জাতীয় সংসদে রুপপুর পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রে দুর্নীতির প্রসঙ্গে কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ সময় বিদ্যুৎকেন্দ্রে বালিশ বিতর্কে জড়িত ব্যক্তির পরিচয় দেন তিনি। পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রের বালিশকাণ্ডের হোতা ছিলেন ছাত্রদলের নেতা। যিনি দায়িত্বে ছিলেন, তিনি বুয়েটে ছাত্রদলের নির্বাচিত ভিপি ছিলেন। তথ্য পাওয়ার পরপরই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছেন বলে সংসদকে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
আজ সোমবার জাতীয় সংসদে চলতি ২০১৮-১৯ অর্থবছরের সম্পূরক বাজেট নিয়ে বক্তব্যে বিষয়টি নিয়ে কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী। অর্থমন্ত্রীর অসুস্থতার কারণে তার পক্ষে প্রধানমন্ত্রী জাতীয় সংসদে সম্পূরক বাজেটের ওপর বক্তব্য রাখেন।
রুপপুর পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রে দুর্নীতির প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘একজন বালিশ তত্ত্ব নিয়ে এসেছেন। পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রের ওই ঘটনায় যিনি দায়িত্বে ছিলেন, তার কিছু পরিচয় আমরা পেয়েছি। একসময় তিনি বুয়েটে ছাত্রদলের নির্বাচিত ভিপিও নাকি ছিলেন। তাকে সেখান থেকে সরানোও হয়েছে। যখনই তথ্য পেয়েছি, সঙ্গে সঙ্গে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছি।’
এর আগে সম্পূরক বাজেট নিয়ে বক্তব্যের শুরুতে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বাজেট নিয়ে ভেতরে-বাইরে অনেক কথা হচ্ছে। কেউ কেউ এমনও বলছেন, বাজেট নাকি কিছুই না। যারা এ ধরনের মানসিকতা নিয়ে কথা বলছেন, তাদের কাছে আমার একটাই প্রশ্ন, বাজেট সঠিক না হলে মাত্র দশ বছরের মধ্যে বাংলাদেশ এত উন্নতি করলো কী করে?’
ব্যাংক খাতে লুট প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বলা হচ্ছে ব্যাংকে টাকা নেই। ব্যাংকে টাকা থাকবে না কেন? অবশ্যই টাকা আছে। তবে লুটে খাওয়ার টাকা নেই। ব্যাংক খাত যারা লুট করে নিয়ে গেছে তারা দেশান্তর হয়ে পড়ে আছে, অথবা দুর্নীতির দায়ে কারাগারে বন্দী। ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ফেরত দেয়নি, এ রকম বহু ঘটনা আছে। সময় এলে এ ব্যাপারে আরও আলোচনা করতে পারবো।’
বাজেট নিয়ে বিভিন্ন সমালোচনার জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘কেউ বলছেন, বাজেট দিয়েছেন, বাস্তবায়ন করতে পারেননি। বাজেট যদি বাস্তবায়ন করতে না পারি তাহলে ২০০৮ সালে মাত্র ৬১ হাজার কোটি টাকার বাজেট পেয়েছিলাম, আজকে সেখানে ৫ লাখ কোটি টাকার ওপরে চলে গেছে। বাস্তবায়নের দক্ষতা না থাকলে এটা করলাম কীভাবে?’
তিনি আরও বলেন, ‘সরকারের উন্নয়নের অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জন, জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন ইত্যাদি বিবেচনায় নিয়ে সরকারের রাজস্ব আদায় ও ব্যয়ের প্রাক্কলন করা হয়। এই প্রাক্কলন করতে গিয়ে সঙ্গত কারণেই আমরা কিছুটা বেশি করি। রাজস্ব আদায়ে খানিকটা উচ্চাভিলাষী হওয়ার প্রয়োজনীয়তাও রয়েছে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের উচ্চাভিলাষ না থাকলে এসব অর্জন সম্ভব হতো না। বাজেট বাস্তবায়ন, পরিসংখ্যান, সবই প্রমাণ করে আমাদের লক্ষ্য সব সময়ই বাস্তবভিত্তিক ছিল। বাস্তবতার কারণেই আমাদের বাজেটে কিছুটা সংশোধন, সংযোজন, পরিমার্জন, পরিবর্ধনের প্রয়োজন হয় এবং প্রতিবছরই আমরা এটা করে থাকি। এটা সব দেশের বাজেটেই হয়ে থাকে।’
সম্পূরক বাজেটে হ্রাস-বৃদ্ধির কারণ ব্যাখ্যায় প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বাজেটে জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার ৭.৮ শতাংশ অনুমান করেছিলাম। সংশোধিত বাজেটে তা আমরা ৮.১৩ শতাংশ হবে বলে আজ অনুমান করছি। সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় জিডিপির প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ৭.৬ শতাংশ নির্ধারণ হয়েছিল, এটি আমরা সাফল্যজনকভাবে অতিক্রম করতে সক্ষম হবো বলে আশা করছি। মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৬ শতাংশ অনুমান করা হলেও সংশোধিত মূল্যস্ফীতি ধারণা করা হয়েছে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ। বাজেট পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে অত্যন্ত সতর্ক থাকার জন্যই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হয়েছি।’
