রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর গত বছরের মার্চ থেকে দেশে ডলার-সংকট প্রকট আকার ধারণ করে। সংকট মোকাবিলায় শুরুতে ডলারের দাম বেঁধে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু এতে সংকট আরও বেড়ে যায়। পরে ওই বছরের সেপ্টেম্বরে ডলারের দাম নির্ধারণের দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তখন এই দায়িত্ব নেয় ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) ও বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনের সঙ্গে জড়িত ব্যাংকগুলোর সংগঠন বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস অ্যাসোসিয়েশন (বাফেদা)।
এবিবি ও বাফেদা কয়েক দফা রেমিট্যান্স ও রপ্তানিতে ডলারের দাম বাড়িয়েছে। সবশেষ গত ৩১ মে তারা আবারও দাম বাড়ানোর ঘোষণা দেয়, যা ১ জুন থেকে কার্যকর হয়েছে। ঘোষণা অনুযায়ী, এখন
রপ্তানিকারকরা প্রতি ডলারের দাম পাচ্ছেন ১০৭ টাকা, আগে যা ছিল ১০৬ টাকা। আর প্রবাসী আয়ে ডলারের দাম নির্ধারণ করা হয় ১০৮ টাকা ৫০ পয়সা। আগে এ দাম ছিল ১০৮ টাকা।
নতুন সিদ্ধান্তের ফলে পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে ডলারের দাম পড়বে সর্বোচ্চ ১০৮-১০৯ টাকা। যদিও সংকটের কথা বলে আগে থেকেই আমদানিতে ডলারের দাম এর চেয়ে বেশি নেওয়ার অভিযোগ করে আসছেন ব্যবসায়ীরা। এবার সেই অভিযোগে ঘি ঢাললেন ব্যবসায়ী ও শিল্প মালিকদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন।
গতকাল ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরামের এক অনুষ্ঠানে এফবিসিসিআই বলেন, ‘সরকারের বেঁধে দেওয়া ডলারের বিনিময় হার কোনো কাজ করছে না। ব্যাংকগুলো লুটের মালের মতো করে ডলারের দাম নিচ্ছে। আমদানি বিল পরিশোধের সময় এক ডলারের বিপরীতে প্রায় ১১৫ টাকা পরিশোধ করতে হচ্ছে। যার কাছ থেকে যা ইচ্ছা আদায় করছে ব্যাংকগুলো।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত মঙ্গলবার আন্তঃব্যাংকে ডলারের সর্বোচ্চ দাম ছিল ১০৮ টাকা ৩৫ পয়সা। আর সর্বনিম্ন দাম ছিল ১০৮ টাকা। গতকালও আন্তঃব্যাংকে ডলারের দাম ১০৮ টাকা ৫০ পয়সার মধ্যে ছিল বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক কর্মকর্তা জানান। আর আন্তঃব্যাংকে এই দাম হলে আমদানি বিল নিষ্পত্তিতে তা সর্বোচ্চ ১০৯ টাকা ৫০ পয়সা হওয়ার কথা। কিন্তু এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি বলছেন, ব্যাংকগুলো আমদানি বিল নিষ্পত্তিতে ১১৫ টাকা পর্যন্ত ডলারের দাম আদায় করা হচ্ছে।
খোলাবাজারেও ডলারের দাম নিয়ে কারসাজি : ব্যাংকগুলো যে দরে নগদ ডলার বিক্রি করবে, সেটির সঙ্গে সর্বোচ্চ দেড় টাকা যোগ করে ডলার বিক্রি করতে পারবে মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠানগুলো। গতকাল সোনালী ব্যাংক নগদ ডলার বিক্রি করেছে সর্বোচ্চ ১০৯ টাকায়। এর সঙ্গে দেড় টাক যোগ করে ক্রেতাদের থেকে মানি চেঞ্জাররা সর্বোচ্চ নিতে পারবে ১১০ টাকা ৫০ পয়সা। তারা এই রেটে ডলার বিক্রির তথ্য পাঠাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে। গতকালও তারা এই রেট পাঠিয়েছে। কিন্তু আমাদের সময়ের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এই রেটে কোনো মানি চেঞ্জারই গতকাল ডলার বিক্রি করেনি।
