ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ভাড়া - দৈনিক মুক্ত আওয়াজ
My title
সারাদেশ

ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ভাড়া

সাজ্জাদ মাহমুদ খান : অবৈধ লেনদেনের ঝুঁকি এড়াতে নিজেদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টের পরিবর্তে অন্যদের অ্যাকাউন্ট ভাড়া নিচ্ছে প্রভাবশালী অপরাধীচক্র। উপহার দেওয়ার নামে বিদেশিদের প্রতারণা, ‘হ্যালো পার্টি’, অবৈধ পণ্য বিক্রি, অপহরণ ও মাদকসহ নানা অপরাধের লেনদেন এসব অ্যাকাউন্টের (ব্যাংক হিসাব) মাধ্যমে করা হয়, যার অ্যাকাউন্টে অর্থ জমা হয়, তিনি পান ৫ শতাংশ। দেশে শত শত ব্যাংক অ্যাকাউন্ট এভাবে ভাড়ায় খাটানোর চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে আমাদের সময়ের অনুসন্ধানে।

এসব ‘ভাড়াটে অ্যাকাউন্টে’ কোটি কোটি টাকা লেনদেন হয়। চক্রগুলো যে কৌশলে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ভাড়া করে অপরাধ করে, তেমনি একটি ঘটনার সূত্রপাত ঘটে রাজধানীর বিমানবন্দর এলাকায়। সেখানে পাখি কেনাবেচা করেন কায়েস হোসেন নামে এক ব্যক্তি। হঠাৎ একদিন এক ‘ভিআইপি ক্রেতা’ একসঙ্গে তার অনেক পাখি কিনে নেন। ক্রেতার সঙ্গে কায়েসের সখ্য গড়ে ওঠে। পাখি কেনার টাকা নগদে পরিশোধ না করে তিনি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা দিতে চান; কিন্তু কায়েসের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নেই জানার পর ক্রেতা নিজেই ছবি তুলে আর কাগজপত্রে সই নিয়ে অ্যাকাউন্ট করে দেন। কায়েসের নামে একটি মোবাইল সিমও কেনেন। এর পর অনেক চেকবইয়ে কায়েসের স্বাক্ষর নেন। তাকে দিয়ে কয়েকটি ব্যাংকের এটিএম কার্ডও তোলেন। এভাবে একে একে ১৮টি ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট খোলা হয় কায়েসের নামে। কায়েসের নামের অ্যাকাউন্টে প্রতিদিনই জমা হতে থাকে টাকা। সেই টাকার ৫ শতাংশ ভাগ দেওয়া হয় কায়েসকে। এক পর্যায়ে কায়েস পরিচিতদের অ্যাকাউন্টও ভাড়া দেওয়ার লোভে পড়ে যান। এভাবে কায়েসের মতো অসংখ্য মানুষ জড়িয়ে পড়ে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ভাড়া দেওয়ার অসাধুচক্রে।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, কায়েসের মতো হামিদুর রহমান, হারুনুর রশিদ, শাহীন ও ফাতেমা আক্তারসহ বিভিন্ন মানুষের শতশত ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ভাড়ায় খাটে। এসব লোক প্রথমে ফাঁদে পড়ে ভুলে, পরে পড়ে লোভে।

রাজধানীর পার্শ্ববর্তী কেরানীগঞ্জের হামিদুর রহমানের ৩৫টি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ২০২০ সাল থেকে ভাড়ায় খাটে। হামিদুর রহমান ও তার প্রতিষ্ঠান হামিদুর এন্টারপ্রাইজ নামে খোলা হয় এসব ব্যাংক অ্যাকাউন্ট। তার অ্যাকাউন্টে আসা অবৈধ অর্থের ৫ শতাংশ তিনি পান। অনুসন্ধানের তথ্য বলছে, দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের চুনকুটিয়ায় কাপড়ের ব্যবসা করতেন হামিদুর রহমান। কাপড়ের ক্রেতা হিসেবে তার সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলেন বিপ্লব লস্কর। দ্রুত ধনী হওয়ার লোভ দেখিয়ে বিপ্লব লস্কর হামিদুরের জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) ও ছবিসহ কাগজপত্র নিয়ে নেন। এর পর একে একে ৩৫টি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট করা হয় হামিদুর ও তার প্রতিষ্ঠানের নামে। প্রতিদিন টাকাও আসতে থাকে হামিদুরের অ্যাকাউন্টে। বিপ্লব লস্করের সহযোগীরা সেই টাকা ব্যাংক থেকে তোলার পর শতকরা ৫ ভাগ হামিদুরকে দিয়ে দেন। সম্প্রতি প্রতারিত ব্যক্তিরা ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নম্বর উল্লেখ করে মামলা করলে হামিদুরের নাম বেরিয়ে আসে।

এদিকে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) কাছে তথ্য রয়েছে- এই বিপ্লব লস্করই বিমানবন্দর এলাকার কায়েসের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ভাড়া করেন। তিনি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ভাড়া করে নিজের অপরাধীচক্রের পাশাপাশি অন্যান্য অপরাধীচক্রকেও ভাড়া দেন।

অভিনব এই প্রতারণা ও অপরাধের কিছু তথ্য তুলে ধরে সিআইডির সাইবার পুলিশ সেন্টারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মাহমুদুল ইসলাম তালুকদার আমাদের সময়কে বলেন, ‘দেশি-বিদেশিদের সমন্বয়ে প্রতারণার বিভিন্ন চক্র রয়েছে। বিদেশি নাগরিকের সঙ্গে মিলে এ দেশের অপরাধীরা চক্র গড়ে তোলে। এসব চক্র প্রতারণার মাধ্যমে আদায় করা অর্থ বিভিন্ন ব্যাংক অ্যাকাউ ন্টের মাধ্যমে নেয়। টাকা নেওয়া এসব অ্যাকাউন্ট প্রতারকচক্র ভাড়া করে। যে টাকা প্রতারণা করে আনা হয়, তার একটি ভাগ অ্যাকাউন্টের মালিককে দেওয়া হয়। প্রতারকচক্রের কিছু সদস্য নিয়ে আমরা কাজ করছি।’

