বাড়ছে বিদেশি ঋণের বোঝা - দৈনিক মুক্ত আওয়াজ
My title
Uncategorized

বাড়ছে বিদেশি ঋণের বোঝা

চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে (জানুয়ারি-মার্চ) বৈদেশিক উৎস থেকে বাংলাদেশের ঋণ নেওয়ার পরিমাণে কিছুটা ভাটা পড়লেও আবার বাড়ছে। সর্বশেষ এপ্রিল থেকে জুন এই তিন মাসে বৈদেশিক ঋণ বেড়েছে প্রায় সোয়া তিন বিলিয়ন ডলার বা সাড়ে ৩ শতাংশ। সব মিলে গত জুন শেষে বৈদেশিক ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে প্রায় ৯৯ বিলিয়ন ডলার; যা ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে এযাবৎকালের সর্বোচ্চ। বাংলাদেশি মুদ্রায় এর পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ১০ লাখ ৯৩ হাজার কোটি টাকা। সংশ্লিষ্টরা জানান, দিন দিন চড়া সুদের বৈদেশিক ঋণ বাড়ছে। আগে যেসব উন্নয়ন-সহযোগী সংস্থার কাছ থেকে সুদবিহীন কিংবা নামমাত্র সুদে ঋণ পাওয়া যেত, এখন সেই সুযোগ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। মানুষের মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি, স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ এবং দেশের আর্থসামাজিক অগ্রগতি বিবেচনায় সস্তা ঋণ পাওয়া থেকে বাদ পড়ছে দেশ। এ ছাড়া আগে থেকেই কমে গেছে অনুদান।

বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হওয়ায় দেশে দীর্ঘদিন ধরেই ডলারের সংকট চলছে। এই সংকট সামাল দিতে আমদানি নিয়ন্ত্রণসহ নানা পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। তার পরও পতন থামানো যাচ্ছে না দেশের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের। এ কারণে বৈদেশিক উৎসের ঋণেও ঝুঁকছে সরকার। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, গত জুন শেষে বিদেশি ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৯ হাজার ৮৯৩ কোটি ৫৪ লাখ ডলার (প্রায় ৯৯ বিলিয়ন)। তিন মাস আগেও যা ছিল ৯ হাজার ৫৭১ কোটি ২৪ লাখ ডলার। ফলে গত তিন মাসের ব্যবধানে বিদেশি ঋণ বেড়েছে প্রায় ৩২২ কোটি ৩০ লাখ ডলার বা সাড়ে ৩৫ হাজার কোটি টাকা। গত বছরের ডিসেম্বরে বিদেশি ঋণের স্থিতি ছিল ৯ হাজার ৬৫০ কোটি ২৪ লাখ ডলার। অর্থাৎ জানুয়ারি থেকে মার্চÑ এই তিন মাসে বিদেশি ঋণ কমেছিল প্রায় ৭৯ কোটি ডলার।

