জাকির হোসেন তমাল : বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া করোনভাইরাসের প্রতিষেধক এখনো আবিষ্কার করা সম্ভব হয়নি। বিশ্বের অন্তত ২০টি কোম্পানি খুব চেষ্টা করে যাচ্ছে এই প্রতিষেধক আবিষ্কারের। এরই মধ্যে আমেরিকায় মানবদেহে এর পরীক্ষার কাজও শুরু হয়েছে। তবে ফলাফল ভালো হলে এই প্রতিষেধক মানুষের কাজে দিতে অন্তত ছয় মাস থেকে এক বছর সময় লাগবে। তাই এ ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত সুরক্ষা ও কিছু পরীক্ষার মাধ্যমে আক্রান্ত ব্যক্তিদের আলাদা করে রাখা ছাড়া উপায় নেই। এ ক্ষেত্রে কঠোরতা অবলম্বন করতেই হবে। অনেক দেশ তাই এরই মধ্যে লকডাউন বা পুরো দেশকে অবরুদ্ধ করে এই ভাইরাস থেকে মুক্তির পথ খুঁজছে। বাংলাদেশে এর বিকল্প নেই, যেমনটা বলেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
চীনের উহান থেকে ছড়িয়ে পড়া এই ভাইরাসে এখন সবচেয়ে বেশি মৃত্যু ইউরোপের দেশ ইতালিতে। এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে দেশটিতে শুধু শনিবারই মারা গেছে অন্তত ৮০০। আর এক মাসে মারা গেছে ৪ হাজার ৮২৫ জন। এভাবে চলতে থাকলে এই সংখ্যা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা কেউ বলতে পারছে না। তাই করোনা থেকে মুক্তি পেতে কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে ভাইরাস আক্রান্ত ইতালির লম্বার্ডি অঞ্চলের কর্তৃপক্ষ। সেখানে গত ৮ মার্চ থেকে চলছে লকডাউন। এর বাইরে আরও কঠিন হয়েছে সেখানকার প্রশাসন। জরুরি সরবরাহ ব্যবস্থা ছাড়া সবরকমের ব্যবসাবাণিজ্য বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। হাসপাতাল, সড়ক আর রেলপথের কাজ ছাড়া সবরকমের নির্মাণ কাজ বন্ধ করতে বলা হয়েছে।
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বের ১৮৮টি দেশ ও অঞ্চলে। ভাইরাসটির সংক্রমণে এখন পর্যন্ত প্রাণ হারিয়েছেন ১৩ হাজার ৬৯ জন। সারা বিশ্বে ৩ লাখ ৮ হাজার ৪৭৩ জন এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন।
চীনের উহানে প্রথম এই ভাইরাস শনাক্তের পর সেখানে দ্রুত লকডাউন করা হয়। বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া কাউকে বাইরে যেতে দেয়নি। একইসঙ্গে আক্রান্ত রোগীদের আলাদা করে চিকিৎসা দেওয়া এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে গেছে দেশটি। এ কারণে দেশটি এখন অনেকটাই সেই ভাইরাসের প্রকোপ থেকে কেটে উঠতে পেরেছে। শনিবারের তথ্যমতে, উহানে এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে মাত্র একজন। চীন দাবি করেছে, করোনাভাইরাসের প্রতিষেধক আবিষ্কার না হলেও জাপানে ইনফ্লুয়েঞ্জায় আক্রান্তদের জন্য এক ধরনের ওষুধ চীনে করোনাভাইরাস রোগীদের ক্ষেত্রে কার্যকর হয়েছে। ওষুধটি উৎপাদন করেছে জাপানের ফুজিফ্লিম কোম্পানির সহযোগী প্রতিষ্ঠান টয়ামা কেমিক্যাল। দেশে একমাত্র পথ লকডাউন
করোনাভাইরাসের যেহেতু কোনো ওষুধ বের হয়নি, তাই আক্রান্ত ব্যক্তি, করোনা উপসর্গ রয়েছে এমন ব্যক্তি এবং যারা বিদেশ থেকে এসেছেন, তাদের সবাইকে অন্যদের থেকে আলাদা করে রাখা ছাড়া কোনো উপায় নেই। যেহেতু এটা ছোঁয়াচে ভাইরাস, তাই আক্রান্তদের থেকে অন্যদের দূরে রাখাটাই একমাত্র পথ। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজনে পুরো দেশ লকডাউন করা দরকার এবং মাঠে সেনাবাহিনীর মতো দক্ষ বাহিনীকে নামানো প্রয়োজন। যাতে করে এই ভাইরাসের মহামারি থেকে দেশকে রক্ষা করা সম্ভব হয়।
