জনি রায়হান :গোপালগঞ্জ জেলার মুকসুদপুর থানার জলিরপাড় বাজারের ব্যবসায়ী ডিসিস্ট মঙ্গল সরদার হত্যার অন্যতম আসামি সুশান্ত বেপারীকে সম্প্রতি গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)৷ গ্রেপ্তার হওয়া সুশান্ত বেপারী আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডে সরাসরি অংশগ্রহণ করেছিল বলে আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে।
শুধু তাই নয়, স্ত্রীকে হারিয়ে কেন তিনি একজন মানুষকে হত্যা করেছেন তারও বর্ণনা দিয়েছেন। তার স্ত্রী পরকীয়া করে ভারতে পালিয়ে গেছেন নিহত ডিসিস্ট মঙ্গল সরদারের শ্যালক কিরিটি রায়ের সঙ্গে৷ ভারতে তারা সংসার করছেন এখন। কিন্তু স্ত্রীকে ফিরে পেতে অনেক চেষ্টা করেও কোনো লাভ না হওয়ায় নৃশংসভাবে হত্যা করেছেন ডিসিস্ট মঙ্গল সরদারকে।
আদালতে প্রদান করা সুশান্ত বেপারী ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি ও মামলা সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
যেভাবে পরকীয়ার জড়ায় স্ত্রী
আসামি সুশান্ত তার দেওয়া জবানবন্দিতে জানিয়েছেন, তিনি ওই এলাকার জলিল পাড় বাজারে একটি দোকানের ব্যবসা করতেন। একই বাজারে ব্যবসা করতেন কিরিটি রায়ও। তাই দীর্ঘ ১০-১২ বছর ধরে তাদের মধ্যে গভীর বন্ধুত্ব ছিল। সেই সুবাদে কিরিটি রায় প্রায়ই সুশান্তের বাড়িতে যাতায়াত করতেন। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে কিরিট সুশান্তের স্ত্রীর সঙ্গে পরকীয়ার সম্পর্ক তৈরি করে। যা সুশান্ত কখনো বুঝতে পারেনি।
পরে যখন বিষয়টি সুশান্ত বুঝতে পারে ততক্ষণে তার স্ত্রী কিরিটের সঙ্গে পালিয়ে যায়। তারা শুধু এলাকা থেকে নয় দেশ থেকেই পালিয়ে ভারতে চলে গেছে।
স্ত্রী হারিয়ে যেভাবে খুনি সুশান্ত
সুশান্তের ভাষ্য অনুযায়ী-তার স্ত্রী ছোট সন্তানকে নিয়ে কিরিটের সঙ্গে ভারতে পালানোর ফলে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন তিনি। সংসারে থাকা আরও দুই বাচ্চাদের দেখাশোনা করতে গিয়ে নিজের ব্যবসাও ঠিক মতো করতে পারছিলেন না।
ইতিমধ্যে সুশান্ত জানতে পারেন যে, তার স্ত্রীকে ভাগিয়ে নিয়ে দুলাভাই ডিসিস্ট মঙ্গল সরদারের বাসায় অবস্থান নিয়েছিল কিরিট। পরবর্তীতে তারা ভারতে চলে যায়। আর এই পুরো ঘটনায় কিরিটকে সহায়তা করেছেন তার দুলাভাই ডিসিস্ট মঙ্গল। তাই নিহত ডিসিস্ট মঙ্গলের কাছে গিয়েই স্ত্রীকে ফিরিয়ে আনার জন্য নানা রকমের অনুরোধ করেছে সুশান্ত। কিন্তু নিহত ডিসিস্ট মঙ্গল তার স্ত্রীকে ফিরিয়ে এনে দেবার কথা বলেও সুশান্তকে বার বার ঘুরাচ্ছিলেন।
সুশান্ত জানান, অপর দিকে সুশান্তের স্ত্রীকে ভাগিয়ে নিয়ে যাওয়া কিরিটি একই বাজারে মিষ্টির দোকানের ব্যবসা করতেন। ব্যবসায় ভালো করার কারণে একটি ট্রাক কিনতে চেয়েছিলেন কিরিটি। সে কারণে আল-আমিন নামে এক ব্যক্তিকে ৩০ লাখ টাকা দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু আল-আমিন তাকে ট্রাক তো কিনে দেননি, টাকাও ফেরত দেননি। নিজের পাওনা টাকা বার বার তার কাছ থেকে ফেরত চেয়েও পাচ্ছিলেন না কিরিটি।
