সরকারবিরোধী কনটেন্ট ভাবাচ্ছে সরকারকে - দৈনিক মুক্ত আওয়াজ
My title
সারাদেশ

সরকারবিরোধী কনটেন্ট ভাবাচ্ছে সরকারকে

সাজ্জাদ মাহমুদ খান : জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোয় নজরদারি বাড়িয়েছে সরকার। সরকারবিরোধী ও আপত্তিকর বিষয়বস্তু দ্রুত সময়ের মধ্যে সরিয়ে ফেলতে মূলত এ তৎপরতা বাড়ানো হয়েছে। সরকারবিরোধী ও উগ্রবাদসহ প্রতিদিন গড়ে ২০০ কনটেন্ট শুধু ফেসবুককে সরানোর অনুরোধ করছে সরকার, যা বিশে^ সর্বোচ্চ। তবে নির্বাচন সামনে রেখে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে কনটেন্ট সরানোর পরিমাণ আরও বাড়বে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

এমন প্রেক্ষাপটে কনটেন্ট সরানোর যথাযথ পদ্ধতির বিষয়ে সম্প্রতি ফেসবুক ও ইউটিউবের কর্মকর্তাদের কাছে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) কর্মীরা। সেই অভিজ্ঞতার আলোকে কনটেন্ট সরানো ও আইডি ব্লকের যথাযথ পদ্ধতি অনুসরণ করতে র‌্যাব-পুলিশসহ বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থায় চিঠি পাঠিয়েছে বিটিআরসি।

সূত্র জানিয়েছে, ফেসবুক-ইউটিউবের ওপর ভরসা করে বিপজ্জনক ও আপত্তিকর কনটেন্ট অপসারণ কিংবা ব্লক করা বিটিআরসির পক্ষে অনেক সময়ই কঠিন হয়ে পড়ে। অনেক ক্ষেত্রে কনটেন্ট অপসারণ কিংবা ব্লক করতে ফেসবুক ও ইউটিউব কর্তৃপক্ষ আদালতের আদেশ চায়। আবার আদালতের আদেশ দিলেও অনেক সময় ‘বিপজ্জনক’ কনটেন্ট অপসারণে ফেসবুক ও ইউটিউব কালক্ষেপণ করে। এতে করে এ ধরনের কনটেন্ট সরকার তথা দেশের জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে।

সরকারের কাছে তথ্য রয়েছে, আগামী জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে এ ধরনের কনটেন্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অতি মাত্রায় ছড়িয়ে পড়তে পারে; বিশেষ করে নানা গুজব ছড়াতে পারে। ওই সময় দ্রুত সেগুলো সরানোর প্রয়োজনীয়তা দেখা দিতে পারে। এমন প্রেক্ষাপটে চাইলেই দেশে সুনির্দিষ্ট কোনো কনটেন্ট বাংলাদেশের সাইবার স্পেসে দৃশ্যমান হবে না- এমন প্রযুক্তি বিটিআরসিকে দিয়ে আমদানি করতে যাচ্ছে সরকার।

প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিরোধীদের সমালোচনা, দুর্নীতির বিরুদ্ধে মতামত আর রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্রোপাগান্ডাকে গুলিয়ে ফেললে চলবে না। এসব ক্ষেত্রে নির্মোহভাবে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ব্যক্তি, গোষ্ঠী কিংবা রাজনৈতিক দল বিশেষ সুবিধা পেলে এসব প্রযুক্তি বাগস্বাধীনতার প্রতিবন্ধকতা হতে পারে।

গত জানুয়ারিতে পুলিশ সপ্তাহের অনুষ্ঠানে পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, নির্বাচন সামনে রেখে গুজব ছড়ানোর প্রবণতা ব্যাপকভাবে বাড়তে পারে। তখন অতি দ্রুত সেসব না সরাতে পারলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে।

বিটিআরসি ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা জানান, স্পর্শকাতর রাজনৈতিক বিষয়, ধর্মীয় উসকানি, গুজব, সমাজ ও রাষ্ট্রবিরোধী প্রচারণাসহ বিভিন্ন ধরনের আপত্তিকর কনটেন্ট দ্রুত সরানো ও আইডি ব্লক করতে বিটিআরসিকে তালিকা পাঠায় র‌্যাব-পুলিশসহ বিভিন্ন সংস্থা। বিটিআরসি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে এসব তালিকা পাঠালেও অধিকাংশই ‘কমিউনিটি স্ট্যান্ডার্ড গাইডলাইন’ লঙ্ঘন না করায় অপসারণ করা হয় না।

