মমতাকে যে বিপদ সংকেত দিল আনন্দবাজার পত্রিকা! - দৈনিক মুক্ত আওয়াজ
My title
আন্তর্জাতিক

মমতাকে যে বিপদ সংকেত দিল আনন্দবাজার পত্রিকা!

লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে হাড্ডাহড্ডি লড়াই করে নরেন্দ্র মোদির বিজেপি ও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল কংগ্রেস। প্রচারণার শুরুতে মমতা দাবি করেছিলেন, পশ্চিমবঙ্গের ৪২টি আসনের সবকয়টিই আসতে যাচ্ছে তার ঝুলিতে।  কিন্তু শেষ পর্যন্ত তৃণমূলের জয় নিশ্চিত হলো ২২টি আসনে।  যেখানে বিজেপি পেয়েছে ১৮টি।  সন্দেহ নেই, মমতার কাছে এই ফল এক বড় সতর্কবার্তা।  কারণ শুধু আসন সংখ্যার নিরিখেই নয়, ভোটের ধরনেও মেরুকরণের ছবি স্পষ্ট।

আনন্দবাজার পত্রিকা বলছে, এই মেরুকরণকে নিছক সাম্প্রদায়িক বললে তা খণ্ড সত্য হবে।  এ কথা ঠিক যে, মমতা ঘোষিত ভাবেই সর্বদা সংখ্যালঘুদের পাশে দাঁড়িয়েছেন, এখনো দাঁড়ান। তার দিক থেকে বিজেপির হিন্দুত্বের রাজনীতির মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে রাজ্যে ৩০ শতাংশ সংখ্যালঘু ভোট নিজের দিকে টেনে রাখার প্রয়োজনীয়তা যে আছে, সেটাও হয়তো একেবারে অস্বীকার করা যায় না।

কিন্তু এর বাইরেও আরও একটি মেরুকরণ এ বার স্পষ্ট। যা অনেক বেশি রাজনৈতিক।  ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্ক্সবাদী) সংক্ষেপে সিপিএম এবং কংগ্রেস কার্যত মুছে যাওয়ার মতো অবস্থায় পৌঁছেছে এ বার।  সিপিএম একটি আসনও পায়নি।  ভোট মাত্র ৮ শতাংশ।  কংগ্রেস দুটি আসন পেলেও ভোট ৬ শতাংশও নয়।  অর্থাৎ শাসক এবং বিরোধী ভোট সরাসরি দুটি শিবিরে ভাগ হয়ে গেল।  যার অর্থ ২০২১-এ বিধানসভার লড়াই হবে মুখোমুখি— বিজেপির সঙ্গে তৃণমূলের।

লোকসভা ফলের ভিত্তিতে ভোট শতাংশে এখন উভয়ের ব্যবধান দাঁড়াল মাত্র ৩।  তৃণমূলের ৪৩, বিজেপির ৪০।  ২০১৬-র বিধানসভার চেয়ে এ বারের লোকসভায় তৃণমূলের ভোট প্রায় ২ শতাংশ কমেছে।  আর বিজেপির ভোট বেড়েছে ৩০ শতাংশ।

বিধানসভার ৮ কেন্দ্রের উপনির্বাচনে তো বিজেপির ভোট তৃণমূলকে ছাপিয়ে গিয়েছে। চারটি আসনে জিতে বিজেপি পেয়েছে ৪০ দশমিক ৫০ শতাংশ ভোট, তিনটি আসনে জয়ী তৃণমূল ৩৭ দশমিক ৪।  একটি জিতেছে কংগ্রেস।

মমতার পক্ষে এই সব হিসেব স্বস্তিজনক বলা চলে না। বরং ২০২১-এর জন্য এ এক ‘বিপদ’ সংকেত।  তবে প্রশ্ন, তিনি এটা কী ভাবে দেখবেন? আদৌ বিপদ বলে মানবেন কি?

