মহামারীতে মহাসংকটে বেসরকারি শিক্ষকরা - দৈনিক মুক্ত আওয়াজ
My title
সারাদেশ

মহামারীতে মহাসংকটে বেসরকারি শিক্ষকরা

এম এইচ রবিন : করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে কারণে গত ১৭ মার্চ থেকে বন্ধ রয়েছে দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। পরিস্থিতির উন্নতি না হলে আগামী সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে বলেও ইঙ্গিত দিয়েছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ অবস্থায় সরকারি ও এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের তেমন কোনো সমস্যায় পড়তে না হলেও দিশাহারা হয়ে পড়েছেন ১০ লাখ বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারী।

গত চার মাস ধরে বেতন পাচ্ছেন না তারা। সেই সঙ্গে প্রাইভেট-টিউশনিও বন্ধ হওয়ায় সংকট আরও বেড়েছে। যদিও এর মধ্যে তাদের জন্য সরকারি প্রণোদনার ঘোষণাও এসেছে। তবে তা যেন তৃষ্ণার্ত কাকের কাছে এক ফোঁটা পানির সংস্থানের মতো অবস্থা। প্রণোদনায় বেসরকারি শিক্ষকদের এককালীন মাত্র ৫ হাজার টাকা আর কর্মচারীদের আড়াই হাজার টাকা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

বিভিন্ন স্কুল কর্তৃপক্ষ জানায়, প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের টিউশন ফির ব্যাপারে খুব বেশি সাড়া দিচ্ছেন না অভিভাবকরা। ফলে বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানই গত মার্চ মাস থেকে বেতন দিতে পারছে না শিক্ষক-কর্মচারীদের। অনার্স-মাস্টার্স কলেজের এমপিওহীন শিক্ষকরাও বেতন পাচ্ছেন না নিজের কলেজ থেকে। অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ও শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন দিচ্ছে না। আবার কেউ কেউ দিচ্ছে অর্ধেক বেতন।

শিক্ষকরা জানান, প্রতিষ্ঠান থেকে মাসিক বেতনের বাইরে তাদের আয়ের অন্যতম উৎস ছিল টিউশনি। কিন্তু করোনার কারণে এখন সেই রাস্তাও বন্ধ। রাজধানীতে দু-চারজন যারা অনলাইনে পাঠদান করছেন তারা মূলত এমপিওভুক্ত বা ইংলিশ মিডিয়ামের শিক্ষক। ফলে বেতন না পেয়ে ও টিউশনি হারিয়ে তারা গত চার মাসে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। অবস্থা এমনই যে অনেকে বাসা ভাড়াটাও দিতে পারছেন না। ইতোমধ্যে সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে তাদের প্রণোদনা দেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত এসেছে। তবে যৎসামান্য এ প্রণোদনায় তাদের কিছুই হবে না।

বিষয়টি নিয়ে গতকাল রবিবার আমাদের সময়ের সঙ্গে কথা বলেন বাংলাদেশ নন-এমপিও শিক্ষক-কর্মচারী ফেডারেশনের সভাপতি অধ্যাপক গোলাম মাহমুদুন্নবী ডলার। তিনি বলেন, ‘আমাদের দাবি ছিল সরকারের স্বীকৃতিপ্রাপ্ত সব ননএমপিও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করার। কিন্ত বাছাই করে আড়াই হাজারের কিছু বেশি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে স্তর পরিবর্তনই বেশি হয়েছে। এখনো ননএমপিও ৫ হাজারের বেশি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানে প্রায় ৮০ হাজারের মতো শিক্ষক-কর্মচারী আছেন। যারা এখন বেতনহীন।’

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা আমাদের সময়কে জানান, প্রণোদনা দেওয়ার ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী একটি থোক বরাদ্দের অনুমোদন দিয়েছেন। আমরা বেসরকারি শিক্ষকদের একটি ডাটাবেজ করছি। সেই অনুযায়ী জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে এ অর্থ প্রদান করা হবে।

এ বিষয়ে ননএমপিও একজন শিক্ষক নেতা বলেন, একজন শিক্ষককে মাত্র ৫ হাজার টাকা আর কর্মচারীকে মাত্র আড়াই হাজার টাকা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এ টাকার জন্য আবার ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট খুলতে হবে। অ্যাকাউন্ট খোলা আর নতুন ছবি তোলাসহ একজন শিক্ষক-কর্মচারীর দুইশ থেকে তিনশ টাকা ব্যয় হবে। এর সঙ্গে যোগ হবে যাতায়াত খরচ। তা হলে আর কত টাকা তিনি প্রণোদনা পেলন? এ টাকা দিয়ে একজন শিক্ষকের পরিবার কতদিন চলতে পারবে?

