রাশেদ রাব্বি : স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কেনাকাটা ও সংরক্ষণ দপ্তর হিসেবে পরিচিত সেন্ট্রাল মেডিক্যাল স্টোরস ডিপোকে (সিএমএসডি) অধিদপ্তরে উন্নীত করা হয়েছে। নতুন এই অধিদপ্তরের নাম দেওয়া হয়েছে ‘স্বাস্থ্য সরঞ্জাম অধিদপ্তর’। তবে নতুন এই অধিদপ্তরের কার্যপরিধি কতটা সেটি সুস্পষ্ট নয়। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কেনাকাটা সংক্রান্ত দপ্তরটিকে জনপ্রশাসন কর্মকর্তাদের নিয়ন্ত্রণে নিতেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এতে স্বাস্থ্য সরঞ্জাম কেনাকাটায় বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে। একই সঙ্গে যা সামগ্রিকভাবে দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
গত ২২ মে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের আওতাধীন সিএমএসডির দাপ্তরিক মর্যাদা অধিদপ্তরে উন্নীত করে বাংলায় ‘স্বাস্থ্য সরঞ্জাম অধিদপ্তর’ ও ইংরেজিতে ডিপার্টমেন্ট অব হেলথ সাপ্লাইস (ডিএইচএস) করা হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের উপসচিব লাবণী ইয়াসমীন স্বাক্ষরিত ওই প্রজ্ঞাপনে সিএমএসডিতে বিদ্যমান ২০২টি পদ থেকে ১৪১টি পদ বিলুপ্তি এবং অধিদপ্তরের জন্য ১৪টি ক্যাডার পদ স্থায়ীভাবে সৃজন করা হয়েছে। এ ছাড়া সৃজন করা হয়েছে বছর বছর সংরক্ষণের ভিত্তিতে অস্থায়ীভাবে ৭২টিসহ মোট ৮৬টি নতুন পদ।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাসপাতাল শাখার সঙ্গে সমন্বিতভাবে সিএমএসডি স্বাস্থ্য সরঞ্জাম কেনাকাটা ও সংরক্ষণ করত। এখান থেকেই সারাদেশে সেগুলো সরবরাহ করা হতো। দপ্তরের পরিচালক থেকে শুরু করে উপপরিচালক, সহকারী পরিচালক পদে মাঠপর্যায়ের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন চিকিৎসক কর্মকর্তারা দায়িত্ব পালন করতেন। যাদের হাসপাতাল পরিচালনায় বিভিন্ন যন্ত্রপাতি সম্পর্কে হাতে-কলমে ধারণা ছিল। ফলে রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসার ক্ষেত্রে কোন যন্ত্র ভালো, কোন যন্ত্র প্রয়োজন সেটি কর্মকর্তারা সহজেই বুঝতে পারতেন। এই প্রতিষ্ঠানে সবসময় একজন চিকিৎসক কর্মকর্তা পরিচালক পদে দায়িত্ব পালন করতেন। দেশে করোনা মহামারী শুরু হলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় অন্য অনেক প্রতিষ্ঠানের মতো এখানেও একজন অতিরিক্ত সচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তাকে পদায়ন করে। তিনি দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ক্রমেই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দূরত্ব সৃষ্টি হয়। এমনকি প্রতিষ্ঠানের নামফলক থেকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নামটি মুছে ফেলা হয়। ওই সময় সিএমএসডির বিরুদ্ধে নীতিমালা না মেনে ইচ্ছামতো কেনাকাটার অভিযোগ ওঠে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে রেন্ট-এ-কারের ব্যবসায়ী, ইউনিয়ন পরিষদের লাইসেন্সধারী ব্যবসায়ী ধরে এনে কোটি কোটি টাকার কার্যাদেশ প্রদান করা হয়। এসব বিষয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হলেও ওই কর্মকর্তা ছিলেন বেপরোয়া।
সিএমএসডির তৎকালীন কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, অনুসন্ধান করলে নিশ্চিত প্রমাণ পাওয়া যাবে, তখনকার অনেক কার্যাদেশের বিপরীতে কোনো মালামাল বুঝে নেওয়া হয়নি। এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে কার্যাদেশের বিপরীতে আংশিক বা স্বল্প পরিমাণে মালামাল গ্রহণ করা হয়েছে। প্রশাসন ক্যাডারের ওই কর্মকর্তা চিকিৎসা যন্ত্রপাতি কেনার ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের মতামতের গুরুত্ব দিতেন না। তিনিই উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে বাধাগ্রস্ত