প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ‘অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশ এখন যথেষ্ট দক্ষতার পরিচয় দিয়েছে বলেই আমরা উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জনে বিশ্বের অনেক দেশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারছি। এটা দেখে সারাবিশ্ব আজ অবাক হচ্ছে। বাংলাদেশ বিশ্বের কাছে এখন উন্নয়নের বিস্ময়। যেখানে যাই সেখানেই সেই কদরটা পাই। দেশবাসী সেই সম্মানটা পায়। কাজেই অযথা কিছু কথা বলে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত না করাই ভালো। আমরা কাজই না করলে দারিদ্র্যের হার ৪০ ভাগ থেকে ২১ ভাগে নেমে আসত না। আমরা এই ২১ ভাগ থেকে আরও নামিয়ে আনবো। দেশ এগিয়ে যাচ্ছে, আমরাও এগিয়ে যাব।’
সম্পূরক বাজেটের ছাঁটাই প্রস্তাবের জবাব দিতে গিয়ে গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রীর পক্ষে বক্তব্য দিতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ‘এখানে (বিএনপিতে) এমন এমন লোক রয়ে গেছেন, তারা জন্ম থেকেই তাদের চরিত্র দুর্নীতির। তার কারণও আছে। এই দলটি (বিএনপি) যিনি করেছিলেন, তিনি সেনাপ্রধান থাকা অবস্থায় সংবিধান ও সামরিক আইন লঙ্ঘন করে পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট খন্দকার মোশতাকের সঙ্গে হাত মিলিয়ে জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর খুনিদের ইনডেমনিটি অর্ডারটাকে ভোটারবিহিন পার্লামেন্টে আইন হিসেবে পাস করিয়ে দিয়েছেন তিনি। অস্ত্রের মুখে সায়েম সাহেবকে ক্ষমতা থেকে হটিয়ে দিয়ে নিজেকে নিজে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করে ক্ষমতায় এসেছিলেন জিয়া। ক্ষমতায় দখল করার পর তাদের হাতে যে দল গড়ে ওঠে, তাদের চরিত্রটা জানা উচিত। তাদের উৎসটাই হচ্ছে দুর্নীতি। দুর্নীতির মধ্যে থেকে উঠে আসা।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘পঁচাত্তরের পর থেকে দুর্নীতিটাকে নীতি হিসেবে গ্রহণ করে যারা দীর্ঘদিন রাষ্ট্রপরিচালনা করেছে সব জায়গায় এই ঝঞ্ঝাট ছড়িয়ে ছিটিয়ে রেখে গেছে।’
এ সময় পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রের দুর্নীতি ও বালিশ তত্ত্ব নিয়ে কথা বলেন সংসদনেতা। বলেন, ‘বালিশতত্ত্ব নিয়ে আমারও একটা প্রশ্ন আছে। পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র সেখানে গড়ে উঠছে; সেখানে আর কিছু না পেয়ে পেলো বালিশ। এটা কোন বালিশ। কী বালিশ, সেটাও একটা প্রশ্ন? এটা কী তুলার বালিশ? কোন তুলা? কার্পাস তুলা না শিমুল তুলা; নাকি সিনথেটিক তুলা। নাকি জুটের তুলা। আর বালিশ নিয়ে রাস্তায় আন্দোলন করতে দেখলাম। এত মানুষ, এত বালিশ একদিনে কিনে ফেললো কীভাবে? এই বালিশ কেনার টাকার জোগানদারটা কে? সেটা আর বলতে চাই না।’
সংরক্ষিত আসনের এক এমপির প্রতিবার সংসদ সদস্য হওয়ার পর প্লটের দাবির প্রশ্নে বলেন, ‘এই প্রস্তাবটা শুনে খুব ভালো লাগলো। আমি ৭ বারের এমপি। এ পর্যন্ত একবারও প্লট পাইনি। মাত্র একবারই একটি বুলেটপ্রæফ গাড়ি আমার দল কিনে দিয়েছিল। ওটা দিয়েছিল বলেই ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা থেকে রক্ষা পেয়েছিলাম। প্রতিবার নিতে হবে, এটা ঠিক নয়।’
বর্তমান সরকার দুর্নীতি করতে ক্ষমতায় আসেনি উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘দুর্নীতির অপবাদ দেওয়ার চেষ্টা আমার বিরুদ্ধে বহুবার হয়েছে। বিএনপি-জামাত জোট আমার নিজের বিরুদ্ধে দিয়েছিল এক ডজন মামলা। নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে শত শত মামলা। কিন্তু একটাও তো প্রমাণ করতে পারেনি। ওয়ার্ল্ড ব্যাংকও দুর্নীতির অভিযোগ এনেছিল। প্রমাণ করতে পারেনি। আমেরিকার এফবিআই ও স্টেট ডিপার্টমেন্ট থেকে শুরু করে পৃথিবীর এমন কোনও সংস্থা নেই যে, তদন্ত না করেছে। কিন্তু কোনো দুর্নীতি আমার বা আমার পরিবারের বিরুদ্ধে করতে পারেনি। দুর্নীতির কোনো তথ্য না পেয়ে তারা বলতে বাধ্য হয়েছে সব অভিযোগ ভুয়া।’
সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতি প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, ‘দুর্নীতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া একান্ত প্রয়োজন। কিন্তু সরকারি চাকরিতে একবার ঢুকলে সেখান থেকে আর বের করা যায় না। তবে, দুর্নীতি দমন কমিশন এখন স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে।’
গণফোরামের সংসদ সদস্য মোকাব্বির হোসেনের সুশাসন বিষয়ক বক্তব্যের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘তিনি যে দল থেকে এসেছেন, তার দলে কি ডিসিপ্লিনটা আছে? সেটাও আমার প্রশ্ন? যার নিজের দলে সুশাসন নেই, গণতন্ত্র নেই, শৃঙ্খলা নেই, যেখানে কেউ কথা বলতে গেলেই বলা হয় খামোশ। তার থেকে কী আসা করা যায়?’
Comment here