এদিকে শিক্ষার্থীদের টিউশন ফির ওপর শতভাগ নির্ভরশীল কিন্ডারগার্র্টেন স্কুলগুলোও এখন প্রায় বন্ধের উপক্রম। সেখানকার শিক্ষকরাও বেতন পাচ্ছেন না। জানা গেছে, দেশে প্রায় ৫০ হাজার কিন্ডারগার্র্টেন স্কুলে ছয় লাখ শিক্ষক কর্মরত রয়েছেন। এসব প্রতিষ্ঠান চলে ভাড়া বাড়িতে। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে পাওয়া টিউশন ফির টাকাতেই এসব স্কুল কর্তৃপক্ষ বাড়িভাড়া, নানা ধরনের বিল ও শিক্ষকদের বেতন-ভাতা মেটায়। বর্তমানে স্কুল বন্ধ থাকায় এসব প্রতিষ্ঠানের আয় বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে বকেয়া পড়েছে বাড়িভাড়া, বিলসহ শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন। এরই মধ্যে কিন্ডারগার্র্টেনের দুটি সংগঠন পৃথকভাবে সংবাদ সম্মেলন করে সরকারের কাছে প্রণোদনাও চেয়েছে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান মনোয়ারা ভূঞা বলেন, ‘অভিভাবকরা টিউশন ফি দিচ্ছেন না, তাই আমরা শিক্ষকদের বেতন, বাড়িভাড়া দিতে পারছি না। আমরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে ৫০০ কোটি টাকার প্রণোদনা চেয়েছি। সরকার আমাদের সহায়তা না করলে অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া ছাড়া বিকল্প কোনো উপায় থাকবে না।’

করোনার মধ্যে করুণ অবস্থায় জীবনযাপন করছেন ইবতেদায়ি মাদ্রাসার শিক্ষকরাও। বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবে দেশে মোট চার হাজার ৩১২টি ইবতেদায়ি মাদ্রাসায় ২১ হাজার শিক্ষক থাকলেও বাস্তবে প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা অনেক বেশি। এর মধ্যে মাত্র এক হাজার ৫১৯টি মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষকদের ২৫০০ টাকা ও সহকারী শিক্ষকদের ২৩০০ টাকা করে ভাতা দেয় সরকার। তবে চলতি অর্থবছরে এসব প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তিতে প্রধানমন্ত্রীর সম্মতি ও বরাদ্দ থাকলেও কাজ শেষ করতে পারেনি শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

বাংলাদেশ স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসা শিক্ষক পরিষদের সভাপতি এসএম জয়নাল আবেদিন জিহাদী বলেন, ‘চলতি অর্থবছরে আমাদের মাদ্রাসা এমপিওভুক্তির কথা থাকলেও তা আটকে আছে। করোনার মধ্যে আমাদের শিক্ষকরা চরম কষ্টে জীবনযাপন করছেন। আর কত দিন বেতন ছাড়া চাকরি করব আমরা? চলতি অর্থবছরের মধ্যেই ইবতেদায়ি মাদ্রাসা এমপিওভুক্ত করার দাবি জানাচ্ছি আমরা।’

জানা গেছে, সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর কাছে এক আবেদনে বেসরকারি কারিগরি খাতের উদ্যোক্তারাও এক হাজার ২০০ কোটি টাকার আর্থিক প্রণোদনা চেয়েছেন। টেকনিক্যাল এডুকেশন কনসোর্টিয়াম অব বাংলাদেশের (টেকবিডি) সভাপতি ইঞ্জিনিয়ার আবদুল আজিজ বলেন, ‘১০ হাজার ৪৫২টি কারিগরি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৯ হাজার ৭৫৯টিই বেসরকারি। করোনার প্রাদুর্ভাবের মধ্যে চরম ক্ষতির মুখে পড়েছে এসব প্রতিষ্ঠান। প্রায় দুই লাখ শিক্ষক-কর্মচারীর বেতন পরিশোধই এখন দুঃসাধ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ অবস্থায় আমরা সরকারি প্রণোদনা না পেলে অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাবে। তাই আমরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে আর্থিক প্রণোদনার আবেদন করেছি।’

দেশে এখন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ১০৫টি। এসব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকের সংখ্যা প্রায় ৩০ হাজার। তবে কর্মকর্তা-কর্মচারী মিলিয়ে এ সংখ্যা দ্বিগুণেরও বেশি হবে। বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিয়মিত বেতন-ভাতা পরিশোধ করলেও সমস্যায় আছে ছোট ও মাঝারি প্রতিষ্ঠানগুলো। প্রায় ৭৫টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা নিয়মিত বেতন-ভাতা পাচ্ছেন না।

বাংলাদেশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতির সভাপতি শেখ কবির হোসেন বলেন, ‘মাঝারি ও ছোট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বেশ সমস্যায় আছে। কারণ সেমিস্টার পরীক্ষার আগে সাধারণত শিক্ষার্থীরা ফি পরিশোধ করে। কিন্ত করোনার কারণে সেই ফি এখনো পাওয়া যায়নি। ফলে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ই শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন দিতে গিয়ে সমস্যায় পড়েছে। কেউ হয়তো অর্ধেক বেতন দিয়েছে। আমরা এ জন্য সরকারের কাছে আর্থিক প্রণোদনা চেয়েছিলাম। কিন্ত সে ব্যাপারে এখনো সাড়া মেলেনি।’

ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক জিএম নিজাম উদ্দিনও জানিয়েছেন, তারাও সরকারের কাছে আর্থিক প্রণোদনা চেয়েছেন।

Comment here