আদালত প্রতিবেদক : ঢাকার অদূরে সাভারে রানা প্লাজা ধ্বসের ঘটনার ৭ বছর পূর্ণ হবে আগামীকাল শুক্রবার। ওই ঘটনায় মারা যায় ১ হাজার ১৩৬ জন পোশাককর্মী। ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল শতাব্দীর ভয়াবহতম ভবন বিপর্যয়ের ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলাগুলোর বিচার কাজ এখনো শেষ হয়নি। সাক্ষ্যগ্রহণও শুরু হয়নি। পলাতক আছেন দুটি মামলার অধিকাংশ আসামি।
রানা প্লাজা ধসের পরপরই বেশ কয়েকটি মামলা হলেও মূল মামলা দুটি। একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগে, অপরটি ইমারত বিধিমালা না মেনে ভবন তৈরির। দুই মামলায় ভবন মালিক সোহেল রানা কারাগারে। তবে কয়েকজন আসামি আছেন জামিনে। ৭ বছর হয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত মামলার বিচারে তেমন কোনো অগ্রগতি নেই। নানা আইনি জটিলতায় থমকে আছে বিচার।
২০১৬ সালের ১৮ জুলাই হত্যা মামলায় ভবন মালিক সোহেল রানাসহ ৪১ জনের বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করা হয়। চার্জ গঠনের পর প্রায় সাত বছরেও এ মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণই শুরু হয়নি। কবে নাগাদ সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হবে কিংবা মামলার বিচার শেষ হবে, তা বলতে পারছেন না সংশ্লিষ্টরা।
বিচারিক আদালতের চার্জ গঠনের আদেশ চ্যালেঞ্জ করে উচ্চতর আদালতে আবেদন করে আসামিপক্ষ। আর কয়েকজন আসামির পক্ষে উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশ থাকাতেই মূলত এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
মামলা সম্পর্কে ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ আদালতের কৌঁসুলি খোন্দকার আব্দুল মান্নান বলেন, ‘রানা প্লাজা হত্যাকাণ্ডের মামলায় ৮ আসামির পক্ষে উচ্চ আদালতে স্থগিতাদেশ থাকায় দীর্ঘদিন সাক্ষ্যগ্রহণ কার্যক্রম হয়নি। এদের মধ্যে ছয়জনের স্থগিতাদেশ ভ্যাকেট (বাতিল) হয়ে গেছে। বর্তমানে আসামি মোহাম্মদ আলী ও রেফাত উল্লাহর পক্ষে উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশ রয়েছে। ওই দুজনের স্থগিতাদেশ ভ্যাকেটের উদ্যোগ নেওয়া হবে।‘
আব্দুল মান্নান আরও বলেন, ‘আমরা উচ্চ আদালতের দিকে তাকিয়ে আছি। রাষ্ট্রপক্ষ থেকে আমরা তৈরি আছি। উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশ বাতিল হলেই আমরা দ্রুত সাক্ষ্যগ্রহণ কার্যক্রমে অগ্রসর হতে পারব।’
মামলা দায়েরের দুই বছরের বেশি সময় পর ২০১৫ সালের ১ জুন তদন্ত শেষে পৃথক দুটি চার্জশিট দাখিল করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) সহকারী পুলিশ সুপার বিজয় কৃষ্ণ কর। যার একটিতে পরিকল্পিত হত্যার অভিযোগে ভবনমালিক সোহেল রানা ও তার বাবা-মা এবং তৎকালীন সাভার পৌরসভার মেয়র ও কমিশনারসহ ৪১ জনকে, অপরটিতে ইমারত বিধি না মেনে রানা প্লাজা নির্মাণের অভিযোগে সোহেল রানাসহ ১৮ জনকে আসামি করা হয়।
দুটি চার্জশিটে মোট আসামি ৪২ জন। এর মধ্যে সোহেল রানাসহ ১৭ জন দুটি মামলারই আসামি। এ দুটি মামলায়ই পৃথক দুই আদালত আসামিদের বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করেন। তবে দুটি মামলাতেই আসামিপক্ষ চার্জ গঠনের আদেশ চ্যালেঞ্জ করে আবেদন করায় এবং কয়েকজন আসামির পক্ষে উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশ থাকায় সাক্ষ্যগ্রহণ কার্যক্রম আপাতত বন্ধ রয়েছে।
