আসাদুর রহমান : বগুড়ার শিবগঞ্জে সর্দি, জ্বর, কাশি ও শ্বাসকষ্টে মাসুদ রানা নামে এক ব্যবসায়ীর মৃত্যু হয়েছে। তার স্ত্রী মাজেদা বেগম জানান, মাসুদ রানা ২৪ মার্চ সুস্থ অবস্থায় বাড়িতে ফেরেন। পরদিন সর্দি, জ্বর ও কাশি শুরু হয়। স্থানীয় চিকিৎসকের কাছ থেকে ওষুধ এনে তাকে খাওয়ানো হয়। ২৭ মার্চ রাতে তার বেশি শ্বাসকষ্ট হয়। টিএমএসএস মেডিক্যাল কলেজ ও রফাতউল্লাহ কমিউনিটি হাসপাতাল এবং বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিক্যাল কলেজ (শজিমেক) হাসপাতালে অ্যাম্বুলেন্সের জন্য বারবার ফোন করেও সাড়া পাওয়া যায়নি।
এ অবস্থায় রাত সাড়ে ১১টার দিকে মাসুদ বিনা চিকিৎসায় মারা যান। এর পর স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে ফোন করে তাকে জানানো হয়, মৃত মাসুদের নাক থেকে সোয়াব সংগ্রহ করা হবে। পরদিন দুপুরে মৃত ব্যক্তির শরীর থেকে নমুনা সংগ্রহ করা হয়। শিবগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আলমগীর কবির জানান, ঢাকা থেকে রিপোর্ট না আসা পর্যন্ত আশপাশের অন্তত ১৫ বাড়ি লকডাউন থাকবে।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে জ্বর, সর্দি, কাশি নিয়ে ভর্তি দুই রোগী মারা গেছেন। গত বুধবার সন্ধ্যায় ঢামেকের সহকারী পরিচালক (অর্থ) ডা. আলাউদ্দিন আল আজাদ জানান, মঙ্গলবার হাসপাতালের আইসোলেশন ওয়ার্ডে সর্দি-কাশি উপসর্গ নিয়ে ওই দুজন ভর্তি হন। তাদের মধ্যে একজন ওই দিন রাতে এবং অন্যজন বুধবার ভোরে মারা যান। মরদেহ ঢামেক মর্গে রাখা হয়েছে। তাদের নমুনা জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে (আইইডিসিআর) পাঠানো হয়েছে। রিপোর্ট পেলে জানা যাবে তারা করোনায় মারা গেছেন, না অন্য কোনো সমস্যা ছিল। রিপোর্টে পজিটিভ এলে যথাযথ পদ্ধতিতে লাশ দাফন করা হবে। আর নেগেটিভ এলে লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হবে।
গত ৩০ মার্চ দিনাজপুরের বিরামপুরের আঁচলকোল তফসী গ্রামে জ্বর, সর্দি, কাশি ও শ্বাসকষ্ট নিয়ে মারা যান ফরহাদ হোসেন। এর পর আইইডিসিআরের নির্দেশনা অনুযায়ী জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ তার নমুনা সংগ্রহ করে নিয়ে যায়। দিনাজপুরের সিভিল সার্জন ডা. আবদুল কুদ্দুছ জানান, ওই যুবক কুমিল্লার এক বিদেশ ফেরত ব্যক্তির বাসায় কাজ করতেন। জ্বর, সর্দি ও কাশি নিয়ে তিনি ৭ দিন আগে কুমিল্লা থেকে বিরামপুর ফেরেন। আইইসিডিআরের নির্দেশনা অনুযায়ী তার নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে।
করোনা ভাইরাসের উপসর্গ নিয়ে দেশে এ পর্যন্ত প্রায় অর্ধশত মানুষ মারা গেছেন। তাদের মধ্যে অনেকেরই মৃত্যুর পর করোনা শনাক্তকরণ টেস্ট করা হয়েছে। অথচ মৃত্যুর আগে পরিবারের পক্ষ থেকে চেষ্টা করেও করোনার টেস্ট তো দূরের কথা, সাধারণ চিকিৎসার ব্যবস্থাও করা সম্ভব হয়নি।
আইইডিসিআর সূত্র জানায়, করোনা শনাক্তকরণ টেস্টের জন্য এ পর্যন্ত ১১ লাখ ৬৩ হাজার ৮২৭টি কল করা হয়েছে। এর মধ্যে টেস্ট করা হয়েছে মাত্র এক হাজার ৯০৬ জনকে। এ বিষয়ে আইইডিসিআরের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা মঙ্গলবার নিয়মিত অনলাইন ব্রিফিংয়ে বলেন, ঢাকা ও ঢাকার বাইরে বেশ কিছু মৃত্যু নিয়ে জনমনে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে যে, তারা করোনা ভাইরাসে (কোভিড-১৯) আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন কিনা। আমরা তাদের মধ্যে কয়েকজনের দাফন হয়ে যাওয়ার আগে নমুনা সংগ্রহ করি। সেই নমুনা পরীক্ষা করে তাদের কারো শরীরেই করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ পাইনি। জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের জীবাণুবিদ ডা. খন্দকার মাহবুবা জামান জানান, করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত ব্যক্তির শরীরে দুই থেকে চার ঘণ্টা পর্যন্ত ভাইরাসটি থাকতে পারে। তবে কয় ঘণ্টা থাকতে পারে তা সুনির্দিষ্ট করে বলা যাবে না।
