সারাদেশ

ভোটের আগে নগদ টাকা রাখার প্রবণতা বেড়েছিল

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে মানুষের মধ্যে নগদ টাকা হাতে রাখার প্রবণতা বেড়ে গিয়েছিল। গত ৭ জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত এ নির্বাচনের আগের দুই মাস নভেম্বর ও ডিসেম্বরে ব্যাংকের বাইরে নগদ টাকা বেড়েছিল ৮ হাজার ৯০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ডিসেম্বরেই বাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকা। এর আগে টানা চার মাস ব্যাংকের বাইরে থাকা নগদ টাকা কমেছিল। সংশ্লিষ্টরা জানান, নির্বাচন ঘিরে সৃষ্ট রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, ভীতি ও নিরাপত্তাহীনতার আশঙ্কার পাশাপাশি নির্বাচনের খরচের জন্য মানুষ নগদ টাকা তুলে ঘরে রেখেছিলেন। কেউ কেউ টাকা তুলে বিদেশেও পাচার করেন। এর বাইরে উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণেও নগদ টাকা তোলার প্রবণতা বাড়তে পারে।

দেশের মোট প্রচলনে থাকা মুদ্রা থেকে ব্যাংকে জমানো টাকা বাদ দিয়ে প্রতি মাসে হালনাগাদ তথ্য প্রকাশ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ২০২৩ সালের ডিসেম্বর মাসের তথ্য গতকাল প্রকাশ করা হয়। এতে দেখা যায়, গত বছরের নভেম্বর মাসে ব্যাংকের বাইরে থাকা নগদ অর্থের পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৪৮ হাজার ৪৪১ কোটি টাকা। ডিসেম্বরে তা বেড়ে হয় ২ লাখ ৫৪ হাজার ৮৬০ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক মাসের ব্যবধানে ব্যাংকের বাইরে নগদ টাকা বেড়েছে ৬ হাজার ৪১৯ কোটি টাকা। গত বছরের নভেম্বরেও ব্যাংকের বাইরে নগদ অর্থ বেড়েছিল। অক্টোবরে ব্যাংকের বাইরে টাকা থাকার পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৪৫ হাজার ৯৪৩ কোটি টাকা। ফলে অক্টোবরের তুলনায় নভেম্বরে ব্যাংকের বাইরে নগদ টাকা বেড়েছিল ২ হাজার ৪৯৮ কোটি টাকা। সব মিলে নির্বাচনের আগের দুই মাসে ব্যাংকের বাইরে নগদ টাকা বাড়ে প্রায় ৮ হাজার ৯১৭ কোটি টাকা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি বেসরকারি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমাদের সময়কে জানান, নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তায় জনমনে ভীতি ও আতঙ্ক বিরাজ করছিল। ফলে গ্রাহকদের অনেকেই নগদ টাকা তুলে ঘরে নিয়ে রেখেছিলেন। আবার নির্বাচনের খরচের জন্যও টাকা তোলার চাপ বেড়েছিল। সব মিলে ব্যাংকের বাইরে নগদ অর্থের পরিমাণ বেড়েছিল। তবে এখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক। ফলে নগদ টাকা তোলার কোনো চাপ নেই।