প্রাথমিক বিশ্লেষণে তৃণমূল নেত্রীর মনে হয়েছে, দেশ জুড়ে বিরোধীদের যে অবস্থা, তার তুলনায় এ রাজ্যে তৃণমূলের ফল খারাপ নয়। পাশাপাশি, তার অভিযোগ, বিজেপির টাকার খেলা, কেন্দ্রীয় বাহিনীর ভূমিকা, ইভিএম কারচুপির মতো বিষয়গুলোও এড়িয়ে যাওয়ার নয়।  তাই কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গাঁধী নিজের দলের পরাজয়কে ‘আমার দায়’ বলে স্বীকার করে নিলেও মমতার ‘আমিত্ব’ তাকে এখনও তেমন কোনো উপলব্ধিতে পৌঁছে দেয়নি।

মমতাও বার বার হিসেব কষে ‘আশ্বস্ত’ ছিলেন, যতটা বলা হচ্ছে, বিজেপি ততটা বাড়তে পারবে না।

বিজেপি শুধু বেড়েছে তাই নয়, রাজ্যের ২৭টি গ্রামীণ লোকসভা কেন্দ্রের ১৫টিতে এগিয়ে গিয়েছে। রাজ্য রাজনীতিতে এটিও এক লক্ষণীয় বিষয়। সিপিএমের বিরুদ্ধে জনমত ঘুরতে শুরু করেছিল শহর থেকে। গ্রাম বাংলায় তাদের দুর্গ দীর্ঘদিন প্রায় অটুট ছিল। তাই কংগ্রেস বা পরবর্তী কালে তৃণমূল শহরে নিজেদের অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারলেও মূল ভিতে ঘা মারতে পারেনি।

শাসক তৃণমূলের উপরে মূল ধাক্কা এল গ্রাম বাংলা থেকেই। বৃহস্পতিবার রাত পর্যন্ত পাওয়া লোকসভা ফলের নিরিখে রাজ্যের ২৯৪টি বিধানসভা আসনের মধ্যে ১২৯টিতে ‘জয়ী’ বিজেপি। তৃণমূল ১৫৮টিতে।

পঞ্চায়েত নির্বাচনে সাধারণ মানুষের ভোট দিতে না পারার ক্ষোভ।  যা গ্রামের ভোটারদের উপর যথেষ্ট বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। যারা ভোট দিতে পারেননি, তাদের কাছে এ বারের লোকসভা নির্বাচনে ভোট দেওয়ার সুযোগ হয়তো ছিল এক ধরনের জবাব— ‘দেখ কেমন লাগে’। তাই গ্রামীণ লোকসভাগুলোতে তৃণমূলের অগ্রগতি রীতিমতো ধাক্কা খেয়েছে।

যে সব জায়গায় তৃণমূল বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পঞ্চায়েত জিতেছিল পরাজয়ের তালিকায় রয়েছে সেই সব এলাকার অনেক লোকসভা কেন্দ্র। যেমন, কোচবিহার, আলিপুরদুয়ার, জলপাইগুড়ি, বালুরঘাট, বনগাঁ, বাঁকুড়া, বিষ্ণুপুর, রানাঘাট, বর্ধমান-দুর্গাপুর, হুগলি, মেদিনীপুর ইত্যাদি।

অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কেন্দ্র ডায়মন্ড হারবারেও প্রায় ৯০ শতাংশ পঞ্চায়েত আসন বিনা ভোটে দখল করেছিল তৃণমূল। সেখানে অবশ্য এ বার অভিষেকের জয়ের ব্যবধান তিন লাখেরও বেশি। তবে, সেখানে আবার ফলতা, বজবজ, বিষ্ণুপুর, মহেশতলার মতো বিভিন্ন জায়গায় ‘সন্ত্রাসে’র ভোট হয়েছে বলে অভিযোগ বিরোধীদের। নির্বাচন কমিশন অবশ্য তা মানেনি।

