আলী আসিফ শাওন : আগামী জাতীয় সম্মেলনের আগে আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনগুলোয় একটা গুণগত পরিবর্তন আনতে যাচ্ছেন দলটির সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ইতোমধ্যে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে পদ থেকে অব্যাহতি দিয়ে দলের নেতাকর্মীদের কাছে এ সংক্রান্ত একটি বার্তাও পৌঁছে দিয়েছেন তিনি।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা বলছেন, নেতাকর্মীদের কাছে আরও দায়িত্বশীল আচরণ প্রত্যাশা করছেন তিনি। রাজনীতির নামে কোনো রকম বিশৃঙ্খলা, চাঁদাবাজি, পেশিশক্তি প্রয়োগ ইত্যাদির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি নিয়েছেন শেখ হাসিনা। ভাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাত্রলীগের পর এবার সহযোগী সংগঠন যুবলীগের প্রতিও কঠোর হুশিয়ারি দিয়েছেন তিনি। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির একাধিক নেতা আমাদের সময়ের সঙ্গে আলাপকালে এসব তথ্য জানিয়েছেন।
দলটির এসব নেতা বলছেন, টানা তিন মেয়াদের সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা এখন দল নিয়ে খুবই সিরিয়াস। তিনি চান না, তার নেতৃত্বাধীন সরকারের অর্জন দলীয় কিছু নেতাকর্মীর আচরণের কারণে ম্লান হয়ে যাক। সে কারণে দলীয় নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়ামাত্রই ব্যবস্থা নিচ্ছেন। এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ ছাত্রলীগের সভাপতি-সম্পাদকের বিরুদ্ধে তার নেওয়া সিদ্ধান্ত।
আওয়ামী লীগের নেতারা আরও বলেন, গত শনিবারের বৈঠকে শুধু ছাত্রলীগ নয়, যুবলীগের বিষয়েও একাধিক অভিযোগ উত্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু সেদিন ছাত্রলীগ নিয়ে আলোচনার ভিড়ে
হারিয়ে যায় যুবলীগ প্রসঙ্গ। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, পুলিশের আইজিপি ও স্বরাষ্ট্র সচিবের বরাত দিয়ে প্রধানমন্ত্রী আরেকটি ফাইল খোলেন দলের শীর্ষ নেতাদের সামনে। আওয়ামী লীগ সভাপতি এ সময় যুবলীগের নামে আসা অভিযোগের কিছু কিছু পড়ে শোনান তার সহকর্মীদের। ঢাকা শহরের সেগুনবাগিচা এলাকায় মহানগর যুবলীগের নেতারা জুয়া খেলার ক্যাসিনো চালান বলে জানান শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ওইসব ক্যাসিনো পরিচালনার জন্য নেপাল ও থাইল্যান্ড থেকে প্রশিক্ষিত নারী কর্মীদের নিয়ে আসা হয় বলেও তার কাছে খবর আছে। মনোনয়ন বোর্ডের বৈঠকের পরের শনিবার দলের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকেও যুবলীগের বিষয়ে কড়া বার্তা দেন শেখ হাসিনা।
সূত্রমতে, প্রধানমন্ত্রীর জন্মদিন পালন উপলক্ষে একটি এজেন্ডা ছিল আওয়ামী লীগের বৈঠকে। যদিও গণভবনে অনুষ্ঠিত এ বৈঠকের শুরুতে এ নিয়ে আলোচনায় আগ্রহী নন বলে হাসতে হাসতে জানিয়ে দেন প্রধানমন্ত্রী। এর পর বৈঠকের এক পর্যায়ে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের শেখ হাসিনার জন্মদিনের প্রসঙ্গ তোলেন। তখন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেন, ‘নেত্রী, যুবলীগ মহানগর দক্ষিণ মাসব্যাপী আপনার জন্মদিন পালন করছে।’
এ সময় ওবায়দুল কাদেরও আলোচনায় যোগ দিয়ে বলেন, ‘আজকেও সোহরাওয়ার্দীতে তারা বিশাল মিলাদ মাহফিল করেছে। প্রধানমন্ত্রী তখন তাদের দুজনকে থামিয়ে দিয়ে বলেন, চাঁদাবাজির টাকা হালাল করার জন্য আমার নামে মিলাদের কোনো দরকার নেই। আমার বাবার মৃতদেহ ধানমন্ডির বাড়িতে পড়ে ছিল, আওয়ামী লীগের কোনো নেতাকর্মী দেখতেও যায়নি। আমি আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের চিনি। দেশের মানুষের দোয়া আছে আমার সঙ্গে। কোনো মিলাদ আমার দরকার নেই।
বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী নাম প্রকাশ না করে বলেন, ‘যুবলীগ মহানগর দক্ষিণের একজন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে গোলাগুলি করতে গিয়ে বেঁচে গেছে। এখন নাকি আরেকজন তিন গাড়ি ভর্তি অস্ত্র নিয়ে চলাফেরা করে।’ তিনি এ সময় পাশে বসা এক প্রেসিডিয়াম সদস্য, যিনি যুবলীগের নিয়ন্ত্রক বলে পরিচিত, তার দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘এসব ক্যাডার বাহিনী পোষা বন্ধ করুন। কোনো অস্ত্রধারী ক্যাডার আমার দরকার নেই। আওয়ামী লীগ বিপদে পড়লে সবার আগে এরাই অস্ত্র নিয়ে পালাবে। দলের কোনো বিপদে এদের পাওয়া যাবে না।’
উপস্থিত সবার প্রতি আহ্বান জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, কোনো অস্ত্রবাজ দরকার নেই আমার। আপনারা যারা এগুলো লালন-পালন করেন, এসব বন্ধ করতে হবে। নইলে আমি যেভাবে জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাস দমন করেছি, সেভাবে এগুলোও দমন করব।
শনিবারের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকের বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য কাজী জাফরউল্লাহ গতকাল রবিবার আমাদের সময়কে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর কথা শুনে মনে হয়েছে, তিনি কোনো অপরাধীকে দলে চান না। এ জন্য তিনি একটা কড়া বার্তা দিয়েছেন আমাদের সব নেতাকর্মীর উদ্দেশে। এবারের সম্মেলনের আগেই দলে একটা গুণগত পরিবর্তন চান আমাদের সভাপতি।
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের নেতারা আরও জানিয়েছেন, আগামী ২০-২১ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলনের আগে মেয়াদোত্তীর্ণ জেলা-উপজেলা কমিটির সম্মেলন দেখতে চান শেখ হাসিনা। এ লক্ষ্যে তিনি দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সাংগঠনিক সম্পাদকদের প্রয়োজনীয় নির্দেশ দেন শনিবারের বৈঠকে।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রীর এ নির্দেশের পর গতকাল রবিবার সন্ধ্যায় রাজধানীর বনানীতে আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর এক সদস্যের ব্যবসায়িক অফিসে আওয়ামী লীগের নেতাদের উচ্চপর্যায়ের একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, আগামী ১০ ডিসেম্বরের মধ্যে দলের সব মেয়াদোত্তীর্ণ জেলা-উপজেলার সম্মেলন করতে হবে। ওই বৈঠকে উপস্থিত নেতাদের সঙ্গে আলাপকালে জানা গেছে, ডিসেম্বরে আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলনের আগে কমপক্ষে ২০টি জেলা কমিটি ও বেশ কয়েকটি উপজেলা কমিটির সম্মেলন আয়োজনের বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। আগামী ১৮ সেপ্টেম্বর আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সম্পাদকম-লীর সভা ডাকা হয়েছে। ওই সভায় এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করে সারাদেশে সাংগঠনিক সফরে নেমে পড়বেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা।
সম্মেলনের মধ্য দিয়ে দল গোছানোর পাশাপাশি উপজেলা নির্বাচনে যারা দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন, তাদের বিষয়েও সিদ্ধান্ত হয়েছে আওয়ামী লীগের বৈঠকে। যাদের নামে চিঠি গেছে, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তাদের চিঠির জবাব দিতে হবে। চিঠির জবাব পাওয়ার পর প্রতিটি উপজেলার বিষয়গুলো বিস্তারিত বিশ্লেষণের পর সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। যারা চিঠির জবাব দেবেন না, তাদের সরাসরি দলীয় পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হবে।
Comment here