সাইফুল ইসলাম (টাঙ্গাইল প্রতিনিধি) : অবশেষে দীর্ঘ প্রতিক্ষার পর আগামী বছরের জানুয়ারিতেই যমুনা নদীর ওপর ডাবল লাইনের বঙ্গবন্ধু রেল সেতু নির্মাণের কাজ শুরু করবে রেলপথ মন্ত্রণালয়। প্রকল্প গ্রহণের চার বছর পর এ সেতুটির নির্মাণ কাজ শুরু করা হচ্ছে। যমুনা নদীর ওপর টাঙ্গাইল ও উত্তরাঞ্চলের কোটি কোটি মানুষের পৃথক রেল সেতু নির্মাণের দীর্ঘ বছরের দিনের অবশেষে পূরণ করছে সরকার। সেতুটি নির্মাণের মাধ্যমে দেশের উত্তরাঞ্চল, পূর্বাঞ্চল ও পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের যোগাযোগ ব্যবস্থায় যুক্ত হবে দ্রুতগামী রেল সুবিধা।
জানা গেছে, টেন্ডার প্রক্রিয়ায় ২ প্যাকেজের মাধ্যমে সেতুটির পূর্বাঞ্চল (টাঙ্গাইল) ও পশ্চিমাঞ্চলের (সিরাজগঞ্জ) নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করা হবে। জাপান সরকারের আর্থিক সহায়তায় ও তাদের গাইডলাইন অনুযায়ী জাপানের ঠিকাদার এ সেতুটি নির্মাণ করবে। সম্পূর্ণ স্টিলের তৈরি এ সেতুটি নির্মাণে সরকার বেশ জোরেশোরেই প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে রেলপথ মন্ত্রণালয় সূত্র নিশ্চিত করেছে। নির্মাণের পর এটিই হবে বাংলাদেশের সর্ববৃহত রেলসেতু। একইসঙ্গে এটিই হবে প্রথম কোন রেল সেতু যেখানে ডাবল লাইনে দুটি ট্রেন এই রেল সেতু দিয়ে একই সময়ে পাশপাশি চলতে পারবে। আগামী ২০২০ সালের জানুয়ারিতেই যমুনা নদীর ওপর বঙ্গবন্ধু রেল সেতু নির্মাণের কাজ শুরু করা হবে বলে জানিয়েছেন রেলপথমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন। উলে¬খ্য, বর্তমানে যমুনা নদীর ওপর নির্মিত বঙ্গবন্ধু সেতুর একপাশে অত্যন্ত ঝুঁকি নিয়ে অতি কম গতিতে ট্রেন চলাচল করছে।
রেলপথ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, বিগত ২০১৬ সালের (১ জানুয়ারি) বঙ্গবন্ধু রেলওয়ে সেতু নির্মাণ প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। জাপানের আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থার (জাইকা) অর্থায়নে এ সেতুটি নির্মাণ করা হচ্ছে। এতে ব্যয় ধরা হয় ৯ হাজার ৭৩৪ কোটি টাকা। প্রকল্পে ৬ দশমিক ২ কিলোমিটার রেলওয়ে এ্যাপ্রোচ নির্মাণ করা হবে। সেতুর দৈর্ঘ্য হবে ৪ দশমিক ৮ কিলোমিটার। সূত্র জানায়, জাইকা প্রাথমিকভাবে ৭ হাজার ৭২৪ কোটি টাকা ঋণ দিতে সম্মত হয়েছে। প্রকল্প গ্রহণের পর গত সাড়ে তিন বছর সেতুটি নির্মাণের জন্য ফিজিবিলিটি স্টাডি করা, সার্ভে সম্পন্ন করা ও পরামর্শক নিয়োগের জন্য সময় ব্যয় হয়।
রেলসূত্র আরও জানায়, সেতুটিকে শতভাগ কার্যকরী করতে রেলপথ মন্ত্রণালয় বঙ্গবন্ধু সেতুপূর্ব টাঙ্গাইল এলাকা থেকে গাজীপুরের জয়দেবপুর পর্যন্ত ডাবল রেললাইন নির্মাণ করবে। সেতুটি নির্মাণের পর উত্তরাঞ্চলের সঙ্গে রাজধানীর দূরত্ব কমাতে দ্রুতগতির ট্রেন চালু করার জন্য এই ডাবল লাইন নির্মাণ করা হবে বলে রেলসূত্রে জানা গেছে। এ লাইনের কাজ শেষ করা হলে উত্তরবঙ্গের সঙ্গে ঢাকার যোগাযোগসহ রেলের সিডিউল নিয়ে চলমান ভয়াবহ বিপর্যয় অনেকটা কমে আসবে। তবে রেল কর্তৃপক্ষের দাবি যমুনা নদীর ওপর পৃথক রেলসেতু নির্মাণ করা সম্ভব হলে উত্তরাঞ্চলগামী কোন ট্রেনেই কোন প্রকার সিডিউল বিপর্যয় ঘটবে না। একইসঙ্গে অতি দ্রুতগতিতে এ রুটে ট্রেন পরিচালনা করা সম্ভব হবে। বঙ্গবন্ধু রেলওয়ে সেতু নির্মাণ প্রকল্পের মাধ্যমে এ রেলসেতুটি নির্মাণ করা হবে। কয়েক দফা তারিখ পরিবর্তনের পর প্রকল্প গ্রহণের প্রায় ৪ বছর পর এ বছরের শেষের দিকে যে কোন সময় সেতুটির মূল নির্মাণ কাজ শুরু করার ঘোষণা দেয় সরকার। পরবর্তীতে ঠিকাদার সঙ্কটের কারণে রেলসেতুটির নির্মাণ কাজ আটকে যায়।
