নিজস্ব প্রতিবেদক : নারায়ণগঞ্জের বন্দরের রসুলবাগে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণকারী এক নারীর হাসপাতালের রিপোর্টে মৃত্যুর কারণ ব্রেন স্ট্রোক উল্লেখ করা হলেও পরবর্তীতে নমুনা পরীক্ষার রিপোর্টে কোভিড-১৯ পজিটিভ ধরা পড়েছে।
নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলার রসূলবাগ এলাকায় করোনায় মৃত নারীর ছেলে মোহাম্মদ পাভেল আক্ষেপ প্রকাশ করে গতকাল শনিবার মোবাইল ফোনে এ কথা জানান।
পরীক্ষার রিপোর্ট গতকাল শনিবার ইমোতে পাঠিয়ে মৃত নারীর ছেলে বলেন,‘ মা শুধু একটি কাশি দিয়েছিল। এক কাশির অপরাধে ঢামেকে ভর্তি নেওয়া হলো না। কুর্মিটোলায় যখন গেলাম কোনো ডাক্তার নেই। আড়াই থেকে তিন ঘণ্টা মায়ের চিকিৎসায় আকুতি মিনতি করেছি একটু ছুঁয়েও দেখেনি কেউ। মাকে ধরার জন্য সামান্য একটু হেক্সিসল চেয়েছিলাম তাও দেয়নি। ভর্তি নেওয়ার পর একজন ওয়ার্ডবয় বা নার্স এগিয়ে আসেনি রোগীকে খাটে তুলতে। তাই হুইল চেয়ারে বসেই আমার মা মারা যায়। মরে যাওয়ার পর ডাক্তারের অভাব নেই। মৃত্যুর পর মৃত্যু সনদ (ডেথ সার্টিফিকেটে) লেখা ছিল মৃত্যুর কারণ ব্রেন স্ট্রোক। কিন্তু মৃত্যুর দুদিন পর ধরা পড়ল করোনাভাইরাস।’
মৃত নারীর ছেলে আরও বলেন, ‘এবার আপনারাই বলেন, ব্রেন স্ট্রোক করে মারা যাওয়া মাকে কি জানাজা দেবো না?’
ওই সময় তিনি ইমোতে করোনায় মৃত মা পুতুল বেগমের (৫০) ডেথ সার্টিফিকেটের কপি সরবরাহ করে বলেন, ‘দেখেন কুর্মিটোলা থেকেই আমার মা যে ব্রেন স্ট্রোকে মারা গেছে তা লিখে দিয়েছে।’
তিনি ভীতি প্রকাশ করে বলেন, ‘আমাদের বাড়িসহ এলাকার ১০০ পরিবারকে লকডাউন করা হয়েছে। বাড়ির সামনে এসে রাতের আঁধারে চিৎকার করে কে বা কারা প্রতিদিন হুমকি দিয়ে বলছে, তোদের একটা একটা করে মেরে ফেলব। কারণ আমরা নাকি করোনায় মৃত আমার মায়ের জানাজা দিয়েছি। কিন্তু আমরা তো আমার মাকে করোনা রোগী হিসেবে জানাজা দেই নাই। দিয়েছি ব্রেন স্ট্রোকের রোগী নির্ণয় করে।’
কারোনায় মৃত মা পুতুলের চিকিৎসা ও অসুস্থতার বর্ণনা দিয়ে পাভেল বলেন, ‘আমি শহরের ১ নম্বর রেলগেট এলাকায় কসমেটিক দোকান নিউ কদমরসূল স্টোরে চাকরি করি। আমার মা পুতুল দীর্ঘদিন ধরে নানা রোগে ভুগছিল। গত ২৯ মার্চ মায়ের শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। প্রথমে আমরা তাকে নারায়ণগঞ্জ খানপুর হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখানে কোনো চিকিৎসা হয়নি। পরে আমাদের পরিচিতি থাকায় শহরের ভিক্টোরিয়া জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যাই। সেখানে আমাদের পরিচিত থাকায় ডাক্তার কিছু টেস্ট দেয়। পরে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাতাপাতালে নিয়ে যাই। সেখানে রাতে ডিউটিরত ডাক্তার আমার মাকে বাইরে রেখে আমার সঙ্গে কথা বলে। ওই সময় তিনি আমার মায়ের রোগের কথা শুনে ভর্তি নেওয়ার প্রস্তুতি নেয়। কিন্তু একটি কাশি সব উলট পালট করে দেয়। বাইরে থাকা রোগী আমার মা একটি কাশি দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তার বলে দেয় ওনাকে ভর্তি নেওয়া যাবে না। তাকে কুর্মিটোলায় নিয়ে যান।’