বিশেষ করে প্রতিষ্ঠিত কোনো গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে যদি এ ধরনের অভিযোগ আসে তা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আমলে নেয় না ফেসবুক-ইউটিউব কর্তৃপক্ষ।

সম্প্রতি বিটিআরসি থেকে পুলিশসহ বিভিন্ন সংস্থায় পাঠানো চিঠিতে বলা হয়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর সঙ্গে বিটিআরসি দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের ফোকাল পয়েন্ট হিসেবে কার্যক্রম ও যোগাযোগ করছে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, গোয়েন্দা সংস্থাগুলো ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে প্রাপ্ত অনুরোধে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করা ক্ষতিকর ও নিরাপত্তার হুমকি সংশ্লিষ্ট কনটেন্ট অপসারণে কার্যক্রম গ্রহণ করে। গত ২৬ অক্টোবর ফেসবুকের এশিয়া প্যাসিফিক পাবলিক পলিসি টিম ও ৬ ডিসেম্বর ইউটিউবের গভর্নমেন্ট অ্যাফেয়ার্স অ্যান্ড পাবলিক পলিসির বিদেশি প্রতিনিধিদের বিটিআরসিতে দুটি কর্মশালা পরিচালিত হয়।

বিশ্বের পাঁচ শতাধিক নিয়ন্ত্রক সংস্থার সঙ্গে ফেসবুক তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে। তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনা করে দেখা যায়, এদের মধ্যে বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রক সংস্থা তথা বিটিআরসি থেকে সবচেয়ে বেশি কনটেন্টসংক্রান্ত প্রতিবেদন পাঠানো হয়। যেখানে অন্যান্য দেশের নিয়ন্ত্রক সংস্থা সপ্তাহে গড়ে পাঁচ থেকে ছয়টি কনটেন্ট রিপোর্ট করে, সেখানে বাংলাদেশ করে ২০০টির বেশি।

সাইবার নিরাপত্তা বিশ্লেষক তানভীর হাসান জোহা আমাদের সময়কে বলেন, গুজব ও আপত্তিকর কনটেন্ট সরিয়ে ফেলতে ফেসবুক বাংলাদেশকে ভালোই সহযোগিতা করছে। কিন্তু বাংলাদেশ থেকে কনটেন্ট সরানোর অনুরোধের পরিমাণ এতই বেশি যে, ফেসবুক একসময় ফেডআপ হয়ে যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে আমাদের নিজস্ব ক্যাপাসিটি বাড়াতে হবে। আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিয়ে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিলে এসব ঘটনা কমে আসবে। সেই সঙ্গে আইনের প্রয়োগে কোনো ব্যক্তি, গোষ্ঠী কিংবা রাজনৈতিক দল যাতে বিশেষ সুবিধা না পায়, সে দিকে কঠোর হতে হবে।

নিজস্ব সক্ষমতা বাড়ানোর বিষয়ে তিনি বলেন, বিটিআরসি কিছু প্রযুক্তি ইতোমধ্যে আমদানি করেছে। এসব প্রযুক্তি দিয়ে নিজেরাই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের নিদিষ্ট কনটেন্ট কিংবা আইডি তারা আমাদের দেশে ব্লক করে দিতে পারবে। আপাতত শুধু ডেস্কটপের জন্য এই প্রযুক্তি কার্যকর হবে। মোবাইলেও বন্ধ করতে এই প্রযুক্তি আনার কার্যক্রম চলছে। দ্রুতই চলে আসবে। তবে এখন সমস্যা হচ্ছে, কোনটি দেশবিরোধী কনটেন্ট, আর কোনটি নয়, সেটা বিচার হবে কীভাবে?

পুলিশের সাইবার ইউনিটের কর্মকর্তারা বলছেন, নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরির জন্য দুর্বৃত্তরা অনলাইন প্লাটফর্মকে ব্যবহার করতে পারেন। এ জন্য তারা আগে থেকেই সতর্ক রয়েছেন। অনলাইনে বিভ্রান্তিকর বা কোনো গুজব ছড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে তা অপসারণের পাশাপাশি জড়িতদের আইনের আওতায় আনা হবে।

পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের সাইবার ইনভেস্টিগেশন বিভাগের উপ-কমিশনার আ ফ ম আল কিবরিয়া বলেন, নিয়মিত সাইবার পেট্রোলিংয়ের মাধ্যমে যারা গুজব বা মিথ্যা তথ্য ছড়ায়, তাদের আইনের আওতায় আনার চেষ্টা রয়েছে। এ ছাড়া ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের ৮ ধারা অনুযায়ী বিটিআরসিকে প্রায় প্রতিদিনই আপত্তিকর কনটেন্টগুলো সরানো কিংবা ব্লক করার জন্য লিস্ট দিই। বিটিআরসি ফেসবুক-টুইটার বা অন্যদের কাছে পাঠালে তারা কমিউনিটি স্ট্যান্ডার্ডের মধ্যে ফেলে ব্লক করে বা অন্যান্য ব্যবস্থা নেয়।

সাইবার পুলিশের এই কর্মকর্তা আরও বলেন, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ভুয়া আইডি থেকে গুজব ছড়ানো হয়। এ জন্য সার্ভিস প্রোভাইডারদের সহযোগিতা লাগে। তাদের কনভিন্স করে তথ্য পাওয়ার জটিলতাও আছে। আবার দেশের বাইরে থেকেও অনেকেই করে থাকে। আমরা তাদের শনাক্ত করতে পারলে তার ঠিকানা যাচাই করে মামলা করি এবং আদালতে চার্জশিট দিই। এ ছাড়া আমরা ফরেন মিশন, কাউন্টার পার্ট বা বিদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকেও কাজে লাগাই।

বিটিআরসির পরিচালক পর্যায়ের এক কর্মকর্তা জানান, বিটিআরসির অনুরোধে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কর্তৃপক্ষ সাড়া কম দেয়, এটা ঠিক। কিন্তু আগের তুলনায় সাড়া দেওয়ার পরিমাণ বেড়েছে। বছর দুয়েক আগে যেটি ছিল ২২ শতাংশ, এখন সাড়া মিলছে প্রায় ৩৩ শতাংশ।

বিটিআরসি সূত্র জানায়, বাংলাদেশ থেকে কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স বা সমসাময়িক বিষয়ের কনটেন্ট (৬১ দশমিক ৪ শতাংশ) সরানোর অনুরোধ সবচেয়ে বেশি করা হয়। সে ক্ষেত্রে ২২ থেকে ২৫ শতাংশ সরানো হয়। হেট স্পিচ, বুলিং ও হ্যারাজমেন্ট সংক্রান্ত ১৫ দশমিক ৭০ শতাংশ কনটেন্ট সরানোর অনুরোধ করা হয়। এগুলোর মধ্যে সরানো হয় ৪৫ শতাংশের মতো। এ ছাড়া হাই প্রোফাইল কারও কনটেন্ট হলে সেগুলোর ৭১ শতাংশ, ভায়োলেন্স ইনসাইটমেন্টের ৮৫ শতাংশ, অপপ্রচারের ৩৫ শতাংশ এবং অন্যান্য আপত্তিকর কনটেন্টের ৭০ শতাংশ সরানো হয়।

বিটিআরসি সূত্র বলছে, বাংলাদেশ থেকে বেশির ভাগ আপত্তিকর কনটেন্ট হিসেবে বিবেচিত হয় কোনো ব্যক্তিবিশেষ নিয়ে সমালোচনা বা মিথ্যা প্রোপাগান্ডা ছড়ানো। কিন্তু অন্যান্য দেশে এগুলো সাধারণত সমালোচনা কিংবা বাক স্বাধীনতা হিসেবে দেখা হয়। ফলে এসব বিষয়ে সাড়া পাওয়া যায় কম।

বিটিআরসির এক কর্মকর্তা জানান, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে আপত্তিকর কনটেন্ট অপসারণের হার বাড়াতে ফলপ্রসূ ও যথাযথ প্রক্রিয়ায় রিপোর্ট দাখিল করার বিকল্প নেই। এ জন্য বিটিআরসি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থাসহ বিভিন্ন দপ্তরকে একাধিক ছকের মাধ্যমে আবেদন করতে নির্দেশনা দিয়েছে।

পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, অনলাইন থেকে গুজব সরানোর বিষয়ে চ্যালেঞ্জও আছে। কারণ কমিউনিটি স্ট্যান্ডার্ড বাংলাদেশ আর আমেরিকায় একই রকম নয়, অঞ্চলভেদে ভিন্ন হয়। অনেক সময় সার্ভিস প্রোভাইডাররা তাদের দেশের আইন দিয়ে বিবেচনা করে।

 

Comment here