তৃণমূলের নির্বাচনী ধাক্কার পিছনে আরও একটি বিষয় কাজ করেছে বলে মনে করা হচ্ছে।  তা হল দলের একাংশের ‘দাদাগিরি’। তৃণমূলের যারা সত্যি ‘তৃণস্তরে’ কাজ করে এসেছেন, তাদের একটি বড় অংশ মনে করছেন, ‘নব্য’ নেতৃত্বের দাপটে তারা আর কোনো জায়গা পাচ্ছেন না। দলে তাদের কোনো মর্যাদা নেই।  নতুনদের দাপটের বিরুদ্ধে ‘আদি’ তৃণমূলের সেই ক্ষোভের প্রতিফলনও বহু ক্ষেত্রে ভোটের মেশিনে ‘বিপ্লব’ ঘটিয়েছে বলে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের একাংশের ধারণা।

সেই ‘ক্ষোভ’ বিজেপি যদি আরও উস্কে দিতে চেষ্টা করে, তা হলে ২০২১-এর আগে তৃণমূলের ব্যথা বাড়বে ছাড়া কমবে না।

প্রসঙ্গত, তৃণমূল ছেড়ে আসা বিশ্বাসঘাতক বলে অভিহিত মুকুল রায় বৃহস্পতিবারই এই ইঙ্গিত দিয়েছেন।  বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্বও বলেছেন, তাদের সঙ্গে এ দিনই নাকি তৃণমূলের প্রায় ৫০ জন বিধায়ক যোগাযোগ করে ফেলেছেন।  এ কথার সত্যতা প্রমাণ করা এখনই সম্ভব নয়। তবে এই পরিস্থিতিতে তৃণমূলের রক্তচাপ কিছুটা বেড়ে যাক, সেটাও বিজেপির হিসেবি কৌশল। কারণ, তৃণমূলের কতিপয় নেতা-জনপ্রতিনিধির কথাবার্তা, গতিবিধি যে দলের আতস কাচের তলায় আছে, সবাই তা জানেন। বিজেপি অবশ্যই চেষ্টা করবে যাতে ওই সব নেতা তৃণমূল ছেড়ে বেরিয়ে আসেন।

এমনকি, বিধায়কদের মধ্যে ‘ভাঙন’ ধরানোর জন্যও তারা সক্রিয় হবে। এক বিজেপি নেতার কথায়, ‘‘তৃণমূল যে ভাবে অন্য দল থেকে বিধায়ক ভাঙিয়ে এনেছিল, এই কৌশল হবে তার বদলা।’’

সাধারণ নিয়মে বিধানসভা ভোট হবে আরও বছর দুয়েক পরে।  সদা পরিবর্তনশীল রাজনীতি তত দিনে আরও কী মোড় নেবে এখনই নিশ্চিত করে তা কেউ বলতে পারে না। সবাই জানেন, ধাক্কা খেয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর অভিজ্ঞতা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আছে এবং তাতে তিনি বার বার সফল হয়েছেন, এটাই ইতিহাস।

তা-ই এ বারেও লোকসভা ভোটের ফলাফল বিচার করে তিনি কী পদক্ষেপ নেবেন, দলের অন্দরে ক্ষমতার ‘পুনর্বিন্যাস’ করে পুঞ্জিভূত ক্ষোভের নিরসন করবেন কি না, বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের সুফল যাতে মাঝপথে ‘নিশ্চিহ্ন’ হয়ে না যায়, তা নিশ্চিত করবেন কি না, ‘নব্য’ নেতৃত্বের দাপটে কড়া হাতে লাগাম টানবেন কি না, এ সব অনেক কিছুর উপর নির্ভর করবে তৃণমূলের ভবিষ্যৎ।

সর্বোপরি বাকি থাকে ধর্মীয় মেরুকরণের ভোট। যা এ রাজ্যেও এ বার বেশ কিছুটা হয়েছে।  জেলাতে তো বটেই, খাস কলকাতাতেও এলাকাভিত্তিক ফলে সেই ছবি ধরা পড়ে। রাসবিহারী, ভবানীপুর, জোড়াসাঁকো, শ্যামপুকুর, মানিকতলার মতো এলাকায় তৃণমূল ধাক্কা খেলেও পার্ক সার্কাস, বালিগঞ্জ, কসবা, এন্টালি, চৌরঙ্গির মতো পাড়ায় বিজেপি-কে তারা পিছনে ফেলে দিতে পেরেছে।

Comment here