অথচ গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে দেখা যাচ্ছে, বগুড়ার মাসুদ রানার নমুনা সংগ্রহ করা হয় মৃত্যুর প্রায় ১২ ঘণ্টা পর। জানা গেছে, ঢাকাসহ দেশের ১৪ জেলায় ৩১ মার্চ বিকাল থেকে ১ এপ্রিল রাত ১২টা পর্যন্ত দুদিনে জ্বর, সর্দি, কাশি ও শ্বাসকষ্টসহ নানা রোগে ১৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। করোনা ভাইরাসে তাদের মৃত্যু হয়েছে কিনা তা নিশ্চিত হতে তাদের নমুনা সংগ্রহ করে আইইডিসিআরে পাঠানো হয়েছে।
প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্য অনুসারে দেশের বিভিন্ন জেলায় করোনা সংক্রমণের উপসর্গ নিয়ে এ পর্যন্ত প্রায় অর্ধশত রোগী মারা গেছেন।
শেরপুরের নালিতাবাড়ীর দক্ষিণ পলাশীকুড়া গ্রামের আওয়াল নামে এক ব্যক্তি শ্বাসকষ্টে ৩ দিন ভোগার পর ২৯ মার্চ রাতে মারা যান। পর দিন সকালে তার শরীর থেকে নমুনা নিয়ে আইইডিসিআরে পাঠানো হয়।
করোনা ভাইরাস সংক্রমণ সন্দেহে গত বুধবার আরও দুজনকে মোহাম্মদ আলী হাসপাতালের আইসোলেশন ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়েছে। এর মধ্যে এক কিশোর সন্ধ্যায় মারা যায়। সে ৬-৭ দিন ধরে পা ব্যথা, পা ফুলে যাওয়া ও শ্বাসকষ্ট নিয়ে ভর্তি হয়েছিল। সন্ধ্যায় তার শরীর থেকে নমুনা সংগ্রহ করা হয়।
ফেনী সদর উপজেলার পশ্চিম ছনুয়া গ্রামে বুধবার দুপুরে করোনা উপসর্গ নিয়ে এক যুবকের মৃত্যু হয়েছে। জেলা সিভিল সার্জন ডা. সাজ্জাদ হোসেন জানান, বিকালে ওই যুবকের নমুনা পরীক্ষার জন্য চট্টগ্রামের বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ট্রপিক্যাল অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিজে (বিআইটিআইডি) পাঠানো হয়েছে।
সুনামগঞ্জে জ্বর, শ্বাসকষ্ট, কাশিতে আক্রান্ত ৫৫ বছর বয়সী এক নারীর মৃত্যু হয়েছে। ৩০ মার্চ ভোরে সুনামগঞ্জ সদর হাসপাতালে তার মৃত্যু হয়।
যশোরে ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে আইসোলেশন ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন কাকলি (১২) নামের এক শিশু ৩০ মার্চ ভোরে মারা যায়। হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. দিলীপ কুমার রায় জানান, ২৯ মার্চ বিকালে করোনা সন্দেহে শিশুটিকে আইসোলেশন ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়। পর দিন সকালে নমুনা সংগ্রহ করার কথা ছিল। তার আগেই সে মারা যায়।
পিরোজপুরের ভা-ারিয়ার দক্ষিণ-পূর্ব ধাওয়া গ্রামের এক ব্যক্তি জ্বর, সর্দি-কাশি ও গলাব্যথা নিয়ে মঙ্গলবার মারা যান। উপজেলার গৌরীপুরের এক গৃহবধূ শ্বাসকষ্ট নিয়ে বুধবার মারা যান। এ ছাড়া ইন্দুরকানীর উত্তর ভবানীপুর গ্রামে মঙ্গলবার রাতে শ্বাসকষ্ট ও জ্বরে আক্রান্ত হয়ে এক বৃদ্ধা মারা গেলে পরিবারের লোকজন হোম কোয়ারেন্টিনে আছেন। ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জের গোল্লা জয়পুর গ্রামে মঙ্গলবার রাতে জ্বর, সর্দি, কাশি ও গলাব্যথায় এক কলেজছাত্র মারা গেছে। ওই রাতেই উপজেলার মধুপুর বাজারের এক বৃদ্ধের মৃত্যু হয়।
কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ীতে ঢাকা থেকে এক ব্যক্তি গত বুধবার বিকালে নিজ বাড়িতে ফিরে মারা গেছেন। ফুলবাড়ী হাসপাতালের মেডিক্যাল টিম তার নমুনা সংগ্রহ করে আইইডিসিআরে পাঠায়।
Comment here