জয়ন্ত সাহা যতন : গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জে অধিকাংশ ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর নেই সরকারি অনুমোদন। কেউ আবার ডায়াগনস্টিক সেন্টারের অনুমোদন নিয়ে সাজিয়ে বসেছে হাসপাতালের ব্যবসা।
সেখানে ভর্তি করা রোগীর চিকিৎসার জন্য ভাড়া করে আনা হয় ডাক্তার। তাদের এমন ফাঁদে পড়ে নানা হয়রানি শিকার হচ্ছে অনেক রোগী। সাইনবোর্ড সর্বস্ব এসব প্রতিষ্ঠানে নিয়মনীতির বালাই নেই, হাতুড়ে টেকনিশিয়ান দ্বারাই চালানো হয় রোগ নির্ণয়ের যাবতীয় পরীক্ষা। প্রতিনিয়তই তারা মনগড়া রিপোর্ট তৈরি করে ঠকাচ্ছে নিরীহ মানুষকে। একই রোগ পরীক্ষায় একেকটি ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে একেক রকম রিপোর্ট পাওয়ার অনেক অভিযোগ রয়েছে।
অভিযোগ আছে, কমিশনের লোভে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের প্যাথলজিক্যাল বিভাগটিকে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে দেওয়া হয় না। এখানে দামী দামী আধুনিক যন্ত্রপাতি স্থাপন করা হলেও অজ্ঞাত কারণে সেগুলো পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে। এসব ডায়াগনস্টিক সেন্টারে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা থেকে শুরু করে জুনিয়র সার্জন পর্যন্ত নিয়মিত বসেন। এমনকি হাসপাতালে দায়িত্ব পালন করা অবস্থায় এসব ডাক্তার সেখানে গিয়ে রোগী দেখেন।
অনেকটা সময় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ডাক্তার না পেয়ে প্রাইভেট চেম্বারে যেতে হয় রোগীকে। এ ছাড়াও ডাক্তারদের পছন্দ মতো ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোতে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাতে বাধ্য করানো হয়। নির্দেশনা না মানলে এসব রিপোর্ট দেখেন না তারা।
এদিকে বেশিরভাগ ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো সরকারি অনুমোদন নেওয়ারও প্রয়োজনবোধ করে না। কেউ কেউ লাইসেন্সের জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে আবেদন পাঠিয়েই বড় বড় ডায়াগনস্টিক সেন্টার খুলে বসেছেন। ভুঁইফোড় এ প্রতিষ্ঠান গুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ব্যাপারে উপজেলা প্রশাসন বরাবরই চরম উদাসীন। এমনকি এসব প্রতিষ্ঠানের বৈধতা আছে কিনা তাও জানে না প্রশাসন। আর পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্রও নেয়নি অধিকাংশ ডায়াগনস্টিক সেন্টার।
অনুসন্ধানে জানা যায়, সুন্দরগঞ্জ উপজেলার পৌরশহরে ডায়াগনস্টিক সেন্টার আছে অন্তত ৬টি। প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে নুর ডায়াগনস্টিক, মা ডায়াগনস্টিক, সেবা ডায়াগনস্টিক, উত্তরবঙ্গ পপুলার ডায়াগনস্টিক ও নিউ ডিজিটাল ডায়াগনস্টিকসহ কোনো প্রতিষ্ঠানের চূড়ান্ত অনুমোদনের কাগজপত্র নেই। এমনকি পরিবেশ ছাড়পত্র প্রয়োজন তা জানেন না কেউ। তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে অনুমোদনের জন্য রেজিস্ট্রেশন করেছেন। আর ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো সব ৫০ শস্যার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সামনে গড়ে উঠেছ। এসব প্রতিষ্ঠানের কারোই বৈধ কাগজপত্র না থাকলেও জোড় গলায় বলে আমার ছাড়া আর কারো অনুমোদ নেই।
অন্যদিকে বামনডাঙ্গা ইউনিয়নের ৬টি ডায়াগনস্টিক সেন্টার গড়ে উঠেছে। এরমধ্যে আলিফ ডায়াগনস্টিক, বামনডাঙ্গা ডিজিটাল ডায়াগনস্টিক, সেভ লাইফ ডায়াগনস্টিক, ফাস্ট কিউর ডায়াগনস্টিক ও নবীন কান্ডারী নামে গড়ে ওঠা প্রতিষ্ঠানগুলো বৈধ কাগজপত্র থাকার দাবি করলেও নতুন করে নবায়ন করেনি অনেকে। তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে অনলাইনে করা আবেদনের রেজিস্ট্রেশন নাম্বারের কপি দেখিয়ে সেটাই লাইসেন্স দাবি করছে প্রতিষ্ঠানগুলো। আর সোনারায় ইউনিয়নের ছাইতানতলা বাজারে অনুমোদনহীন পিকেএসএফ নামের বেসরকারি স্বাস্থ্য সংস্থার নামে ডায়াগনস্টিক সেন্টার চালাচ্ছেন কয়েকজন। এ ছাড়া বেলকা, সীচা, ধর্মপুর, পাঁচপীর ও শোভাগঞ্জ এলাকায় বেশকিছু ডায়াগনস্টিক সেন্টার রয়েছে বলে জানা গেছে।
