তাওহীদুল ইসলাম : এমনিতেই দেশি এয়ারলাইন্স ব্যবসা ঝুঁকির মুখে। এর মধ্যে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে দেখা দিয়েছে করোনা ভাইরাসের প্রকোপ। এ কারণে বিশ্বব্যাপী এভিয়েশন খাত ভুগলেও মারাত্মক প্রভাব পড়ছে এ দেশের উড়োজাহাজ সংস্থাগুলোয়।
ঘোষণা দিয়ে তিন মাসের জন্য কর্মীদের ছুটিতে পাঠিয়েছে রিজেন্ট এয়ারওয়েজ। নভোএয়ার ও ইউএস-বাংলার অবস্থাও ভালো নয়। এমনকি রাষ্ট্রায়ত্ত উড়োজাহাজ সংস্থা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স এখন বসিয়ে বসিয়ে উড়োজাহাজের গচ্চা দিচ্ছে। এমন পরিস্থিতি থেকে কবে নিস্তার মিলবে, উত্তর নেই কারও কাছে।
বর্তমানে করোনা ভাইরাসে মহামারীর কারণে বিশ্বব্যাপী ধস নেমেছে এয়ারলাইন্স ব্যবসায়। অধিকাংশ দেশ বিমান চলাচল বন্ধ রেখেছে। ফলে হাজার হাজার কোটি ডলারের ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে এয়ারলাইন্সগুলো। করোনা পরিস্থিতিতে লোকসান কমাতে বাংলাদেশ বিমান প্রথমেই ১০ ভাগ বেতন
কর্তনের সিদ্ধান্ত নেয়। সংস্থাটির বর্তমান জনবল পাঁচ হাজার ১৯৭। এই বিপুল কর্মীবাহিনীর বেতন পরিশোধই একমাত্র খরচ নয়। এর বাইরে রয়েছে লিজে আনা উড়োজাহাজের ব্যয়, ঋণের কিস্তি ও রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়। সব মিলিয়ে মাসে গুনতে হবে ন্যূনতম ৬২৮ কোটি টাকা। এর বাইরে আরও লোকসান আছে। করোনার কারণে টিকিটের টাকা ফেরত দেওয়া বাবদ গুনতে হচ্ছে ২৪০ কোটি ১৭ লাখ টাকা।
বাংলাদেশ বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোকাব্বির হোসেন আমাদের সময়কে বলেন, কেবল জনবলের বেতন নয়, উড়োজাহাজ কেনার ফিক্সড লোন, লিজের খরচ, রক্ষণাবেক্ষণ এবং টিকিট ফেরত বাবদ বিপুল অঙ্কের অর্থ গচ্চা দিতে হচ্ছে। এ ক্ষতি কবে কাটিয়ে ওঠা সম্ভব তা বলা যাচ্ছে না।
বিদ্যমান পরিস্থিতিতে এভিয়েশন খাত নিয়ে আন্তর্জাতিক টেলিকনফারেন্স হয়। গত মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত ওই সভায় চীন, ভারত, বাংলাদেশ, যুক্তরাষ্ট্র, নিউজিল্যান্ডসহ ৩৩টি দেশ ও ৩টি আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিরা অংশ নেন। বাংলাদেশের পক্ষে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মফিদুর রহমান অংশ নেন। এভিয়েশন ইন্ডাস্ট্রিতে এয়ারলাইন্সগুলোর যে ক্ষতি তা পূরণ করতে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো পদক্ষেপ আছে কিনা তা জানতে চাওয়া হয়। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বলা হয়, এ ব্যাপারে চিন্তাভাবনা আছে।
বেবিচকের চেয়ারম্যান মফিদুর রহমান বলেন, এয়ারলাইন্সগুলোকে কীভাবে সহায়তা করা যায় সে বিষয়ে আমরা কাজ করছি বলে আশ্বস্ত করেছি। যেহেতু আন্তর্জাতিকভাবে এটা স্বীকৃত এবং সব দেশই এয়ারলাইন্সগুলোকে সহায়তা করবে, আমরাও একইভাবে করব।