করতে সিএমএসডিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে পৃথক করার উদ্যোগ নেন। এ বিষয়ে স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ মহাসচিব অধ্যাপক ডা. এমএ আজিজ আমাদের সময়কে বলেন, ‘দেশে কোভিড-১৯ মহামারী চলাকালীন প্রশাসনের যে আগ্রাসী আচরণ আমরা দেখেছি, এটি তারই বহিঃপ্রকাশ। তাদের সর্বগ্রাসী মনোভাব আন্তঃক্যাডার বৈষম্য এখানে স্পষ্ট হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ পদগুলো প্রশাসন ক্যাডার কর্মকর্তাদের জন্য সংরক্ষিত রাখা হয়েছে। অর্থাৎ জনস্বাস্থ্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত কেনাকাটায় ও সংরক্ষণে কোনো দক্ষ অভিজ্ঞ এবং যোগ্যদের কোনো পদ সেখানে রাখা হয়নি। এমনকি যন্ত্রপাতি প্রয়োজন হয় হাসপাতালে। কিন্তু তাদের সঙ্গে হাসপাতালের কোনো সংযোগও থাকবে না। এতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে সঙ্গে নতুন এই অধিদপ্তরের ভয়াবহ সমন্বয়হীনতা সৃষ্টি হবে। প্রশাসনের এই সিদ্ধান্ত সামগ্রিকভাবে জনস্বাস্থ্যে নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করবে।
নতুন যেসব পদ সৃজন করা হয়েছে, এর মধ্যে ৪টি পদের বিপরীতে ১৪ কর্মকর্তা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে পূরণ করা হবে। এগুলো হলো- মহাপরিচালক একজন, পরিচালক দুজন, উপপরিচালক ৪ জন, সহকারী পরিচালক ৭ জন। এ ছাড়া তাদের জন্য চারজন ব্যক্তিগত কর্মকর্তা এবং ৬ জন ব্যক্তিগত সহকারীর পদ রয়েছে। এ ছাড়া একজন করে সিস্টেম অ্যানালিস্ট, আইন কর্মকর্তা, অ্যাসিসট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার, প্রোগ্রামার, অ্যাসিসট্যান্ট প্রোগ্রামারের পদ সৃষ্টি করা হয়েছে। একজন করে হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা, হিসাবরক্ষক, হিসাব সহকারী, দুজন ক্যাশিয়ার, একজন করে অডিট সুপার, অডিটর, স্টোর অফিসার, ১৪ জন স্টোরকিপার, তিনজন স্টোর সহকারী, আটজন উচ্চমান সহকারী, একজন নিরাপত্তা পরিদর্শক, পাঁচজন ক্লিয়ারেন্স অফিসার, ৬ জন ফটোকপি অপারেটর এবং ১১ জন অফিস সহায়ক। সব মিলিয়ে ৮৬ জন। অন্যদিকে যেসব পদ বিলুপ্ত করা হয়েছে, সেগুলো হলো- ফার্মাসিস্ট, স্টোনগ্রাফার, স্টোরকিপার, উচ্চমান সহকারী, স্টোনোটাইপিস্ট, কম্পিউটার অপারেটার, এস্কর্ট, দপ্তরি, চিফ টেকনিশিয়ান, টেকনিশিয়ান, মেকানিক, মিস্ত্রি, টিন স্মিথ, প্যাকার-লোডার, ইলেকট্রিশিয়ান, নিরাপত্তাপ্রহরী, পরিচ্ছন্নতাকর্মী। সব মিলিয়ে ১৪১টি পদ।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কয়েক কর্মকর্তা আমাদের সময়কে বলেন, মন্ত্রণালয়ের এই সিদ্ধান্ত দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার প্রতিকূলে। কারণ দেশের ১৮ কোটি মানুষের স্বাস্থ্য নিরাপত্তার দায়িত্ব অধিদপ্তরের। কিন্তু প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি কেনাকাটা আরেকটি প্রতিষ্ঠান করলে সেখানে কোনো সমন্বয় থাকবে না। তা ছাড়া এই প্রতিষ্ঠানের কেনাকাটা এখন হয়ে পড়বে ঠিকাদারনির্ভর। এতে দেশের স্বাস্থ্যসেবা ধীরে ধীরে পঙ্গুত্বের দিকে এগিয়ে যাবে। এ প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও মন্ত্রণালয়ের পদস্থ কর্মকর্তারা উষ্মা প্রকাশ করলেও বক্তব্য দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন। তবে তারা জানান, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একটি দপ্তরকে পৃথক অধিদপ্তরের পরিণত করা হয়েছে অনেকটা অগোচরে। এ বিষয়ে করণীয় নির্ধারণে গতকাল বুধবার রাতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে মহাপরিচালক স্বাস্থ্যমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করতে গেছেন। যদিও তাদের মধ্যে কী আলোচনা হয়েছে তা এখনো জানা যায়নি।
Comment here