বাঙালির সর্বজনীন উৎসব পহেলা বৈশাখ। তবে এই উৎসব ঘিরে আনন্দ উদযাপনের পাশাপাশি অর্থনীতিতে যোগ হয়েছে নতুন মাত্রা। ইতোমধ্যে বৈশাখের হাওয়া লেগেছে দেশের অর্থনীতিতে। বৈশাখের অর্থনীতির সুনির্দিষ্ট অফার নিয়ে এখনো প্রাতিষ্ঠানিক কোনো গবেষণা হয়নি। তবে সূত্রের হিসাবে লেনদেনের সম্ভাব্য পরিমাণ হবে ১০ থেকে ১২ হাজার কোটি টাকা।
বিভিন্ন ডিজাইনের পোশাক, রকমারি বাঙালি খাবার, কার্ড ও মোবাইলে শুভেচ্ছা বিতরণ, মেলা ও হালখাতার মধ্য দিয়ে শেষ হবে উৎসব। ব্যাংকগুলোর ক্রেডিট কার্ডে রয়েছে আকর্ষণীয় অফার। ফ্যাশন হাউসগুলোয় বাহারি রঙ ও ডিজাইনের বাঙালি পোশাকের সমারোহ। ফুটপাত থেকে শুরু করে নামিদামি শপিংমল পর্যন্ত সবখানে বৈশাখের ছাপ পড়েছে। এপ্রিল মাসে বেতনের সঙ্গে প্রায় ৬০০ কোটি টাকার উৎসবভাতা পাবেন সরকারি চাকরিজীবীরা, যার পুরোটাই মূলত বৈশাখের বিভিন্ন খাতে খরচ হবে।
রাজধানীর বিপণিবিতানগুলো ঘুরে দেখা গেছে, বাঙালির প্রাণের উৎসব বৈশাখী আয়োজন ঘিরে সাদা-লালে ছেয়ে গেছে। এ ছাড়া বৈশাখ উপলক্ষে ছাড় দিচ্ছে বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠান। একই সঙ্গে উৎসবভাতা প্রদানে সব ধর্মের মানুষ ভিড় করছেন মার্কেটগুলোয়। রাজধানীসহ সারাদেশে সাড়ে ৫-৬ হাজার বুটিক ও ফ্যাশন হাউস ও ২৬ লাখ ছোট-বড় দোকান রয়েছে। এ ছাড়া বৃদ্ধি পেয়েছে অনলাইনে কেনাবেচার হারও। ব্যবসায়ীরা বলছেন, বছরে যেসব কেনাকাটা হয়, তার ২০ শতাংশই বৈশাখে। দুই ঈদে মিলে ৬০ শতাংশ। বাকিটা সারা বছর।
সে হিসাবে পহেলা বৈশাখকে কেন্দ্র করে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার পোশাক, গহনা ও বিভিন্ন ধরনের শোপিস বিক্রি হয়। বৈশাখে শাড়ি, পাঞ্জাবি ও ফতুয়া নিয়ে ব্যস্ত নামিদামি ব্র্যান্ডের শোরুমÑ বিশেষ করে আড়ং, অঞ্জনস, দেশীদশ, নবরূপা, মেট্রো, জেন্টালপার্ক, ইনফিনিটি, ক্যাটস আইসহ দেশের শীর্ষ ব্র্যান্ডগুলো বৈশাখী পোশাকের পসরা সাজিয়েছে। বিভিন্ন ধরনের পোশাক ৫ থেকে ৫০ শতাংশ মূল্যছাড়ে বিক্রি হচ্ছে। সিপিডির অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, বৈশাখের কারণে সরকারি চাকরিজীবীদের বোনাস (উৎসবভাতা)। এই বাড়তি টাকা আসায় কিছু মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে। এতে মূল্যস্ফীতিতেও কিছুটা প্রভাব পড়তে পারে।
