আহমদুল হাসান আসিক : দেশে ধর্ষণের ঘটনা উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে; বাড়ছে ধর্ষণের পর হত্যা করার মতো নৃশংস কা-ও। একাধিক মানবাধিকার সংস্থার পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গত ৮ বছরে ৮ হাজারেরও বেশি ধর্ষনের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ধর্ষণের পর মেরে ফেলা হয়েছে অন্তত ৬শ জনকে। কেন বাড়ছে এমন পাশবিক কাণ্ড? কেন বাড়ছে এমন বর্বরোচিত হত্যা?
সমাজবিজ্ঞানী, মনোবিজ্ঞানী ও অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অধিকাংশ ঘটনার বিচার হয় না, অপরাধীরা পার পেয়ে যায়। মূলত বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণেই এমন অনাকাক্সিক্ষত, অসভ্য ঘটনা বাড়ছে। এর পাশাপাশি মূল্যবোধ, নৈতিকতা ও সামাজিক অবক্ষয়ও এর জন্য দায়ী। এছাড়া যৌনবিষয়ক শিক্ষা ও পারিবারিক শিক্ষার অভাব; আকাশ-সংস্কৃতির সর্বগ্রাসী বিস্তার এ ধরনের অপরাধের প্রবণতা বাড়িয়ে দিচ্ছে। রয়েছে প্রযুক্তির অপব্যবহারও। বছরে সহস্রাধিক ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে জানিয়ে
মানবাধিকার সংস্থাগুলোই বলছে, বাস্তবে এ সংখ্যাটি আরও অনেক বেশি। কারণ অনেক ক্ষেত্রেই সামাজিক মর্যাদার কথা চিন্তা করে কাউকে বিষয়টি জানানো হয় না; আইনের আশ্রয় নেওয়া হয় না। এ কারণে ধর্ষণের অনেক ঘটনা আড়ালেই থেকে যায়।
পুলিশ সদর দপ্তরের জুলাই ২০১৯ থেকে সেপ্টেম্বর ২০১৯ পর্যন্ত সময়কালের এক পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, দেশে নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে করা মামলার ৫১ দশমিক ৬২ শতাংশই ধর্ষণের মামলা, সংখ্যায় ১,৯২৪টি। নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে করা মামলার ক্ষেত্রে সাজাপ্রাপ্তির হারও উদ্বেগজনক। মাত্র ১১ দশমিক ২৬ শতাংশ মামলায় সাজা হয়েছে। এপ্রিল ২০১৯ থেকে জুন ২০১৯ সময়কালের আরেক পরিসংখ্যানেও দেখা গেছে, নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে করা মামলার ৫২ দশমিক ১০ শতাংশই ধর্ষণের। এ সময়কালে সাজার হার সাকুল্যে ১০ দশমিক ২৭ শতাংশ, যা সামাজিক অবক্ষয় বৃদ্ধির বার্তাবাহী।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের তথ্যানুযায়ী, গত ৮ বছরে ধর্ষণ-গণধর্ষণের কা- ঘটেছে ৮,০৭৮টি এবং ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৬২৬ জনকে। শুধু ২০১৯ সালে সারাদেশে ধর্ষণ-গণধর্ষণের কা- ঘটেছে ১৬০৭টি আর ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৭৭ জনকে। এছাড়া ধর্ষণের শিকার হয়ে লোকলজ্জায় আত্মাহুতি দিয়েছেন ১৯ নারী। তদুপরি ধর্ষণচেষ্টার ঘটনা ঘটেছে ২৫৪টি। ২০১৮ সালেও ধর্ষণকা- ঘটেছে গত বছরের তুলনায় প্রায় অর্ধেক, ৮৭৯টি। সে বছর ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৬৩ জনকে এবং ধর্ষণচেষ্টার ঘটনা ১২৮টি।
উদ্বেগজনক এ পরিসংখ্যানের বিষয়ে সংস্থাটির আইনি সহায়তাকারী অ্যাডভোকেট মাকসুদা আক্তার লাইলী আমাদের সময়কে বলেন, ধর্ষণের ক্ষেত্রে তো বিচার হয় না। আর বিচার না হলে এমন কা- তো বাড়বেই। তিনি যোগ করেন, আইনে আছে ১৮০ দিনের মধ্যে বিচার হতে হবে। কিন্তু বাস্তবে বিচার হতে ৮ থেকে ১০ বছর লেগে যায়। বিচারের এ দীর্ঘসূত্রতা তো রয়েছেই, এর সঙ্গে যোগ হয়েছে বিচারকার্যে রাজনৈতিক প্রভাবও। সব মিলিয়ে বিচারহীনতার কারণে বেড়েই চলছে এমন অনাকাঙ্খিত, অসভ্য কা-। এছাড়া প্রযুক্তির অপব্যবহারও ধর্ষণকা- বৃদ্ধির কারণ।
মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) পৃথক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে-ধর্ষণসহ নারীর প্রতি সহিংসতা দিনদিন বাড়ছে। ২০১৯ সালে ১,৪১৩ নারী ধর্ষিত হয়েছেন যা ২০১৮ সালে ছিল এর প্রায় অর্ধেক, ৭৩২ জন? এছাড়া ২০১৭ সালে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৮১৮ নারী। এদিকে ২০১৯ সালে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৭৬ জনকে। আর আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছেন ১০ নারী।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও নারী অধিকারকর্মী রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, দেশে ধর্ষণের ঘটনা বারবার ঘটছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিচার পাওয়া যায় না বা বিচার হচ্ছে না। বেশিরভাগ ঘটনায় কিছুদিন আমরা সবাই নাড়াচাড়া করি, লাফঝাপ করি, প্রতিবাদ করি, বিক্ষোভ করি; গণমাধ্যমও সোচ্চার ভূমিকা পালন করে। এর পর? ধীরে ধীরে এসব বিষয় হারিয়ে যায়। একদিকে বিচার প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতা, অন্যদিকে প্রভাব প্রতিপত্তি ও অর্থের নেতিবাচক প্রভাবে অনেক সময় বিচার নিশ্চিত করা সম্ভব হয় না। এ কারণে অপরাধীরা পার পেয়ে যায়। এ অপসংস্কৃতির উত্তরন না হলে এ ধরনের ঘটনা ঘটতেই থাকবে, থামানো যাবে না।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক, মনোরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. মোহিত কামাল আমাদের সময়কে বলেন, যারা ধর্ষণের মতো কা- ঘটাতে পারে, তাদের বিবেকবোধ, মূল্যবোধ ও নৈতিকতা মোটেও নেই। আমরা তথ্যপ্রযুক্তির উৎকর্ষতায় যেমন সুফল পাচ্ছি, পাশাপাশি পাচ্ছি কিছু কুফলও। এখন অল্প বয়সী ছেলে-মেয়েরা মুঠোফোনে এক ক্লিকেই যে কোনো অশ্লীল ওয়েবসাইটে প্রবেশ করতে পারে যা তাদের মস্তিষ্কে ছাপ ফেলছে; ভোগবাদী সত্তাকে জাগিয়ে তুলছে এবং তাদের নৈতিক সত্তাকে অবদমন করছে। এ কারণেই মূল্যবোধ ও নৈতিকতার অবক্ষয় ঘটছে। এছাড়া শিক্ষার অভাবও এসব কা- বৃদ্ধির একটি কারণ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক নেহাল করিম আমাদের সময়কে বলেন, এ ধরনের ঘটনা খুবই দুঃখজনক। এটা যারা করে, তাদের মূল্যবোধ, নৈতিকতা ও সততার অভাব আছে। পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সীমাবদ্ধতা আছে। রাজনৈতিক প্রভাবও রয়েছে, রয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও পরিবার থেকে শিক্ষাপ্রাপ্তির অভাব। এগুলো আমলে নিতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান আমাদের সময়কে বলেন, আকাশ-সংস্কৃতির কারণে সমাজে যেসব বিষয় আসছে, সেগুলো ধারণের মতো মানসিক সক্ষমতা আমাদের নেই। এ কারণে ধর্ষণই শুধু নয়, অন্যান্য অপরাধও বাড়ছে। আমাদের মনস্তত্ত্বে যে নেতিবাচক পরিবর্তন এসেছে, কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে এর উত্তরণ প্রয়োজন; সচেতনতামূলক কার্যক্রম নিতে হবে। যৌনবিষয়ক শিক্ষা নিয়েও আমাদের দেশে তেমন কোনো কার্যক্রম নেই। অথচ এগুলো আধুনিক সমাজের পথচলায় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ধীরে ধীরে ধাপের পর ধাপ পেরিয়ে সে অবস্থায় পৌঁছতে হবে আমাদের। এছাড়া ক্রিমিনাল জাস্টিস সিস্টেমেও সমস্যা আছে যা খুবই ভয়ঙ্কর। এতে ভুক্তভোগীর অধিকার সুনিশ্চিতের অবকাশ নেই। হাজার হাজার মামলা ঝুলে আছে। বিচার-ব্যবস্থা ঢেলে সাজাতে না পারলে এ সমস্যা ও অবক্ষয়ের উত্তরণ ঘটানো সম্ভব নয়।
Comment here