জানা যায়, ২০২২ সালের শেষ দিকে কয়েকটি ব্যাংকের ঋণ অনিয়মের খবর জানাজানি হওয়ার পর ব্যাংক খাতের প্রতি মানুষের আস্থার সংকট তৈরি হয়। এরপর সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলো থেকে টাকা তুলে নিতে থাকেন গ্রাহকরা। আবার সে সময় ব্যাংকগুলোতে নতুন আমানত আসাও কমে যায়। এতে ওই ব্যাংকগুলোতে নগদ টাকার সংকট তৈরি হয়। এ ছাড়া দীর্ঘদিন ধরে দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে। এতে জীবনযাত্রার খরচ বেড়েছে। কিন্তু একই সময় মানুষের আয় খুব একটা বাড়েনি। আবার উচ্চ মূল্যস্ফীতির সময়ে ব্যাংকে আমানতের সুদের হার যেভাবে বাড়ার কথা সেভাবে বাড়েনি। এতে ব্যাংকে টাকা রেখে প্রকৃত অর্থে মুনাফা পাচ্ছিল না আমানতকারীরা। ফলে গত অর্থবছরে মানুষের মধ্যে নগদ টাকা হাতে রাখার প্রবণতা অস্বাভাবিক বেড়েছিল।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত জুন পর্যন্ত ব্যাংকের বাইরে তথা মানুষের হাতে নগদ টাকার পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৯১ হাজার ৯১৩ কোটি টাকা, যা ছিল এ যাবৎকালের সর্বোচ্চ। অর্থাৎ ২০২২ সালের জুন থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত এক বছরে মানুষের হাতে নগদ টাকা বৃদ্ধির পরিমাণ ছিল প্রায় সাড়ে ৫৫ হাজার কোটি টাকা বা সাড়ে ২৩ শতাংশ। এর মধ্যে জুন মাসেই ব্যাংকের বাইরের টাকার প্রবাহ বেড়েছিল প্রায় ৩৬ হাজার কোটি টাকা বা ১৪ শতাংশ। তবে চলতি অর্থবছরে এসে এই চিত্র বদলে যেতে থাকে। টানা চার মাস মানুষের হাতের টাকা ব্যাংকে ফিরতে শুরু করে। মানুষের হাতের টাকা ব্যাংকে ফেরার পেছনে তখন ৪টি কারণের কথা জানিয়েছিলেন অর্থনীতিবিদসহ সংশ্লিষ্টরা। এগুলো হলো- আমানতের সুদের হার বৃদ্ধি, নির্বাচনকে সামনে রেখে ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগে মন্দা, ফ্ল্যাট ও প্লটের রেজিস্ট্রেশন ব্যয় বৃদ্ধি এবং বাসায় টাকা রাখার নিরাপত্তাজনিত ঝুঁকি।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দীর্ঘদিন ধরে নয়-ছয় হিসেবে পরিচিতি পাওয়া সুদের হারের সীমা গত জুলাইতে তুলে দেওয়া হয়েছে। এরপর ব্যাংক খাতে ঋণ ও আমানতের সুদহার বাড়তে শুরু করেছে। ইতোমধ্যে ঋণের সুদহার আড়াই শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে ১২ শতাংশের কাছাকাছি পৌঁছেছে। এর সঙ্গে আমানতের সুদহারও বাড়ছে। তহবিল সংকটে থাকা কোনো কোনো ব্যাংক এখন ৯ শতাংশের বেশি সুদেও আমানত সংগ্রহ করছে। তারপরও জাতীয় নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, ভীতি ও আতঙ্ক থেকে মানুষের মধ্যে নগদ টাকা তোলার প্রবণতা বেড়েছিল বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনেও দেখা যাচ্ছে, নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসে ব্যাংকের বাইরে নগদ টাকা বেড়ে গিয়েছিল।

এদিকে ব্যাংকের বাইরে নগদ টাকার পরিমাণ বাড়ার পরও গত বছরের ডিসম্বরে ব্যাংকগুলোতে আমানত বাড়ে প্রায় ১৩ হাজার ২৫৮ কোটি টাকা। গত বছরের নভেম্বরে ব্যাংকগুলোর আমানত ছিল ১৬ লাখ ৪০ হাজার ৪৮৬ কোটি টাকা, ডিসেম্বরে যা বেড়ে হয় ১৬ লাখ ৫৩ হাজার ৭৪৪ কোটি টাকা। তবে একই মাসে আমানতের তুলনায় ঋণ বিতরণ বেড়েছে আরও বেশি। ওই মাসে ঋণ বৃদ্ধির পরিমাণ ছিল ২৪ হাজার ৩৪২ কোটি টাকা। গত ডিসেম্বর মাসে ব্যাংকগুলোর ঋণস্থিতি বেড়ে হয়েছে ১৯ লাখ ৪৮ হাজার ৪৪৯ কোটি টাকা। এর ফলে ব্যাংকগুলোতে তারল্য সংকট তৈরি হয়।

Comment here

Facebook Share