রেল মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, সেতুটির একপাশে টাঙ্গাইল এবং অন্যপাশে সিরাজগঞ্জ জেলা রয়েছে। বিদ্যমান বঙ্গবন্ধু সেতুর ৩০০ মিটার উজানে নতুন এই সেতুর অবস্থান হবে। যমুনা নদীতে বিদ্যমান সেতুর সমান্তরাল পৃথক একটি নতুন রেলসেতু নির্মাণের জন্য সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। আগামী ২০২০ সালের হতে যাওয়া জানুয়ারি মাসে শুরু হওয়া চলমান প্রকল্পটি আগামী ২০২৩ সালের মধ্যে সম্পন্ন হওয়ার কথা রয়েছে। যমুনায় নতুন রেলসেতু নির্মাণ হলে উত্তরাঞ্চলের সঙ্গে সারাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নতি হবে। মহাসড়কের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে চার লেনের সেতুটি হবে ডুয়েলগেজ। বর্তমানে এ সেতুটি দিয়ে কোনমতে ট্রেন পরিচালনা করা হলেও নির্মাণের পর ওয়াগন ও কন্টেনার বাল্ক বর্তমানের তুলনায় অধিক পরিমাণে বহন করা সম্ভব হবে। সেতুর বঙ্গবন্ধু সেতু ইস্ট (বিবিই) এবং বঙ্গবন্ধু সেতু ওয়েস্টে (বিবিডবি¬উ) স্বয়ংক্রিয় কম্পিউটার বেজড ইন্টারলিংকিং (সিবিআই) সিগনালিং সিস্টেম থাকবে। একইসঙ্গে সেতু বরাবর গ্যাস ট্রান্সমিশন পাইপলাইনও সংযোজন করা হবে।
বর্তমানে অপরিকল্পিতভাবে যুক্ত হওয়া রেলপথের কারণে বঙ্গবন্ধু সেতুটি অত্যন্ত ঝুকি নিয়ে পরিচালিত হচ্ছে। নতুন সেতুটি নির্মাণের পর বঙ্গবন্ধু সড়ক সেতুটির সঙ্গে যুক্ত হওয়া রেলসেতুটিকে বন্ধ করে দেয়া হবে। পরবর্তীতে এর ওপর দিয়ে ট্রেন চলাচল করতে দেয়া হবে না। ফলে ঝুঁকিমুক্ত হওয়ার পাশপাশি থেকে রক্ষা পাবে সড়ক সেতুটিও। সূত্র জানায়, যমুনা নদীর ওপর নির্মিত সড়ক সেতুর নিরাপত্তা ও স্থায়ীত্বের কথা বিবেচনা করে সেতুতে গতি কমিয়ে রেল চলাচল করার জন্য রেলপথ মন্ত্রণালয়কে পত্র দেয়া হয়। এরপর থেকে বর্তমানে সেতুতে ধীরগতিতে রেল চলাচল করছে। তবে এখনও রেলসেতু নির্মাণের কাজ প্রাথমিক পর্যায়েই রয়ে গেছে। অতি দ্রুতই এ বিষয়ে সমাধান করা হবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব মোফাজ্জল হোসেন জানান, আগামী ২০২০ সালের জানুয়ারি মাস থেকেই যমুনা নদীর ওপর বঙ্গবন্ধু রেল সেতু নামে পৃথক একটি রেল সেতু নির্মাণের কাজ শুরু করা হবে। বর্তমানে সকল কাজ শেষে টেকনিক্যাল ইভালুয়েশন কমিটি (টিইসি) কর্তৃক টেন্ডার আহ্বানের পর দরদাম মূল্যায়ন করার কাজ চলছে। জাপান সরকারের আর্থিক সহায়তায় ও গাইডলাইনের মাধ্যমে টেন্ডারে জাপানের ঠিকাদারগণই এতে অংশগ্রহণ করছেন। মোট ২ প্যাকেজে সেতুটির পূর্বাঞ্চল (টাঙ্গাইল) ও পশ্চিমাঞ্চল (সিরাজগঞ্জ) ২ ভাগে এ রেলসেতুটি নির্মাণ করা হবে। এর মধ্যে টিইসি একটি অংশের জন্য টেন্ডারের দর অনুযায়ী কাছাকাছি বা গ্রহণযোগ্য দরকে মূল্যায়ন কমিটি বিবেচনা করেছে। অপরদিকে জাপানেরই আরেকটি কোম্পানি বিবেচিত কোম্পানির দরের চেয়ে অনেক বেশি যা প্রায় ৩০ ভাগের বেশি দর দিয়ে টেন্ডার সাবমিট করেছে। ব্যয় অতি