বাজার ১৫ যেভাবে ৬০ হয়ে যায় - দৈনিক মুক্ত আওয়াজ
My title
সারাদেশ

বাজার ১৫ যেভাবে ৬০ হয়ে যায়

হারুন-অর-রশিদ ও রেজাউল রেজা : বছর না ঘুরতেই আবার অস্থিতিশীল পেঁয়াজের বাজার। অজুহাত একই- দেশের বাজারে সরবরাহ ঘাটতি, দাম বাড়ছে ভারতের বাজারেও। তবে এটি নিছকই খোঁড়া যুক্তি। প্রতিকেজি পেঁয়াজ ১৪ থেকে ১৫ টাকায় ভারত থেকে আমদানি করা হচ্ছে। আর সেই পেঁয়াজ কয়েক হাত বদল হয়ে খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে চার গুণ বেশি দামে- ৬০ টাকায়।

গত মাসে বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি হয়েছে ৮৩ হাজার ৬৬৬ টন পেঁয়াজ। এর বেশিরভাগই এসেছে ভারত থেকে। ১৫ টাকা ব্যয়ে আমদানি করা পেঁয়াজ কেন খুচরা বাজারে ৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এর কারণ খুঁজতে গিয়ে বরাবরের মতো মুনাফালোভী ব্যবসায়ীদের কারসাজির তথ্যই উঠে এসেছে। পর্যাপ্ত পেঁয়াজ মজুদ থাকলেও তারা কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে আবারও দাম বাড়াচ্ছেন।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পেঁয়াজের দাম বৃদ্ধির কোনো বাস্তবসম্মত কারণ নেই। এর পরও হঠাৎ করে কেন দাম বাড়ছে তা খতিয়ে দেখা উচিত। তারা বলছেন, পেঁয়াজের মূল্য কারসাজি করে যেসব ব্যবসায়ী বারবার মুনাফা লুটছেন, তাদের বিরুদ্ধে কখনো দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। ফলে তারা কারসাজি করে বারবার ক্রেতাদের পকেট কাটার সুযোগ পেয়ে যাচ্ছেন।

সূত্র জানায়, ফের ‘সেপ্টেম্বর আতঙ্কে’ দেশের বাজারে পেঁয়াজের দাম অস্থির হয়ে উঠেছে। গত তিন সপ্তাহে লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে সব ধরনের পেঁয়াজের দাম। দেশি পেঁয়াজের দাম দ্বিগুণ বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৭০ থেকে ৮০ টাকায়। গত মাসের মাঝামাঝিতে যার দাম ছিল ৩৫ থেকে ৪০ টাকা। আর আমদানি করা ভারতের পেঁয়াজের দাম এখন ৫০ থেকে ৬০ টাকা, যা আগে ছিল ২৫ থেকে ৩০ টাকা। রাজধানীর মানিকনগরের এক দোকানি বলেন, শ্যামবাজারের মোকাম থেকে বেশি পেঁয়াজ আনতে পারিনি। দাম অনেক বেড়েছে। আমরা বেশি দামে কিনে সামান্য লাভ রেখে বিক্রি করি। দাম বাড়লে বিক্রি করতে আমাদের মতো দোকানদারদের সমস্যা বেশি হয়।

কিন্তু দাম বৃদ্ধির জন্য বরাবরের মতো একে অপরকে দোষারোপ করছেন বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যবসায়ীরা। রাজধানীর কারওয়ানবাজারের আড়তদার হাবিবুর রহমান বলেন, আমরা সরাসরি ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানি করি না। কিছু আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান রয়েছে, তারাই পেঁয়াজ আমদানি করে আমাদের সরবরাহ করেন। আমরা তাদের দাম অনুযায়ী বাজারে পেঁয়াজ ছাড়ি। এখানে আমরা সামান্য কিছু কমিশন পেয়ে থাকি। বেশি দামে কিনে বিক্রিও করি বেশি দামে।

বিদেশ থেকে পণ্য আমদানির তথ্য পর্যবেক্ষণ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সপ্তাহভিত্তিতে ব্যাংকগুলোর দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে এই পর্যবেক্ষণ করা হয়। সবশেষ গত আগস্টে ব্যাংকগুলোতে ঋণপত্র (এলসি) খুলে ৮৩ হাজার ৬৬৬ টন পেঁয়াজ আমদানি করা হয়েছে। এতে আমদানিকারকদের ব্যয় হয়েছে এক কোটি ৩৯ লাখ ৩৬ হাজার ডলার বা ১১৮ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। প্রতিটনে ব্যয় হয়েছে ২২৭ ডলার। গত বছরের আগস্টে আমদানি করা হয় ৫৭ হাজার ৪৭৯ টন। এই হিসাবে এ বছর আমদানি বেড়েছে ৪৫ দশমিক ৫৫ শতাংশ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- আগস্টের প্রথম ও শেষ সপ্তাহে প্রতিকেজি পেঁয়াজ ১৫ টাকা দরে আমদানি করা হয়। দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ সপ্তাহে দাম আরও কম ছিল- ১৪ টাকা কেজি। গত বছরের আগস্টে আমদানিতে পেঁয়াজের দাম ছিল কেজিপ্রতি ১৭ থেকে ২৫ টাকা। এই হিসাবে এবার আমদানিতে দাম কমেছে ১৭ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত। তবে আগস্টের শেষ সপ্তাহে নতুন করে আমদানি করতে গিয়ে যে এলসি খোলা হয়েছে, তাতে পেঁয়াজের দাম কয়েক টাকা বেড়েছে। প্রতিকেজি পেঁয়াজের দাম পড়েছে ১৯ টাকা।

ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানিকারক হাফিজুর রহমান জানান, পেঁয়াজ আসতে অন্তত এক সপ্তাহ প্রয়োজন হয়। আগে এলসি খোলা হলেও পেঁয়াজ আনতে হয় সপ্তাহখানেক পরের দামে। ভারতে এখন পেঁয়াজের দাম অনেকখানি বেড়েছে। তাই আমাদেরও বেশি দামে পেঁয়াজ আনতে হয়েছে। তার ওপর পরিবহন ভাড়া, শ্রমিকদের মজুরি দিয়ে দেশের বাজারে ভারতীয় পেঁয়াজের দাম বেড়ে গেছে।

আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীরা জানান, বন্দরে পেঁয়াজের চালান আসার পর সরকারি কিছু খরচসহ আনুষঙ্গিক ব্যয় বাবদ প্রতিকেজিতে আরও এক টাকা খরচ হয়। এ ছাড়া এসব পেঁয়াজ বন্দর থেকে রাজধানী পর্যন্ত আসতে কেজিপ্রতি আরও এক থেকে দেড় টাকা খরচ হয়ে থাকে। এর পর আমদানিকারকরা পাইকারি ব্যবসায়ীদের কাছে এসব পেঁয়াজ বিক্রি করেন। পাইকারি ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে তা খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছে পৌঁছে। সব মিলিয়ে ভারত থেকে আমদানি করার পর তিন-চার হাত হয়ে পেঁয়াজ ভোক্তার কাছে পৌঁছে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, দেশে বার্ষিক পেঁয়াজের চাহিদা ২৪ লাখ টন। গত বছর উৎপাদন হয় ২৩ দশমিক ৩০ লাখ টন। বাকিটা আমদানি করা হয়।

দেশি পেঁয়াজের দাম বৃদ্ধির বিষয়ে মালিবাগের পাইকারি ব্যবসায়ী শাহাবুদ্দিন বলেন, দেশে পেঁয়াজের সংকট নেই। ভারতে পেঁয়াজের দাম বেড়ে যাওয়ায় একশ্রেণির অসাধু মজুদদার বাজারে পেঁয়াজ কম ছাড়ছে। এতে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি হচ্ছে, দেশি পেঁয়াজের দামও বেড়ে যাচ্ছে। পেঁয়াজ এখন মজুদদারদের কাছে। সেখানে বৃষ্টি-বন্যায় পেঁয়াজের ক্ষতি হওয়ার কথা নয়। যতটুকু ক্ষতি হয়, সেটুকু ক্ষতি বিবেচনা করেই দাম নির্ধারণ করা থাকে। নতুন করে দাম বাড়ার কথা নয়।

গত বছর সেপ্টেম্বরে পেঁয়াজের দাম বৃদ্ধির কারণ জানতে কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর তদন্ত চালায়। সেখানে দাম বৃদ্ধির জন্য আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীদের অতিরিক্ত মুনাফার লোভে কারসাজি ছাড়াও কিছু বাস্তবসম্মত কারণ উল্লেখ করা হয়। দাম বৃদ্ধির অন্যতম মূল কারণ হচ্ছে- আমদানির জন্য এককভাবে ভারত নির্ভরতা। তাই আমদানির জন্য বিকল্প দেশ খোঁজা এবং সারাবছর সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের সুপারিশ করে ওই কমিটি।

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, ব্যবসার ক্ষেত্রে নীতিমালা চলে না। ব্যবসায়ীদের একটাই নীতি কীভাবে মুনাফা হবে। তাই তারা কেবল সুযোগ খোঁজেন। এর আগেও কারসাজিবাজদের তালিকা হয়েছে। কিন্তু দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়নি। এতে অসাধু ব্যবসায়ীরা আরও সাহসী হয়ে উঠছে। তিনি আরও বলেন, ভারতে দাম বাড়ছে। সরকারের উচিত মিয়ানমার, মিসর ও চীনের মতো বিকল্প উৎস থেকে পেঁয়াজের আমদানি বাড়িয়ে দেওয়া। এতে দাম কমে আসবে। তবে সরকারের উচিত দেশের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করা। আমদানি নির্ভরতা থেকে বেরিয়ে আসা। চাহিদার বিপরীতে দেশীয় উৎপাদন সন্তোষজনক পর্যায়ে থাকলে বাজার আপনা থেকেই স্থিতিশীল থাকবে।

গত বছরের সেপ্টেম্বরে ভারত রপ্তানি বন্ধ করলে দেশের বাজারে হু হু করে বেড়ে পেঁয়াজের কেজি ২৫০ টাকা পর্যন্ত উঠে যায়। সংকট কাটাতে মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, মিসর, চীন, পাকিস্তানসহ বিভিন্ন দেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানি করা হয়। এমনকি বিমানে করেও আনা হয় পেঁয়াজ। এর পর চলতি বছরের মার্চের শুরুতে ভারত রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা উঠিয়ে নেওয়ার ঘোষণা দেয়। এতে দেশের বাজারে পেঁয়াজের দাম ৩০ থেকে ৪০ টাকায় নামে।

Comment here