এ ছাড়া রানা প্লাজা নির্মাণে দুর্নীতির অভিযোগে পৃথক আরেকটি মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ঘটনার দুই বছর পর এ মামলায় কমিশন চার্জশিট দাখিল করলেও ত্রুটিপূর্ণ হওয়ায় আদালত তা গ্রহণ না করে পুনরায় তদন্তের নির্দেশ দেন। এক বছর ধরে পুনঃতদন্ত শেষে দুদক ফের প্রতিবেদন দাখিল করে। ২০১৭ সালের ২১ মে এ মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধ চার্জ গঠন করেন আদালত। মামলাটিতে সাক্ষ্য গ্রহণ চলছে।
রানা প্লাজার হত্যা মামলা
রানা প্লাজা ধসের পরদিন অবহেলাজনিত মৃত্যুর অভিযোগে একটি মামলা করেন সাভার থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আলী আশরাফ। ওই মামলায় সোহেল রানাসহ ২১ জনকে আসামি করা হয়। এ ছাড়া রানা প্লাজা ধসে নিহত হওয়ার ঘটনাকে হত্যাকাণ্ড আখ্যায়িত করে আদালতে আরেকটি মামলা করেন গার্মেন্টস শ্রমিক জাহাঙ্গীর আলমের স্ত্রী শিউলি আক্তার।
আদালতের নির্দেশে একে অবহেলাজনিত মৃত্যু মামলার সঙ্গে একীভূত করে তদন্ত করে সিআইডি। তদন্ত শেষে হলেও ৫ সরকারি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মন্ত্রণালয়ের মঞ্জুরি আদেশ না দেওয়ায় দীর্ঘদিন চার্জশিট আটকে থাকে। পরে মঞ্জুরি আদেশ ছাড়াই চার্জশিট দাখিল করে সিআইডি। চার্জশিটে পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড ঘটানসহ দণ্ডবিধির ৩০২, ৩২৬, ৩২৫, ৩৩৭, ৩৩৮, ৪২৭, ৪৬৫, ৪৭১, ২১২, ১১৪, ১০৯ ও ৩৪ ধারায় বিভিন্ন অভিযোগ আনা হয়।
চার্জশিট দাখিলের পর আদালত থেকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে ওই ৫ জনের মঞ্জুরি আদেশ চাওয়া হয়েছিল। কিন্তু মন্ত্রণালয় থেকে ওই ৫ কর্মকর্তা জড়িত নন বলে প্রতিবেদন পাঠানো হয়। পরবর্তী সময়ে মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদন বিশ্বাসযোগ্য না হওয়ায় মঞ্জুরি আদেশ ছাড়াই চার্জশিট গ্রহণ করেন আদালত। আদালতে দায়ের করা হত্যা মামলার বাদী শিউলি আক্তার এখন পুলিশের মামলার সাক্ষী। এ মামলায় মোট ৫৯৪ জনকে সাক্ষী করা হয়েছে।
২০১৬ সালের ১৮ জুলাই এ মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করেন আদালত। চার্জশিটভুক্ত ৪১ আসামিদের মধ্যে সোহেল রানা কারাগারে। আসামি আবু বকর সিদ্দিক ও আসামি আবুল হোসেন জামিনে থাকা অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছেন। আর ৩২ আসামি জামিনে ও ছয় আসামি পলাতক রয়েছেন। বর্তমানে ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ মো. হেলাল উদ্দিনের আদালতে মামলাটি বিচারাধীন রয়েছে।
এ সম্পর্কে ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের এডিশনাল পাবলিক প্রসিউকিউশন মো. মিজানুর রহমান বলেন, ‘হত্যা মামলাটি সাক্ষ্য গ্রহণের পর্যায়ে রয়েছে। কিন্তু মামলাটিতে উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশ থাকায় সাক্ষ্য গ্রহণ করা যাচ্ছে না। রাষ্ট্রপক্ষ থেকে অনেকবার সাক্ষী হাজির করা হয়েছে। তারপরও সাক্ষ্য নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। আশা করছি উচ্চ আদালতের অনুমতি পেলেই বিচারকার্য দ্রুত শুরু করতে পারবো।’
রানার আইনজীবী ফারুক আহাম্মদ বলেন, ‘মামলাটির বিচার হচ্ছে না। বিনা বিচারে রানা কারাগারে আটক আছে। জামিনও পাচ্ছে না। ভবনের মূল মালিক রানার বাবা, তিনি জামিন পেলেও রানা জামিন পাচ্ছে না। সব আসামি জামিনে সুবিধা ভোগ করছে, কিন্তু নামের কারণে রানা জামিন পাচ্ছে না। এ জন্য আমরা চাই মামলার বিচার যেন দ্রুত শেষ হয়।’
Comment here