জনি রায়হান : ২০১১ সালে সুজন নামের এক যুবককে হত্যা করে লাশ খালে ফেলে গুম করার চেষ্টা করেছিলেন খুনিরা।কিন্তু হত্যার কয়েক দিন পরেই লাশ পানিতে ভেসে উঠে। মরদেহ ভেসে ওঠার পরে মামলার ভয়ে এলাকা ছেড়ে উধাও হয়ে যান অনেকেই।অবশেষে দীর্ঘ ৯ বছর পর জানা গেল এই হত্যার সঙ্গে জড়িত ছিলেন সুজনের সাবেক স্ত্রী-শ্যালকসহ কয়েকজন।
সম্প্রতি চাঞ্চল্যকর সুজন হত্যা মামলার ৯ বছর পরে তার সাবেক স্ত্রী ও শ্যালকসহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ বুর্যো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) ঢাকা মেট্রো (উত্তর)।
গত ২৯ ফেব্রুয়ারি সুজন হত্যা মামলার আসামি হিসেবে সুজনের সাবেক স্ত্রী আছমা আক্তার ইভাকে (৩২) কুমিল্লা জেলার লাকসাম থানাধীন মধ্য ইছাপুর গ্রামে তার বর্তমান শ্বশুরবাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করা হয়।
এরপর তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ইভার দুই ভাই মো. আরিফুল হক ওরফে আরিফ (৩৪) ও মো. রানা ওরফে বাবুকে (২৪) গত ১ মার্চ নারায়ণগঞ্জ জেলার ফতুল্লা এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়।
যেভাবে উদ্ধার হয় সুজনের মরদেহ
মামলা সূত্রে জানা যায়, ২০১১ সালের ১৪ মার্চ সুজন (২৬) তার বন্ধু কুটিরের সঙ্গে বাসা থেকে বের হয়েছিল। রাত ৯টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত সুজন বাসায় না ফিরলে সুজনের মা ছেলের মোবাইলে ফোন দিয়ে বন্ধ পান।পরে সারা রাত ছেলের কোনো খোঁজ না পেয়ে সকালে ছেলের বন্ধু কুটিরের বাসায় যান। কুটি তখন জানায় মাগরিবের আযানের পর সুজনকে সবুজবাগ থানা এলাকার রাজারবাগ রেখে তিনি চলে এসেছেন। মূলত সেই দিন থেকেই নিখোজ হয় সুজন।
সুজন নিখোঁজের পরে ২০১১ সালের ১৮ মার্চ দুপুরে সবুজবাগ থানা এলাকার দক্ষিণ রাজারবাগ বাগপাড়া শেষমাথা খালের ময়লা পানিতে কচুরিপানার সঙ্গে ভাসমান অবস্থায় একটি অজ্ঞাত গলিত ও গলায় ফাঁস লাগানো লাশ পাওয়া যায়। সবুজবাগ থানা পুলিশ লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে পাঠায়। এমন সংবাদ পেয়ে সুজনের পরিবারের লোকজন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে গিয়ে সুজনের মৃতদেহ সনাক্ত করেন।
তালাক দেওয়া স্ত্রীকে দেখতে যাওয়াই কাল হয় সুজনের
মামলা সংশ্লিষ্ট পিবিআইয়ের এক কর্মকর্তা দৈনিক আমাদের সময় অনলাইনকে বলেন, ‘নিহত সুজন গ্রিলের মিস্ত্রির কাজ করত। ২০০৮ সালে সুজন ইভা নামের এক মেয়েকে বিয়ে করে। ২০০৯ সালে ইভা সুজনকে ডিভোর্স দেয়। সুজন ইভাকে খুব বেশি ভালবাসত। তাই ডির্ভোস দেওয়ার পরও সুজন প্রায় সময় ইভাকে দেখার জন্য তাদের এলাকায় আসা-যাওয়া করত। কিন্তু ইভা সেটা ভালোভাবে নিত না। কারণ সুজনের সাথে বিয়ের আগে স্থানীয় ফাইজুল নামের এক ছেলে ইভাকে পছন্দ করত।’
পিবিআই আরও বলেন, ‘অপর দিকে সেই ফাইজুলের সাথে ইভার বড় ভাই আরিফ বন্ধুর মতো চলাফেরা করত। ফাইজুল বিভিন্ন সময় ইভাদের বাসায় আসা যাওয়া করত। এই ঘটনা নিয়ে ফাইজুল এবং ইভার বড় ভাই আরিফ ও সুজনের মধ্যে বিভিন্ন সময় তর্কবিতর্ক ও হাতাহাতি হয়। সুজন ইভার ভাই আরিফকে চড়-থাপ্পড় দেয় এবং আরিফ ও সুজনকে থাপ্পড় দেয়। সুজনকে হত্যা করার ৭/৮ দিন আগেও ফাইজুল সুজনকে মারধর করেছিল। এসব ঘটনার জের ধরে সুজনকে হত্যা করা হতে পারে প্রথম থেকেই সন্দেহ করেছিল সুজনের পরিবার।’
