকে বিসিক কেমিক্যাল পল্লী, ঢাকা নামের একটি প্রকল্প হাতে নেয় বিসিক। দুর্ঘটনা রোধসহ আবাসিক এলাকা থেকে কেমিক্যাল কারখানা গোডাউন অপসারণের জন্য ঢাকার কেরানীগঞ্জে ৫০ একর জমিতে আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সংবলিত একটি বিসিক কেমিক্যাল পল্লী স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। এজন্য মোট ২০১ কোটি ৮১ লাখ টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ে ২০১৮ সালের জুলাই হতে ২০২১ সালের জুনে বিসিক কেমিক্যাল পল্লী, ঢাকা শীর্ষক প্রকল্পটি ২০১৮ সালের ৩০ অক্টোবর অনুমোদন দেয় একনেক।

কিন্তু চকবাজার মৃত্যুপুরীতে পরিণত হওয়ার পর কেমিক্যাল পল্লীটি আরও বড় পরিসরে এবং তুলনামূলক কম জনবহুল এলাকায় স্থাপনে গুরুত্বারোপ করা হয়। সে জন্য অনুমোদিত বিসিক কেমিক্যাল পল্লীটি ঢাকার কেরানীগঞ্জে স্থাপনের পরিবর্তে ঢাকা-দোহার সড়ক বরাবর মুন্সীগঞ্জ জেলার সিরাজদিখান উপজেলার তুলসীখালী ব্রিজ সংলগ্ন গোয়ালিয়া, চিত্রকোট ও কামারকান্দা নামক তিনটি মৌজায় মোট ৩০৮ একর জমিতে স্থাপনের জন্য প্রকল্পটি সংশোধন করা হয়েছে।

শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ুন বলেন, অতি শিগগিরই শ্যামপুরে কেমিক্যাল গোডাউনগুলো সরানো হবে। এ ছাড়া গাজীপুরেও কেমিক্যাল গুদাম সরানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। আর আগামী বছরের মধ্যেই সিরাজদিখানে কেমিক্যাল গুদাম সরানোর কাজ করা হবে।

গত ৯ জানুয়ারি রাজধানীর শ্যামপুরে অস্থায়ী ভিত্তিতে ৬.১৭ একর জমিতে ৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে ৫৪টি অস্থায়ী গুদাম নির্মাণকাজ শুরু হয়। আগামী জুন মাসের মধ্যেই এর কাজ সম্পন্ন হবে বলে জানান শিল্পমন্ত্রী। তবে এভাবে অস্থায়ী ভিত্তিতে একবার এক স্থানে, পরে স্থায়ী ভিত্তিতে ফের আরেক স্থানে প্রতিষ্ঠান স্থানান্তরের বিষয়টি ব্যবসায়ীদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে না। তারা বলছেন একেবারে স্থায়ী একটি সমাধান। গতকাল পুরান ঢাকার মিডফোর্ড, চকবাজার, পোস্তাসহ বিভিন্ন স্থানে কেমিক্যাল গুদাম ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা এ তথ্য জানা যায়।

মিডফোর্ডের কেমিক্যাল ব্যবসায়ী রাজু আহমেদ বলেন, সবার স্বার্থে আমরা আমাদের প্রতিষ্ঠান স্থানান্তর করব। কিন্তু একবার সিলগালা করে রাখা, একবার শ্যামপুরে স্থানান্তর করা, পরবর্তী সময়ে আবার মুন্সীগঞ্জে যাওয়াÑ এমনটি হলে পুরো কেমিক্যাল খাতই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। অস্থায়ী গুদামে বাড়তি খরচ না করে মুন্সীগঞ্জে সবার জন্য কেমিক্যাল গুদাম নির্মাণ করাটাই শ্রেয়তর বলে মনে করেন তিনি।

এফবিসিসিআইয়ের কেমিক্যাল ও পারফিউমারিবিষয়ক স্ট্যান্ডিং কমিটির চেয়ারম্যান মো. বেলায়েত হোসেন বলেন, আমরা অতিদাহ্য কেমিক্যাল আগে থেকেই সরিয়ে ফেলেছি। এ ছাড়া বারবার স্থানান্তর হলে ব্যবসায়ীরা আগ্রহী হবে না। বিসিক ১০ বছর ধরেও আমাদের কেমিক্যাল পল্লী দিতে পারেনি। এর দায় তারা এড়াতে পারে না।

Comment here