‘আমরা কি করব ভেবে না পেয়ে মাকে ফের নারায়ণগঞ্জ নিয়ে আসি। কিন্তু মায়ের অবস্থা আরও খারাপ হয়ে যায়। ৩০ মার্চ দুপুরের দিকে নারায়ণগঞ্জের সকল ক্লিনিক ও হাসপাতালে যোগাযোগ করি কিন্তু কোথাও ডাক্তার নেই। পরে দুপুর ১টায় কুর্মিটোলা নিয়ে যাই। সেখানে হাসপাতালে নেওয়ার পর নার্সরা কেউ ছুঁয়েও দেখে নাই রোগীকে। সেখানে কোনো ডাক্তার ছিল না। আমি যখন মায়ের কথা বলি নার্সরা নিজেদের মধ্যে কথা বলছিল আর হাসছিল। পরে আমি চিৎকার করলে তারা ভর্তি নেয় কুর্মিটোলার বি ওয়ার্ড ৪৭ নম্বর বেডে। কিন্তু মায়ের ওজন খুব ভারী ছিল। অন্তত ৯০ কেজি হবে। আমি মাকে ধরার জন্য একটু হেক্সিসল দিতে বললে নার্সরা বলে দেয়, এগুলো সরকারি দেওয়া যাবে না। মায়ের ওয়ার্ডে মাকে বেডে শুয়াতে আমি ও আমার স্ত্রী অনুমতি পাই। দুজন মিলে মাকে আর বেডে তুলতে পারছিলাম না’, বলেন পাভেল।
তিনি বলেন, ‘নার্সদের ডাকলাম কেউ কাছে আসেনি। ওই সময় পাশের বেডে আরেক রোগীর সঙ্গে আসা এক যুবক বলল, আমি এখানে পাঁচ দিনেও কোনো ডাক্তার দেখি নাই। পরে আমি বাইরে গিয়ে অনেক প্রতিবাদ করি। পরেই একটি অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে আসে নার্সরা। কিন্তু অক্সিজেন সরবরাহ পাইপে কোনো মাস্ক লাগানো ছিল না। বাধ্য হয়ে মাকে শুধু পাইপ দিয়ে অক্সিজেন দেই। ধীরে ধীরে মায়ের শরীর ঠান্ডা হয়ে যায়। এক পর্যায়ে মা মারা যায়।’
নিহত নারীর ছেলে বলেন, ‘মায়ের চিকিৎসার অবহেলা দেখে অনেক কাকুতি-মিনতি করেছি আমার কুর্মিটোলা দরকার নাই। আমার মাকে ছেড়ে দেন চলে যাব। কিন্তু নার্সরা তখন বলছিল এখানে থাকলে ১৪ দিন পর ছাড়া আর বের হতে পারবেন না। মারা যাওয়ার পর ডাক্তারের অভাব নাই। চারদিক দিয়ে মায়ের লাশ ঘিরে ধরলো ডাক্তাররা। এই পরীক্ষা, সেই পরীক্ষা করল। কিন্তু ততক্ষণে তো মা আর নাই।’
পাভেল বলেন, ‘মায়ের নাক দিয়ে রক্ত বের হইছিল। জিজ্ঞেস করাতে ডাক্তার বলেন, ব্রেন স্ট্রোক করে মারা গেছে। করোনার কথা বলেও নাই। ডেথ সার্টিফিকেটেও ব্রেন স্ট্রোকের কথা লেখা আছে। পরে লাশ কুর্মিটোলা থেকে ডাক্তার আমাদেরকে বুঝিয়ে দিয়েছে। আমরা লাশ নিয়ে যেহেতু মা করোনায় মারা যায় নাই সেহেতু স্বাভাবিকভাবে জানাজা সম্পন্ন করেছি। কিন্তু আমরা যদি জানতাম মা করোনায় মারা গেছে তাহলে তো সতর্কতা নিয়ে লাশ দাফন করতাম।’
তিনি ডেথ সার্টিফিকেটের কপি ইমোতে সরবরাহ করে বলেন, ‘এখন এলাকার মানুষজন আমাদের ওপর ক্ষিপ্ত। অনেকেই ভুল বুঝছে। এমনকি বাড়ির বাইরে এসে নানাভাবে চিৎকার করে বলে যাচ্ছে তোদের সব কয়টাকে একটা একটা করে মেরে ফেলব।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের বাড়ির আশে পাশে প্রায় ১০০ পরিবারকে লকডাউন করা হয়েছে। কিন্তু অনেকের বাসায় খাদ্য নাই। অনেক সমস্যা চলছে। আমার পাশের বাড়ির লালন মিয়া ও ডলি বেগমসহ অনেকেই অভিযোগ করেছেন যে, কোথা থেকে কেউ খাবার দিয়ে যাচ্ছে না। তারা বেরও হতে পারছে না।’
Comment here