বিমান সূত্র জানিয়েছে, জানুয়ারিতে বিমানের সামর্থ্যরে চেয়ে ১৫ শতাংশ যাত্রী কম ছিল। ফেব্রুয়ারিতে এক হাজার ৬৫৬টি ফ্লাইটের মধ্যে বাতিল হয়েছে ১১৪টি। যাত্রী কমে ৫৮ শতাংশ। মার্চে বাতিল হয়েছে ৬৯৮টি ফ্লাইট। এ কারণে মার্চে বিমানের যাত্রী কমেছে ৪৬ শতাংশ। বিমান বিশ্বের ১৭টি গন্তব্য প্রতি সপ্তাহে ২১৮টি ফ্লাইট পরিচালনা করে থাকে। বর্তমানে সব কটি রুটই বন্ধ। তিন মাসে বিমানের যাত্রী কমেছে ৩৯ দশমিক ৬৬ শতাংশ। গত ১০ মার্চের পর থেকে বিমানের একের পর এক রুট বন্ধ হয়ে যেতে থাকে। সর্বশষ গত শনিবার সব শেষ দুটি রুটÑ যুক্তরাজ্যের লন্ডন ও ম্যানচেস্টারে বিমানের ফ্লাইট বন্ধ হয়েছে যায়। ৭ এপ্রিল পর্যন্ত এ দুটি রুটে ফ্লাইট চলাচল স্থগিত করে বিমান। অভ্যন্তরীণ রুটেও ফ্লাইট বন্ধ বিমানের। এ তিন মাসে টিকিট বিক্রির ২৪০ কোটি ১৭ লাখ টাকা ফেরত দিতে হবে বিমানকে। এ এয়ারলাইন্সের বহরে ১৮টি উড়োজাহাজ রয়েছে। এর মধ্যে ২৯৮ আসনের দুটি বোয়িং ৭৮৭-৯ মডেলের ড্রিমলাইনার, ২৭১ আসনের চারটি বোয়িং ৭৮৭-৮ ড্রিমলাইনার, ৪১৯ আসনের চারটি বোয়িং ৭৭৭-৩০০ ইআর এবং ১৬২ আসনের দুটি বোয়িং ৭৩৭-৮০০ মিলিয়ে বিমানের নিজস্ব উড়োজাহাজ রয়েছে ১২টি। বাকি ছয়টি উড়োজাহাজের মধ্যে চারটি ৭৩৭-৮০০ ও ৭৪ আসনের দুটি ড্যাশ-৮ লিজে আনা। করোনা ভাইরাসের কারণে ফ্লাইট বন্ধ হয়ে যাওয়ায় উড়োজাহাজের সবগুলোই বসে আছে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। এগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় বাবদ চলতি এপ্রিলে লাগবে ২৬৬ কোটি টাকা।
গত বছর বিমান লাভ করেছিল। এবার শুরু থেকেই লোকসানের দিকে যেতে হচ্ছে। কেবল টিকিট বিক্রি করে যাত্রী পরিবহন নয়, বিমান অতিরিক্ত ব্যাগেজ চার্জ, কার্গো পণ্য পরিবহন, দেশে চলাচলকারী দেশি-বিদেশি বিমান সংস্থাগুলোর পণ্য গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিং থেকেও আয় করে বিমান। গত বছর কার্গো পণ্য ও গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিং করে ৯০০ কোটি টাকা আয় করেছিল সংস্থাটি। গড়ে প্রতি মাসে ৭৫ কোটি টাকা আয় করত বিমান। আমদানি-রপ্তানি কমে যাওয়া, ফ্লাইট বন্ধ হয়ে যাওয়ায় চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে ৯০ কোটি টাকা আয় করেছে তারা। গড়ে আয় হয়েছে মাসে ৩০ কোটি টাকা। ২০১৯ সালে বিমান আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ রুটে ২৭ লাখ ৬২ হাজার যাত্রী বহন করেছে। কিন্তু গত জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত তিন মাসে গড়ে বিমানের যাত্রী কমেছে ৩৯ দশমিক ৬৬ শতাংশ।
Comment here