গতকাল রাজধানীর দিলকুশার স্ট্যান্ডার্ড মানি এক্সচেঞ্জ প্রতি ডলার বিক্রি করেছে ১১২ টাকা ৫০ পয়সা। কিন্তু প্রতিষ্ঠানে ঝুলিয়ে রাখা সাদা বোর্ডে সর্বোচ্চ রেট লেখা হয় ১১০ টাকা ৫০ পয়সা। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে পাঠানো প্রতিষ্ঠানগুলোর তালিকায় এই প্রতিষ্ঠানটির নাম ছিল না।
পরে বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠানো তালিকা ধরে কয়েকটি মানি এক্সচেঞ্জ হাউসের ডলার বিক্রির রেট যাচাই করা হয়। এতে দেখা যায়, রাজধানীর সায়েন্স ল্যাবে ওভার ব্রিজসংলগ্ন এলাকায় ব্যবসা করা মাহমুদ ফরেন এক্সচেঞ্জ সেন্টার গতকাল ডলার বিক্রি করেছে ১১২ টাকা ৫০ পয়সা। বসুন্ধরায় অবস্থিত মিডল্যান্ড মানি এক্সচেঞ্জ, উত্তরার বেলি কমপ্লেক্সে ব্যবসা করা প্যারাডাইস মানি এক্সচেঞ্জ ও ধানমন্ডির রয়েল মানি এক্সচেঞ্জ সর্বোচ্চ ১১২ টাকা ৩০ পয়সায় ডলার বিক্রি করেছে। মতিঝিলে অবস্থিত পাইওনিয়ার মানি এক্সচেঞ্জ ডলার বিক্রি করে ১১২ টাকায়। অথচ এসব প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠানো তথ্যে ডলার বিক্রির রেট দেখিয়েছে সর্বোচ্চ ১০৯ টাকা ৫০ পয়সা থেকে ১১০ টাকা ৫০ পয়সা।
মানি চেঞ্জার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি একেএম ইসমাইল হক আমাদের সময়কে বলেন, ‘যদি কেউ এ ধরনের অনিয়ম করে থাকে এবং সেটি যদি প্রমাণিত হয় অবশ্যই সংশ্লিষ্ট মানি এক্সচেঞ্জের লাইসেন্স স্থগিতের জন্য আমাদের সংগঠনের পক্ষ থেকে চিঠি পাঠানো হবে।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মতিঝিলে অবস্থিত একটি মানি এক্সচেঞ্জ হাউসের চেয়ারম্যান আমাদের সময়কে বলেন, এখন খোলাবাজারে ডলারের চাহিদা কম। তার পরও দাম বাড়ছে। তবে কী কারণে বাড়ছে, সেটি বলতে পারছি না। এর সঙ্গে হজ্জের কোনো সম্পর্ক আছে বলে মনে হয় না। কারণ হজ করতে যারা যাচ্ছেন তাদের ১০ শতাংশেরও কম হয়তো সৌদি রিয়ালের বাইরে কিছু ডলার সঙ্গে করে নিয়ে যাচ্ছেন।
উৎসাহিত হচ্ছে হুন্ডি-প্রবণতা : ঘোষিত রেট অনুযায়ী, আন্তঃব্যাংকের সঙ্গে খোলাবাজারের ডলারের ব্যবধান এখনো ৪ টাকা। স্বাভাবিক সময়ে এই ব্যবধান দুই থেকে আড়াই টাকার মধ্যে থাকে। সংশ্লিষ্টরা জানান, খোলাবাজারে ডলারের দাম বেশি হওয়ায় হুন্ডি-প্রবণতা উৎসাহিত হচ্ছে। এতে দেশ হারাচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রা। প্রবাসী আয়ের নিম্নমুখী হওয়ার পেছনে এই প্রবণতা দায়ী। সর্বশেষ গত মে মাসে ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে মাত্র ১৬৯ কোটি ডলার সমপরিমাণ অর্থ দেশে পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। এই অংক আগের বছরের একই মাসের তুলনায় ১০ দশমিক ২৭ শতাংশ কম। এমনকি এবার ঈদের মাসেও প্রবাসী আয় কমতে দেখা গেছে। ঈদের মাস গত এপ্রিলে প্রবাসী আয় কমেছিল প্রায় ১৬ শতাংশ। ওই মাসে প্রবাসী আয় এসেছিল ১৬৮ কোটি ৩৪ লাখ ডলার।
Comment here