এরই মধ্যে মাদারীপুরের শিবচর উপজেলা লকডাউন করেছে সরকার। সেখানে নিত্যপ্রয়োজনী খাবার সামগ্রীর দোকান ছাড়া সব কিছু বন্ধ রাখা হয়েছে। এখন বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া দেশের নাগরিকদের বাইরে বের না হতে বলা হচ্ছে। বাংলাদেশ লকডাউনের পক্ষে মত দিয়েছেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিনিধি। একই সঙ্গে প্রয়োজনে লকডাউনের কথা বলেছেন আমাদের স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। গত ১৯ মার্চ প্রেস ব্রিফিংয়ে এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘লকডাউন করাটাই আক্রান্ত এলাকার জন্য একমাত্র উপায়। এই করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণের নেওয়ার একমাত্র উপায় হচ্ছে লকডাউন করতে হবে।’
চীনের উদাহরণ টেনে স্বাস্থ্যমন্ত্রী আরও বলেন, ‘চীন করোনা নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে লকডাউনের মাধ্যমে। অন্যান্য দেশও চীনকে ফলো করছে। আমাদের পরিস্থিতি যদি আরও অবনতি ঘটে, আমাদের কোনো এলাকা যদি বেশি আক্রান্ত হয়ে যায়, আমরা অবশ্যই সেই এলাকাকে লকডাউনে নিয়ে যাব। আরও যেখানে যেখানে প্রয়োজন হবে সেখানে সেখানে আমরা লকডাউনে চলে যাব।’
এরই মধ্যে আমাদের পাশের দেশ ভারতে ‘জনতা কারফিউ’ জারি করা হয়েছে। একইভাবে মালয়েশিয়াও লাকডাউনের পথে হাটছে। শুধু তাই নয়, করোনা আক্রান্ত পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশই এই লকডাউনের দিকে যাচ্ছে। তাই যতটা দ্রুত সম্ভব বাংলাদেশ লকডাউন করে এই ভাইরাসের মোকাবিলা করতে হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শ এবং পৃথিবীর অন্যান্য দেশের দিকে তাকিয়ে বাংলাদেশ সরকার দ্রুত কার্যকরী এই পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে নিত্যপ্রয়োজনী পণ্যের কিছু দোকান চালু রাখা যেতে পারে এবং ওষুধের দোকান খোলা রাখা দরকার।
বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টিন
অনেক দেরি হয়েছে আমাদের। দেশের প্রায় প্রতিটি জেলায় প্রবাসীরা অবস্থান করছে। করোনাভাইরাস আক্রান্ত দেশ থেকে তারা আমাদের দেশে এসেছে। অন্তত ১৪ দিন তাদের এক ঘরে করে রাখতে হবে। কিন্তু এই ক্ষেত্রে অন্যান্য দেশের থেকে বাংলাদেশ একেবারেই ব্যর্থ। সরকারের তথ্যমতে, মাত্র ৮ শতাংশ প্রবাসী কোয়ারেন্টিনে রয়েছেন। অথচ এই সংখ্যা ১০০ ভাগ করা দরকার। আত্মীয়দের উচিত কোনো প্রবাসীর সঙ্গে দেখা করতে না আসা। প্রতিটি প্রবাসীর উচিত, নিজেদের ও দেশের কথা ভেবে অন্তত ১৪ দিন নিজেকে সবার থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা।
জেলায় জেলায় করোনাভাইরাস পরীক্ষার ব্যবস্থা থাকা জরুরি
দেশে করোনা পরীক্ষার ব্যবস্থা এখন ঢাকায়। এর বাইরে দু-একটি জায়গায় সেটা করার চেষ্টা করছে সরকার। কিন্তু দেশের প্রতিটি জেলায় করোনাভাইরাস শনাক্তকরণের ব্যবস্থা রাখা এখন খুবই জরুরি। ধরুন, করোনভাইরাস পরীক্ষার জন্য কোনো ব্যক্তি যদি সুদূর হবিগঞ্জ থেকে ঢাকায় আসেন, এসে জানতে পারলেন তার শরীরে সেই ভাইরাস রয়েছে। তারপর তাকে নিরাপদ স্থানে রাখা হলো বা প্রয়োজনীয় কোনো চিকিৎসা দেওয়া হলো। কিন্তু ওই ব্যক্তি যে পরিবহন ব্যবহার করে ঢাকায় এসেছেন, যেসব হাসপাতালে গেছেন, তার প্রতিটি পদচারণায় তো অন্যরা সংক্রমিত হয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে আগামীতে কী যে ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে, তা বলা যাচ্ছে না। তাই এখনই সব জেলায় করোনাভাইরাস পরীক্ষার ব্যবস্থা বা যন্ত্র স্থাপন করা উচিত।
এটা যদি সম্ভব না হয় তাহলে অন্তত এমন কিছু হটলাইন নম্বর ও অ্যাম্বুলেন্স তৈরি রাখা, যাতে আক্রান্ত ব্যক্তি বা উপসর্গ থাকা ব্যক্তিদের বিশেষ ব্যবস্থায় হাসপাতালে নিয়ে পরীক্ষা করা সম্ভব হয়। এতে করে হয়তো এই দেশের মানুষ কিছুটা হলেও বাঁচতে পারবে। না হলে ইতালির থেকেও ভয়াবহ পরিস্থিতি আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে।
Comment here