বরিশালের মেহেন্দিগঞ্জের যুবক আরিফুল ইসলামের সঙ্গে ২০২০ সালে মার্কিন নাগরিক পরিচয় দেওয়া জেনিটরের পরিচয় হয় ফেসবুকে। কিছুদিন পর আরিফুলের জন্য উপহার পাঠানোর কথা বলেন জেনিটর। জেনিটরের উপহার নেওয়ার জন্য কাস্টমস কর্মকর্তা পরিচয়ে বাংলাদেশ থেকে ফোনও দেন এক নারী। এর পর কাস্টমসের মালামাল ছাড়ানোর ট্যাক্সসহ বিভিন্ন অজুহাতে আরিফুলের কাছ থেকে কয়েক দফায় ২১ লাখ ৬২ হাজার টাকা হাতিয়ে নেয়। এর মধ্যে রাজধানীর ভাটারায় ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের শাখায় জাকির হোসেন নামে এক ব্যক্তির অ্যাকাউন্টে নেওয়া হয় ৫১ হাজার টাকা। মিরপুর ১০-এ ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের বোরহান উদ্দিনের হিসাবে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা এবং ইউসিবি ব্যাংকের নবাবপুর শাখায় অমিত কর নামে অপর ব্যক্তির ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ৫ লাখ ৩২ হাজার টাকা নেওয়া হয়। এ ছাড়া যাত্রাবাড়ীর সাকিবুল, গৌরীপুরের আনিস মোল্লা ও হামিদুর এন্টারপ্রাইজের ব্যাংক হিসাবে বিভিন্ন অংকে টাকা নেওয়া হয়।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, আরিফুলের কাছ থেকে হাতিয়ে নেওয়া ২১ লাখ ৬২ হাজার টাকাই আট ব্যক্তির কাছ থেকে ভাড়া করা অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে। এই আটজনের প্রত্যেকের বিপুলসংখ্যক ব্যাংক অ্যাকাউন্ট রয়েছে। হামিদুরের ব্যাংক অ্যাকাউন্টসহ বেশির ভাগের অ্যাকাউন্ট ভাড়ার পেছনে বিপ্লব লস্কর ও তার সহযোগীদের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। বিপ্লব লস্কর ও তার সহযোগীদের নিয়ে দেশি-বিদেশি অর্ধশতাধিক ব্যক্তির একটি প্রতারকচক্র রয়েছে।

অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, বিপ্লব লস্করের মতো প্রতারণা ও অ্যাকাউন্ট ভাড়া দেওয়া-নেওয়ার আরেকটি চক্রের প্রধান হারুন অর রশিদ। দুটি কাগুজে প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তিনি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ভাড়া দেওয়া-নেওয়া এবং প্রতারণার জাল সারাদেশে বিস্তার করেছেন। এগুলো হচ্ছে- গার্মেন্টপণ্য স্টকের ‘এফএসকে ট্রেডিং কোম্পানি’ ও ‘পিউর বায়ো লিভিয়া সিড’ নামে একটি শস্যবীজের প্রতিষ্ঠান। হারুন অর রশিদের নামে পাঁচটি অ্যাকাউন্ট রয়েছে। তার প্রতিষ্ঠান এসএফকে ট্রেডিংয়ের নামে রয়েছে পাঁচটি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট। তার নিজের এবং অপর দুটি প্রতিষ্ঠানের নামে প্রতারণার ২ কোটি ৫৪ লাখ টাকা তিনি হাতিয়ে নিয়েছেন। নিজের অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে প্রতারণার টাকা জমা করার পাশাপাশি বিভিন্ন অ্যাকাউন্ট ভাড়া দেওয়া-নেওয়ার কাজও করেন তিনি।

সূত্র জানায়, হারুন অর রশীদ প্রথমে নিজের ও প্রতিষ্ঠানের নামে করা ব্যাংক অ্যাকাউন্টে টাকা লেনদেন করতেন। তাদের প্রতারণার বিষয়টি ধরা পড়ার শঙ্কায় পরে বিভিন্ন জনের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ভাড়া করেন। ভাড়া করা ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে নিজেদের প্রতারণার টাকা আনার পাশপাশি এসব অ্যাকাউন্ট তিনি ভাড়া দিতেন। এক্ষেত্রে ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মালিককে ৩ শতাংশ দিতেন এবং নিজে ২ শতাংশ কমিশন নিতেন।

এসব বিষয়ে জানতে হারুন অর রশিদ যে মোবাইল নম্বর ব্যবহার করেন, সেই নম্বরে আমাদের সময়ের পক্ষ থেকে একাধিকবার ফোন করা হয়। তবে প্রতিবারই ফোন বন্ধ পাওয়া গেছে।

পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, এ ধরনের ঘটনায় ভুক্তভোগী কেউ অভিযোগ জানালে মূল অপরাধীকে পাওয়া যায় না। ধরা পড়ে অ্যাকাউন্ট ভাড়া দেওয়া ব্যক্তিরা। তারা দ্রুতই ছাড়া পেয়ে যান। ছাড়া পেয়ে আবার অ্যাকাউন্ট ভাড়া দেন। ফলে প্রতারণার দেশি-বিদেশি হোতাদের আইনের আওতায় আনতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।

 

Comment here