বেশি হওয়ায় সরকার জাপান সরকারের আর্থিক সাহায্যকারী সংস্থা জাইকাকে সঙ্গে নিয়ে দরদাম সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসতে সরকার বেশ গুরুত্বের সঙ্গে কাজ করছে। টেন্ডার দাখিলকারী কোম্পানির সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে দর সহনীয় পর্যায়ে আনতে সক্ষম হলে একসঙ্গেই ২ প্যাকেজের কাজ শুরু করা হবে। অন্যথায় টিইসির মতামত ও সুপারিশের ওপর ভিত্তি করে নতুন করে টেন্ডার আহ্বান করা বা পরবর্তী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।
রেলসূত্র জানায়, টেন্ডারে সহনশীল পর্যায়ের দর প্রদানকারী জাপানী কোম্পনিটি বর্তমানে বাংলাদেশের বিভিন্ন বড় বড় প্রকল্পের কাজ করছে। ফলে তাদের জনবল, অবকাঠামো ও প্রশিক্ষিত লোকজন বাংলাদেশে রয়েছে। ফলে প্রকল্প বাস্তবায়ন তাদের পক্ষে তুলনামূলক কম হবে। অপরদিকে অন্য কোম্পানিটির সম্পূর্ণ নতুনভাবে জনবলসহ সকল প্রকার যন্ত্রপাতি আনতে হবে ফলে ব্যয় অনেক বেড়ে যাবে। তাই তারা ৩০ ভাগ বেশি ব্যয় নির্ধারণ করে টেন্ডার জমা দিয়েছে বলে সংশি¬ষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে রেলপথমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন জানান, দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর যমুনা নদীর ওপর দেশের সর্ববৃহত বঙ্গবন্ধু রেলসেতু নির্মাণের মূলকাজ আগামী বছরের জানুয়ারিতেই শুরু করা হচ্ছে। এজন্য প্রয়োজনীয় কাজও দ্রুত গতিতে চলছে। ডিসেম্বরের মধ্যে কাজ শুরুর সকল প্রকার প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হবে। যাতে জানুয়ারির প্রথমেই এটির মূল কাজ শুরু করা সম্ভব হয়। যমুনা নদীর ওপর ডাবল লাইনের এ রেলসেতুটি নির্মিত হবে শতভাগ স্টিল দিয়ে। ফলে এর স্থায়ীত্বও হবে সড়ক সেতুর চেয়ে অনেক বেশি। সেতুটিতে আধুনিক সিগন্যালিং ব্যবস্থা সহ উন্নত বিশ্বের ন্যায় সকল আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে। রেলপথ মন্ত্রী আরও জানান, জাপানের আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থার (জাইকা) অর্থায়নে এ সেতুটি নির্মাণ করা হচ্ছে। এতে ব্যয় ধরা হয় ৯ হাজার ৭৩৪ কোটি টাকা। প্রকল্পে ৬ দশমিক ২ কিলোমিটার রেলওয়ে এ্যাপ্রোচ নির্মাণ করা হবে। সেতুর দৈর্ঘ্য হবে ৪ দশমিক ৮ কিলোমিটার। সেতুটি নির্মাণ করার পর সরকার দেশের উত্তরাঞ্চল, পূর্বাঞ্চল ও পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের যোগাযোগ ব্যবস্থায় দ্রুতগামী রেল সুবিধা ব্যবস্থা যুক্ত করা হবে।
দ্রুতগতিতে ট্রেন চলাচলে অনেক ঝুকি থাকায় যমুনা নদীর ওপর বঙ্গবন্ধু রেলসেতুতে বর্তমানে অত্যন্ত কম গতিতে ট্রেন চলাচল করছে। সেতুটির সঙ্গে যোযোগের জন্য যাত্রীদের সুবিধার্থে বঙ্গবন্ধু সেতুপূর্ব থেকে জয়দেবপুর পর্যন্ত ডাবল রেললাইন নির্মাণ করা হবে। আর এই লাইনের কাজ শেষ হলে উত্তরবঙ্গের সঙ্গে ঢাকার যোগাযোগসহ রেলের সিডিউল আর বিপর্যয় হবে না। একইসঙ্গে অত্যন্ত দ্রুত গতিসম্পন্ন ও আধুনিক উচ্চগতির ট্রেন চলাচলের ব্যবস্থা করা হবে। এ রেলসেতুটি চালু করার পর রেলপথে উত্তরাঞ্চলের যাত্রীদের জন্য এক নতুন মাত্রা যোগ হবে। যা দেশের অর্থনীতিতেও সমৃদ্ধি আনতে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে।
Comment here