গত তিন মাসে বিদেশি ঋণের সিংহভাগই নেওয়া হয়েছে সরকারি খাতে। একই সময়ে বেসরকারি খাতে বিদেশি ঋণ বাড়লেও সেই বৃদ্ধির গতি খুবই কম। সেই সঙ্গে বেসরকারি খাতে স্বল্পমেয়াদি বিদেশি ঋণ নেওয়ার পরিমাণ কমে এসেছে। তবে আগে নেওয়া স্বল্পমেয়াদি বিদেশি ঋণ পরিশোধের চাপ বেড়েছে। আবার কিছু ঋণের মেয়াদ বাড়িয়ে নেওয়ার ঘটনাও ঘটছে। বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, গত কয়েক বছরে বেসরকারি খাতের বিদেশি ঋণ তুলনামূলক বেশি বেড়েছে। তা ছাড়া করোনার কারণে এসব ঋণ পরিশোধ না করে সময় বাড়িয়ে নেওয়া হয়। সে কারণে এখন চাপ বেড়েছে ঋণ পরিশোধের। তবে নতুন করে বেসরকারি খাতে স্বল্পমেয়াদি বিদেশি ঋণ বৃদ্ধি না পাওয়ার বিষয়টি ইতিবাচক।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিপুল অংকের এই বিদেশি ঋণের মধ্যে সাড়ে ৭৭ শতাংশই সরকারি খাতের। বাকি ২৩ শতাংশ ঋণ নিয়েছে দেশের বেসরকারি খাত। অর্থাৎ মোট বিদেশি ঋণের মধ্যে সরকারের নেওয়া ঋণের পরিমাণ ৭ হাজার ৬৬৭ কোটি ৮৪ লাখ ডলার। বাকি ২ হাজার ২২৫ কোটি ৭০ লাখ ডলার ঋণ নিয়েছে বেসরকারি খাত। গত মার্চ পর্যন্ত সরকারি খাতে বিদেশি ঋণের পরিমাণ ছিল ৭ হাজার ৩৫৩ কোটি ১৯ লাখ ডলার। এই হিসাবে গত তিন মাসে বিদেশি খাতে বিদেশি ঋণ বেড়েছে ৩১৪ কোটি ৭০ লাখ ডলার। অন্যদিকে গত মার্চে বেসরকারি খাতে বিদেশি ঋণের পরিমাণ ছিল ২ হাজার ২১৮ কোটি ১০ লাখ ডলার। ফলে গত তিন মাসে বেসরকারি খাতে বিদেশি ঋণ বেড়েছে মাত্র ৭ কোটি ৫৯ লাখ ডলার। প্রতিবেদনে আরও দেখা যায়, গত তিন মাসে বেসরকারি খাতে স্বল্পমেয়াদি ঋণ প্রায় ৪২ কোটি ৭০ লাখ কমে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১ হাজার ৩৬৫ কোটি ডলার। এসব ঋণের মধ্যে বাণিজ্যিক ঋণের পরিমাণ ৯৫১ কোটি ডলার। এসব বাণিজ্যিক ঋণের বেশিরভাগই বায়ার্স ক্রেডিট, যার পরিমাণ প্রায় ৭৬৯ কোটি ৮৩ লাখ ডলার। বায়ার্স ক্রেডিটের এ ঋণ সাধারণত এক বছরের মধ্যে শোধ করতে হয়। বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা এসব ঋণ নিয়ে থাকেন। এ ছাড়া বিদেশি ব্যাক টু ব্যাক এলসির ঋণ রয়েছে প্রায় ৮৪ কোটি ৬৪ লাখ ডলার। আর ডেফার্ড পেমেন্টের ঋণ আছে ৯৬ কোটি ৯২ লাখ ডলার।

এদিকে গত তিন মাসে মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি ঋণ বেড়েছে প্রায় ৫০ কোটি ৩০ লাখ ডলার। সব মিলে গত জুন শেষে বেসরকারি খাতে মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৮৬০ কোটি ডলার।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশের বিদেশি ঋণগ্রহণ ব্যাপক হারে বেড়েছে। সরকারি ও বেসরকারি উভয় খাতেই বেড়েছে ঋণ। যদিও দেশের জিডিপির অনুপাতে বিদেশি ঋণগ্রহণে বাংলাদেশ এখনো নিরাপদ অবস্থানেই রয়েছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ও বিশ্বব্যাংকের মানদণ্ডে জিডিপির ৪০ শতাংশ পর্যন্ত বৈদেশিক ঋণের স্থিতি যে কোনো দেশের জন্য নিরাপদ। বাংলাদেশের বিদেশি ঋণ এখন জিডিপির প্রায় ২১ শতাংশেরও কম। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান বলছে, গত পাঁচ বছরে বিদেশি উৎস থেকে বাংলাদেশের ঋণ বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। ২০১৭ সাল শেষে বিদেশি উৎস থেকে দেশের মোট ঋণের পরিমাণ ছিল ৪ হাজার ৬৮১ কোটি ডলার। যা গত বছর শেষে বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৯ হাজার ৮৯৩ কোটি ডলার। তথ্যানুযায়ী, ২০১৮ সালে বিদেশি ঋণ ছিল ৫ হাজার ২১৩ কোটি ডলার। ২০১৯ সালে তা ৫ হাজার ৭০৯ কোটি ডলার, ২০২০ সালে ৬ হাজার ৭৭৪ কোটি ডলার, ২০২১ সালে তা দাঁড়ায় ৯ হাজার ১৪৩ কোটি ডলারে। আর গত বছর তা বেড়ে হয় ৯ হাজার ৬৫০ কোটি ডলার। অর্থাৎ গত ৫ বছরের মধ্যে ২০২১ সালে রেকর্ড পরিমাণ বৃদ্ধি পায় বিদেশি ঋণ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, বিদেশি ঋণের ওপর এতটা নির্ভরশীল হওয়া উচিত নয়। কারণ এই ঋণের বোঝা দেশের সাধারণ মানুষ ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ওপর বর্তায়। এ কারণে আগামীতে বিদেশি ঋণ নেওয়ার বিষয়ে সরকারকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দেন তিনি।

Comment here