বৈশাখ ঘিরে দেশের বিভিন্ন স্থানের ফুল ব্যবসায়ীদের ব্যবসা চাঙ্গা হয়ে যায়। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রতিদিন রাজধানীতে পাইকারি বাজারে ৪০-৫০ লাখ টাকার ফুল কেনাবেচা হয়। আর বিশেষ বিশেষ দিবসে (পহেলা বৈশাখ) ১০-১২ কোটি টাকার ফুল বিক্রি হয়। সেই হিসাবে বৈশাখ ঘিরে ৬০-৭০ কোটি টাকার ফুল বিক্রির টার্গেট করেছে ব্যবসায়ী সমিতি। বর্ষবরণ কেন্দ্র করে দই-মিষ্টিসহ বেকারিজাত পণ্যের বেচাকেনারও ধুম পড়ে। একসময় বৈশাখের প্রথম দিনটিতে ব্যবসায়ীরা হালখাতা খুলে নতুন বছরটিকে স্বাগত জানাতেন।
কালের আবর্তনে হালখাতার রেওয়াজ হারিয়ে গেলেও মিষ্টি দিয়ে দিনটি শুরু করেন বেশিরভাগ ব্যবসায়ী। অন্যদিকে প্রতিবছরের মতো এবারও শুভেচ্ছা কার্ড ও বাংলা নববর্ষের ক্যালেন্ডার উপহার দিয়েছে বিভিন্ন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান। এতে মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানগুলোর কাজ এরই মধ্যে শেষ হয়েছে। বাকি রয়েছে কিছু কার্ড বিক্রি। সব মিলিয়ে মুদ্রণশিল্পে বৈশাখ ঘিরে আনুমানিক ১২-১৪ কোটি টাকার লেনদেন হবে বলে আশা প্রকাশ করেন মুদ্রণশিল্প সংশ্লিষ্টরা। ক্রেতা আকর্ষণে বিভিন্ন কোম্পানি বিশেষ মূল্যছাড় দিয়েছে।
গত তিন বছরে অনলাইনে কেনাকাটায় গ্রাহকের আগ্রহ ব্যাপকভাবে বেড়েছে। তবে পহেলা বৈশাখের উৎসবের মূল আকর্ষণ ইলিশ। বর্তমানে ইলিশ ধরা নিষিদ্ধ থাকলেও বিভিন্ন হিমঘরে মজুদ করা ইলিশ বাজারজাত শুরু করেছেন ব্যবসায়ীরা। পিছিয়ে নেই নিত্যপণ্য, ফুল, মৃৎশিল্প এবং গহনা ব্যবসায়ীরা। গ্রাম থেকে শহর সর্বত্রই বৈশাখ ঘিরে জমজমাট।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, পহেলা বৈশাখকে কেন্দ্র দেশে বাড়তি চাহিদা তৈরি হয়। চাহিদার বিপরীতে সরবরাহ ঠিক রাখতে পারলে এই উৎসব পুরোটাই ইতিবাচক বলা যায়। বৈশাখে যে যেখানে থাকে, সেখানেই উৎসব পালন করে। ফলে এ উৎসব এককেন্দ্রিক নয়। বৈশাখ উপলক্ষে বিভিন্ন কোম্পানি বিশাল ছাড় দিচ্ছে।
র্যান্ডের জুতা কোম্পানি বাটা এবং অ্যাপেক্সে ৭০ শতাংশ পর্যন্ত মূল্যছাড় দেওয়া হয়েছে। ছাড় রয়েছে বিভিন্ন ইলেকট্রনিক পণ্যেও। এ ছাড়া বিভিন্ন ব্যাংক ক্রেডিট কার্ডের বিপরীতে গ্রাহককে ছাড় দিচ্ছে। নির্দিষ্ট শপিংমলে বা অনলাইনে ৩৫ শতাংশ পর্যন্ত ছাড় দিচ্ছে সিটি ব্যাংকের আমেরিকান এক্সপ্রেস। এ ছাড়া ভিসা ও মাস্টারকার্ডেও ছাড় রয়েছে। হোটেল-রেস্তোরাঁ ও পর্যটন কোম্পানিগুলো বিশেষ ছাড় দিচ্ছে।
Comment here