কাঁচামাল ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে মাছ ব্যবসায়ীরা পর্যন্ত ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মালিক বনে গেছেন। এমনকি সরকারি হাসপাতালের ডাক্তাররাও গড়ে তুলছেন এসব ডায়াগনস্টিক সেন্টারের ব্যবসা। সরকারি চাকুরির বিধি বিধান না মেনেই ডাক্তারদের অনেকেই শেয়ারে ব্যবসা করছেন সেখানে। তাদের কাছে আধুনিক চিকিৎসাসেবার কোনো গুরুত্ব নেই, আছে শুধু লাভের ফন্দিফিকির। রোগী মারার কারখানা হিসেবে পরিচিতি লাভ করছে অনেক ডায়াগনস্টিক সেন্টার। এ সব সেন্টার থেকে প্রাপ্ত রিপোর্ট নিয়ে রোগী ও তাদের স্বজনরা চরম বিভ্রান্তিতে পড়েন। নানা সমালোচনার মধ্যেও সরকারি হাসপাতালের এক শ্রেণির ডাক্তারদের সহায়তায় ডায়াগনস্টিক সেন্টার মালিকদের যথেচ্ছ টেস্টবাণিজ্য চলছে বছরের পর বছর। ডায়াগনস্টিক প্রতারণার শিকার মানুষজন বার বার অভিযোগ তুলেও প্রতিকার পাচ্ছেন না।
অন্যদিকে এসব প্রতিষ্ঠানের সামনে সুপরিচিত ডাক্তার বিশেষজ্ঞদের দীর্ঘ তালিকাযুক্ত বিরাট মাপের সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দেওয়া হলেও সরেজমিন গিয়ে তাদের কাউকে পাওয়া যায় না। রোগী আকর্ষণের জন্যই শুধু বিশেষজ্ঞদের নাম সাইনবোর্ডে লেখা হয় এবং নাম ব্যবহারের জন্য দেওয়া হয় কমিশন। বেশির ভাগ ডায়াগনস্টিক সেন্টারে সরকারি অনুমোদনপ্রাপ্ত সার্টিফিকেটধারী দক্ষ টেকনিশিয়ান পর্যন্ত নেই। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবসা পরিচালনার জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে দেওয়া সরকারি রেট চার্টের কোনো প্রয়োগ নেই। ক্লিনিক্যাল প্যাথলজির ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন ৮০ ও সর্বোচ্চ ৬০০ টাকা, মাইক্রোবায়োলজি অ্যান্ড ইমিউনোলজিতে সর্বনিম্ন ১৫০ ও সর্বোচ্চ এক হাজার ৩০০ টাকা, বায়োকেমিস্ট্রিতে সর্বনিম্ন ১২০ টাকা ও সর্বোচ্চ ৮০০ টাকা, হিস্ট্রোপ্যাথলজিতে সর্বনিম্ন ৫০০ ও সর্বোচ্চ ১ হাজার ২০০ টাকা, ড্রাগ এবিউজে সব ধরনের পরীক্ষা সাড়ে ৫০০ টাকা, থেরাপিউটিক ড্রাগের ক্ষেত্রে ৫০০ টাকা ও ভাইরোলজির ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন ২০০ ও সর্বোচ্চ ২ হাজার টাকা ফি নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোতে নির্ধারিত তালিকামূল্যের তুলনায় কয়েক গুন বেশি ফি নেওয়া হয় বলে অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগী রোগী ও তাদের অভিভাবকরা।
এ ব্যাপারে জানতে জেলা সিভিল সার্জন এ বি এম আবু হানিফ বলেন, আগে আমরা এসব প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স দিতাম। এখন সরাসরি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে অনলাইনে আবেদন করতে হয়। তা যাচাই করতে দপ্তর থেকে পাঠানো কাগজপত্র অনুযায়ী সরেজমিন পরিদর্শন করে প্রতিবেদন দাখিল করা হলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর রাইসেন্স প্রদান করেন। আর উপজেলা পর্যায়ে এসব প্রতিষ্ঠান তদারকি করবে উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা।
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ইয়াকুব আলী মোড়ল বলেন, আমরা ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো তদারকি করি না। এগুলো সব সিভিল সার্জন করে থাকে। সিভিল সার্জন অফিস থেকে এ সংক্রান্ত বৈধ প্রতিষ্ঠানের তালিকা চেয়েও না পাওয়ার অভিযোগ করেন তিনি।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সোলেমান আলী বলেন, ডায়াগনস্টিক সেন্টার গুলোর অনুমোদন স্বাস্থ্যঅধিদপ্তর দিয়ে থাকে। কাজেই আমার কাছে এসব প্রতিষ্ঠানের বৈধতার কোনো তথ্য জানা নেই। যদি ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর কোনো বৈধতা না থাকে তাহলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর চাইলে তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।
Comment here