নিজস্ব প্রতিবেদক : চলতি মৌসুমে ভারী বর্ষণ ও উজানের ঢলে সৃষ্ট বন্যার এক মাস পূর্ণ হল। ২৬ জুন থেকে বন্যা শুরু। ১১ জুলাই থেকে দ্বিতীয় দফায় পানি বাড়ে এবং ২১ জুলাই থেকে তৃতীয় দফায় পানি বাড়ছে। সুমদ্রে জোয়ারের কারণে দেশের মধ্যাঞ্চলে বন্যার পানি কমতে দেরি হতে পারে। আর জোয়ারে সমস্যা না হলে অগাস্টের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে দেশের সব জায়গা থেকে বন্যার পানি নেমে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে। আর তৃতীয় দফা বন্যাদুর্গত ১৬ জেলায় পানি বাড়তে পারে আরও দুই দিন। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান এসব জানিয়েছেন।
বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের তথ্য তুলে ধরে গতকাল শনিবার সচিবালয় থেকে এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে প্রতিমন্ত্রী বলেন, আগামী দুই দিনে মানিকগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, ফরিদপুর, মাদারীপুর, চাঁদপুর, রাজবাড়ী, শরীয়তপুর, ঢাকা, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, নাটোর, বগুড়া, জমালপুর, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল এবং নওগাঁ জেলার বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হতে পারে, তার পর পানি কমতে শুরু করবে। তবে আগামী ২৪ ঘণ্টায় সুনামগঞ্জ জেলায় বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে।
পূর্বাভাস তুলে ধরে প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান বলেন, ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বাড়ছে, এটা কিছুদিন অব্যাহত থাকতে পারে। গঙ্গা ও পদ্মা নদীর পানি বাড়তে পারে। উত্তর-পূর্বাঞ্চলের নদীর পানি কমছে। ঢাকা জেলার আশপাশের নদীর পানি আগামী ৪৮ ঘণ্টা পর্যন্ত বাড়তে পারে। উজানের ঢলে যমুনা ও বাঙ্গালী নদীর পানি বেড়ে বগুড়ার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। নতুন করে শনিবার দুপুর ১২টায় যমুনার পানি বিপদসীমার ১১৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। আর বাঙ্গালীর পানি বেড়ে বিপদসীমার ২০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। দুই নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে।
বগুড়া জেলা প্রশাসনের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা শাখা বলছে, যমুনা ও বাঙ্গালী নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় জেলার সারিয়াকান্দি, সোনাতলা ও ধুনট উপজেলায় সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে। বন্যার পানিতে নিমজ্জিত কৃষকের ৯ হাজার হেক্টর জমির পাট-ধান, বীজতলাসহ আবাদি ফসল।
জামালপুরে তিন দফা বন্যায় দীর্ঘ ২৫ দিন ধরে চরম দুর্ভোগের শিকার হচ্ছে জেলার প্রায় ১০ লাখ মানুষ। খাদ্য সংকটে রয়েছে লাখো দিনমজুর ও নিম্ন আয়ের পরিবার। গতকাল বেলা ৩টায় যমুনার পানি বাহাদুরাবাদ ঘাট পয়েন্টে বিপদসীমার ১১০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়।
পানিবন্দি পরিবারের অভিযোগ, করোনার পর ২৫ দিনের বন্যায় তাদের রোজগার বন্ধ। খাদ্য সংকটে থাকলেও এ দুর্দিনে প্রয়োজনীয় সরকারি ত্রাণ সহায়তা পাচ্ছেন না তারা।
কুড়িগ্রামে বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। তবে ধরলা নদীর পানি সামান্য কমলেও ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বাড়ছে। পানি বৃদ্ধিতে প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন গ্রামীণ জনপথ। তীব্র হয়ে উঠছে মানুষের খাদ্য, খাবার পানি, গো-খাদ্যের সংকট। কাঁচা-পাকা অনেক সড়ক পানির নিচে নিমজ্জিত রয়েছে। দীর্ঘদিন পানি স্থায়ী হওয়ায় মানুষের ঘরবাড়ির ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। শিশু, বৃদ্ধ ও নারীরা এ সংকটময় সময়ে দিশাহারা হয়ে পড়েছে। ডিসি অফিস সূত্র জানায়, জেলায় ২ লাখ ৫০ হাজার মানুষ পানিবন্দি রয়েছে।