পলিথিন দিয়ে পেঁচিয়ে লাঠি দিয়ে পেটায় খুনিরা
আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে পিবিআই জানায়, হত্যার আগের দিন ২০১১ সালের ১৩ মার্চ সন্ধ্যার পর আরিফুল হক, ফাইজুল তাদের বন্ধু কুটি ও কালা বাবু ইভাদের বাসার সামনে মাঠে বসে সুজনকে হত্যা করার পরিকল্পনা করে। পরিকল্পনা অনুযায়ী ১৪ মার্চ সন্ধ্যা ৭টার সময় আরিফ তাদের বাসার পাশের চায়ের দোকান থেকে একটি সাদা পলিথিন ব্যাগ নেয়। ফাইজুল ও আরিফ লাঠি নিয়ে খালপাড় বালুর মাঠের দিকে যেতে থাকে। এরই মধ্যে কুটি চলে আসে। তারা তিনজন এক সঙ্গে খালপার বালুর মাঠে অপেক্ষার কিছুক্ষণের মধ্যে কালা বাবুও চলে আসে। এরপর রাত আনুমানিক ৮টার সময় কুটিরের সঙ্গে সুজন ওই খালপাড় বালুর মাঠে আসে। তাদের কথাবার্তার একপর্যায় ফাইজুল সুজনকে পেছন থেকে হাত আটকে ধরে। আরিফ পকেট হতে পলিথিন বের করে কুটিকে দেয়। কুটি পলিথিন ব্যাগ নিয়ে সুজনের মাথার উপর থেকে গলায় ঢুকিয়ে দিয়েই গলার মধ্যে পেচ দিয়ে গিট দিয়ে ফেলে। আরিফ লাঠি হাতে নিয়ে সুজনকে পেটাতে থাকে। পরে কালা বাবু আরিফের হাত থেকে লাঠি নিয়ে সুজনকে পেটাতে থাকে। কিছুক্ষণ পরই সুজন মাটিতে লুটিয়ে পরে। সুজন মারা গেছে নিশ্চিত হয়ে তারা ধরাধরি করে লাশ পাশেই খালে ফেলে দেয়।
সুজনকে হত্যার পরে কুটি এবং কালা বাবু খালের নিচে নেমে সুজনের লাশ পানিতে ভাসিয়ে দেয়। পরে তারা সবাই এলাকায় চলে আসে। এরপর ১৮ মার্চ ইভা ও আরিফদের বাড়ির পেছনে রাস্তার মাথায় খালের ভেতর অজ্ঞাতনামা এক ব্যক্তির লাশ পাওয়া গেছে লোকজন বলাবলি করলে আরিফ লাশ দেখতে যায়। পরের দিন আরিফ ও তার ছোট ভাই বাবু কেরানীগঞ্জ তাদের আত্মীয়ের বাসায় চলে যায় এবং তাদের বোন ইভা তাদের গ্রামের বাড়ি শরীয়তপুর চলে যায়। ২/৩ দিন পর তাদের বাবা-মাও গ্রামের বাড়িতে চলে যায়। পরে দীর্ঘদিন ধরে তারা পালিয়ে ছিল।
৯ বছর পর যেভাবে গ্রেপ্তার হলো খুনিরা
মামলা ও তদন্তকারী সংস্থা সূত্রে জানা যায়, এই মামলাটি প্রথমে সবুজবাগ থানা পুলিশ ও পরবর্তীতে ডিবি দীর্ঘ প্রায় ৭ বছর তদন্ত করে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। সেই অভিযোগপত্রের বিরুদ্ধে নিহতের বাবা নারাজির আবেদন করেন। তখন আদালত পিবিআইকে মামলাটি তদন্ত করার নির্দেশ দেন।
পিবিআই তদন্তে নেমে আধুনিক তথ্য প্রযুক্তির মাধ্যমে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় জড়িত আসামিদের অবস্থান নিশ্চিত হয়। পরে মামলাটির তদন্ত তদারককারী অফিসার পুলিশ সুপার মিনা মাহমুদার নেতৃত্বে একটি বিশেষ টিম অভিযান পরিচালনা করে সুজন হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় আসামিদের গ্রেপ্তার করে।
এই বিষয়ে পিবিআই’র বিশেষ পুলিশ সুপার মো. বশির আহমেদ বলেন, ‘সুজন হত্যার ৯ বছর পরে এই হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটন হয়েছে। গ্রেপ্তার আসামি আরিফুল হক ওরফে আরিফ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। অপর আসামিদেরও দিন দিনের পুলিশ রিমান্ডে নিয়ে এসে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে।’
Comment here