বাংলাদেশের ইতিহাসে এই প্রথম কোনো প্রধানমন্ত্রী বাজেট বক্তৃতা উত্থাপন করলেন। গতকাল বৃহস্পতিবার অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতা শুরু করলেও অসুস্থতার কারণে মাঝপথে থামতে বাধ্য হন। এ অবস্থায় অর্থমন্ত্রীর পাশে দাঁড়ান প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা শেখ হাসিনা। প্রস্তাবিত বাজেটের বাকি অংশ উপস্থাপন করেন তিনি। বিকাল ৪টা ৭ মিনিট থেকে ৪টা ৪০ পর্যন্ত বাজেট বক্তব্য পাঠ করেন। গতকাল বেলা ৩টায় স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে সংসদ অধিবেশন শুরু হয়।
এর আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে কালো সুটকেস হাতে বেলা পৌনে ৩টায় অধিবেশন কক্ষে প্রবেশ করেন অর্থমন্ত্রী। বেলা সোয়া ৩টার দিকে সম্পূর্ণ ডিজিটাল পদ্ধতিতে নিজের প্রথম বাজেট উত্থাপন শুরু করেন তিনি। অসুস্থ অর্থমন্ত্রী বাজেট পেশ করতে হাসপাতাল থেকে সরাসরি সংসদে এসেছিলেন। প্রচ- অসুস্থতার কারণে বাজেট বক্তব্য উপস্থাপন ঠিকমতো করতে পারছিলেন না তিনি। এ সময় পাশ থেকে প্রধানমন্ত্রী, মতিয়া চৌধুরী ও শেখ ফজলুল করিম সেলিমকে বারবার অর্থমন্ত্রীকে সহযোগিতা করতে দেখা যায়।
কিন্তু বিকাল ৪টার পর একটু বেশিই অসুস্থতা অনুভব করেন অর্থমন্ত্রী। এ সময় কয়েকজন চিকিৎসক এমপি এসে তার শারীরিক অবস্থা দেখে চোখে ওষুধ দিয়ে দেন। এর পরও অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় ৫-৭ মিনিট পর অর্থমন্ত্রী নিজেই বাকি বাজেট বক্তব্য উপস্থাপনের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অনুরোধ জানান। এ সময় পুরো অধিবেশনের চিত্রই পাল্টে যায়। সরকার ও বিরোধী দলের সংসদ সদস্যরা টেবিল চাপড়ে এ প্রস্তাবে পূর্ণ সমর্থন জানান। এ সময় প্রধানমন্ত্রী দাঁড়িয়ে বাজেটের বাকি অংশটুকু উপস্থাপনের জন্য স্পিকারের অনুমতি চান। স্পিকার অনুমতি দিয়ে বলেন, আপনি দাঁড়িয়ে বা বসে বাজেট উপস্থাপন করতে পারেন। পরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের অর্থমন্ত্রী খুবই অসুস্থ। তার চোখে অপারেশন হয়েছে, ১৫ মিনিট পর পর তার চোখে ড্রপ দিতে হয়। আমারও চোখে অপারেশন হয়েছে। এ ছাড়া ঠাণ্ডা লেগে কথা বলতে গেলে কাশি আসে। বাজেট বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রীকে অভিনন্দন জানিয়ে কিছু বক্তব্য ছিল।
সেটি পাঠ করার সময় প্রধানমন্ত্রী হেসে স্পিকারকে বলেন, মাননীয় স্পিকার, এটি আমার বক্তব্য নয়, এটি হচ্ছে অর্থমন্ত্রীর। বাজেট বক্তৃতায় যেখানে প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানানো হয়েছে সেটি আমি পড়ব কিনা? জবাবে স্পিকার বাজেট বক্তৃতা যেভাবে রয়েছে, সেভাবেই উপস্থাপনের জন্য প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ জানান। প্রধানমন্ত্রী বাজেট উপস্থাপন শেষ করলে স্পিকার বলেন, বাজেটের অপঠিত অংশগুলো পঠিত বলে গণ্য করা হলো। বাজেট উপস্থাপন শেষে মন্ত্রিসভার সদস্য, সিনিয়র নেতা থেকে শুরু করে বিরোধী দলের নেতারাও প্রধানমন্ত্রীর আসনের সামনে এসে তার এই দৃঢ়তার প্রশংসা করেন। এর আগে অধিবেশনের শুরুতে অর্থমন্ত্রী তার অসুস্থতার কথা উল্লেখ করে বসে বাজেট উপস্থাপনের জন্য স্পিকারের অনুমতি চান। শুরুতেই বাংলাদেশ শীর্ষক একটি দীর্ঘ প্রমাণ্যচিত্র তুলে ধরা হয়। এতে পাকিস্তান আমলে বাঙালি জাতির ওপর বৈষম্য, শোষণ-বঞ্চনা, এর বিরদ্ধে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রাম, ৯ মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা অর্জন, পরবর্তী স্বৈরশাসকদের দুঃশাসন শেষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে টানা তিন মেয়াদে দেশের অভূতপূর্ব উন্নয়ন-অগ্রগতি ও সমৃদ্ধির সোপানে অগ্রযাত্রার চিত্র তুলে ধরা হয়। এদিকে বাজেট বক্তৃতার আগে সংসদ ভবনের কেবিনেট কক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে মন্ত্রিসভার বৈঠক হয়।
এতে প্রস্তাবিত বাজেট অনুমোদন দেওয়া হয়। সংসদে নিজ কক্ষে বসে বাজেট উপস্থাপন প্রত্যক্ষ করেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। এর আগে রাষ্ট্রপতিকে সংসদ ভবনে স্বাগত জানান প্রধানমন্ত্রী। সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ছাড়াও প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, প্রধানমন্ত্রীর অর্থনীতিবিষয়ক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান, প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী, বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী, প্রধান নির্বাচন কমিশনার কেএম নূরুল হুদা, মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব নজিবুর রহমান, প্রধানমন্ত্রীর মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ হোসেন পুতুল, দেশি-বিদেশি কূটনীতিক, সামরিক ও বেসামরিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বাজেট বক্তৃতা প্রত্যক্ষ করেন। অর্থ বিল উত্থাপন প্রধানমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতা শেষ হলে অর্থমন্ত্রী মুস্তফা কামাল দাঁড়িয়ে অর্থ বিল উত্থাপন করেন। সরকারের আর্থিক প্রস্তাবাবলি কার্যকরণ ও কিছু আইন সংশোধনের লক্ষ্যে বিলটি উত্থাপন করা হয়। সংসদের কার্য-উপদেষ্টা কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বিলটি আগামী ৩০ জুন পাস হবে। এর আগে প্রস্তাবিত বাজেটের ওপর সরকার ও বিরোধীদলীয় সদস্য ৪৫ ঘণ্টা আলোচনা করবেন।
Comment here