এদিকে নাটোরের সিংড়া উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতি আরও অবনতি হয়েছে। সাতটি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভার লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। শনিবার বন্যাকবলিত এলাকা পরিদর্শন করেছেন আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক।
শনিবার সকালে সিংড়া আত্রাই নদীর পানি বিপদসীমান ৮৯ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় প্রতিদিনই পানিবন্দি হচ্ছেন হাজার হাজার মানুষ। করোনার ভয়ে আশ্রয় কেন্দ্রে আসছেন না অনেকে। গবাদি পশুসহ এক সঙ্গে নৌকা, ট্রাকে ও মাচা করে বসবাস করছেন তারা।
গাইবান্ধায় ব্রহ্মপুত্র, ঘাঘট, করতোয়া নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। ফলে জেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির আবারও অবনতি হয়ে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। দীর্ঘস্থায়ী এ বন্যায় কর্মহীন থাকায় খাদ্যাভাবে পড়েছেন দুর্গতরা। অন্যদিকে শুষ্ক মৌসুমে সদর উপজেলার কামারজানি ইউনিয়নের গো-গাট এলাকার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে প্রয়োজনীয় সংস্কার না করায় গোঘাট গ্রাম ও সংলগ্ন এলাকায় নদীভাঙন তীব্র আকার ধারণ করেছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের উদাসীনতায় শুক্রবার বিকালে ভাঙনের কবলে পড়ে ঐতিহ্যবাহী পুরাতন দুর্গামন্দিরসহ ৫০টি বসতবাড়ি ও সংলগ্ন জমি এবং গাছপালা বিলীন হয়ে গেছে।
রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ উপজেলার দৌলতদিয়ায় পদ্মার পানি আবার বৃদ্ধি পেয়েছে। শনিবার সকাল ৮টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ৬ সেন্টিমিটার পানি বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ১১০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। গোয়ালন্দ, রাজবাড়ি সদর, কালুখালী ও পাংশা উপজেলার ১২টি ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে পদ্মার ভাঙন দেখা দিয়েছে। জেলায় ৩০ হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে আছে।
ফরিদপুরের সদরপুর পদ্মা ও আড়িয়াল খাঁ পয়েন্টে গত ২৪ ঘণ্টায় গতকাল শনিবার পানি ছয় সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ১১০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে নতুন নতুন এলাকায় বন্যার পানি প্রবেশ করায় প্রবল স্রোতের তোড়ে চন্দ্রপাড়া হতে বাবুরচর সড়কের খালাসীডাঙ্গী ব্রিজ ভেঙে পড়ায় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। ভাঙনের হুমকির মুখে পড়েছে আশপাশের ঘরবাড়ি। তৃতীয় দফায় পানি বৃদ্ধির ফলে চরাঞ্চলের বানভাসি পরিবারগুলো গরু-ছাগল ও পরিবার-পরিজন নিয়ে খোলা আকাশের নিচে মানবেতর জীবনযাপন করছে।
পদ্মার পানি বৃদ্ধি ও উজানের ঢলে কুমার নদের পানি বেড়েছে। এতে রাজৈর উপজেলার কবিরাজপুর, ইশিবপুর ও বদরপাশা ইউনিয়ন প্লাবিত হয়েছে। এ ৩টি ইউনিয়নের অসংখ্য ঘরবাড়ি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, রাস্তাঘাট পানিতে তলিয়ে গেছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে প্রায় ২০ হাজার মানুষ। অন্যদিকে নদীর তীব্র ভাঙনে ঘরবাড়ি হারিয়েছে বেশ কয়েকটি পরিবার।
কিশোরগঞ্জের হাওর উপজেলা অষ্টগ্রামে দিনদিন বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ঘটছে। বন্যায় প্লাবিত হচ্ছে একের পর এক গ্রাম ও রাস্তাঘাট। ইতোমধ্যে উপজেলা সদরের সঙ্গে বাঙ্গালপাড়া ইউনিয়ন, পূর্ব অষ্টগ্রাম ও দেওঘর ইউনিয়নের একটি বৃহত্তর অংশ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। চল্লিশটি গ্রামের শহস্রাধিক পরিবার রয়েছে পানিবন্দি।
প্রতিবেদনটি তৈরিতে সহায়তা করেছেনÑ বগুড়া থেকে নিজস্ব প্রতিবেদক প্রদীপ মোহন্ত, জামালপুর থেকে নিজস্ব প্রতিবেদক আতিকুল ইসলাম রুকন, কুড়িগ্রাম থেকে নিজস্ব প্রতিবেদক মোল্লা হারুন উর রশীদ, নাটোর প্রতিনিধি আল মামুন, গাইবান্ধা প্রতিনিধি খায়রুল ইসলাম, রাজবাড়ী প্রতিনিধি রফিকুল ইসলাম, সদরপুর (ফরিদপুর) প্রতিনিধি প্রভাত কুমার সাহা, রাজৈর (মাদারীপুর) প্রতিনিধি মিলন খোন্দকার ও অষ্টগ্রাম (কিশোরগঞ্জ) প্রতিনিধি নজরুল ইসলাম।
Comment here