ভারতে পালিয়ে যাওয়ার আগে তাই কিরিটি সেই আল-আমিনকে বলে যান, তার পাওনা টাকা যেন দুলাভাই মঙ্গল সরদারকে দিয়ে দেয়।
শ্যালকের পাওনা ওই ৩০ লাখ টাকা উদ্ধার করতে সেই আলামিনকে বার বার চাপ দিচ্ছিলেন নিহত ডিসিস্ট মঙ্গল সরদার।
মূলত এই দুটি ঘটনাই কাল হয় নিহত ডিসিস্ট মঙ্গল সরদারের। গত ১১ সেপ্টেম্বর খুন করা হয় তাকে। পরে ১২ সেপ্টেম্বর হাত-পা বাঁধা অবস্থায় মঙ্গলের মরদেহ উদ্ধার করে সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশ।
আলোচিত এ হত্যাকাণ্ডে জড়িত সুশান্তসহ মোট ৫ আসামিকে গ্রেপ্তার করেছে গোপালগঞ্জ জেলা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।
হত্যার পরিকল্পনা যেভাবে হয়
পিবিআই সূত্রে জানা গেছে, মঙ্গল সরদারের শ্যালক কিরিটি ও আল-আমিনের মধ্যে পাওনা টাকা নিয়ে অনেকবার ঝগড়া হয়। অপর দিকে স্ত্রীকে ভাগিয়ে নিয়ে যেতে কিরিটিকে সহযোগিতা করায় মঙ্গলের ওপর ক্ষিপ্ত হয় সুশান্ত। যার ফলে আল-আমিন তার রাইস মিলে সুশান্তকে নিয়ে মঙ্গল সরদারকে হত্যার পরিকল্পনা করেন।
পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী আল-আমিন তার সহযোগী আসামি কালাম, সবুজ, মনোজ, আকবর, মুশিয়ার, নাজমুল, লিটন ওরফে লিটু শেখসহ জলিরপাড় বাস স্ট্যান্ডে আলোচনায় বসেন। সেখানে আসামি আল-আমিন, মঙ্গল সরদারকে হত্যা করার জন্য আসামি কালাম, সবুজ, মনোজ, আকবর, লিটু মিয়া, মুশিয়ার প্রত্যেককে এক লাখ টাকা করে দেন।
যেভাবে হত্যা করা হয়
আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে সুশান্ত উল্লেখ করেছেন কীভাবে মঙ্গল সরদারকে হত্যা করা হয়েছে। পূর্ব পরিকল্পনা অনুসারে ১১ সেপ্টেম্বর মঙ্গল সরদারকে ডেকে নিয়ে সিন্ধিয়া বাজারে সুশান্তের কাঠের দোকানে যান। এ সময় আল আমিন, কালাম, মনোজ, সবুজ, আকবর, লিটু, মুশিয়ার, নাজমুল তার সঙ্গে ছিলেন। সেখানে সবাই একসঙ্গে চা পান করে সিদ্ধিয়া বাজার হতে জলিরপাড়ের দিকে হেঁটে রওনা দেন। তাদের সঙ্গে সুশান্তও আসেন।
ঘটনাস্থল সিন্ধিয়া বাজার হতে ১ কিলোমিটার পশ্চিমে উল্লাবাড়ীর সামনে ফাঁকা জায়গায় পৌঁছানো মাত্র আসামি সবুজ ডিসিস্ট মঙ্গল সরদারের মুখ চেপে ধরেন। এ সময় আসামি সুশান্ত লোহার রড দিয়ে মঙ্গল সরদারের মাথায় সজোরে আঘাত করে। ফলে তার মাথা ফেটে রক্ত বের হয়।
তখন অন্য সবাই মিলে লোহার পেরেক, লাঠি, ইট দিয়ে আঘাত করে মঙ্গল সরদারকে হত্যা করেন। সবার শেষে আল-আমিন ইট দিয়ে ডিসিস্ট মঙ্গল সরদারের মুখে আঘাত করে মৃত্যু নিশ্চিত করেন। এরপর রাত অনুমানিক ৮টা থেকে ৯টার মধ্যে সুশান্ত সহ অন্যান্য আসামিরা লাশ পাটের বস্তায় ভরে কুমোদ বাগচির হলুদ ও ধান ক্ষেতের মধ্যে নিয়ে ফেলে দেয়।
এই ঘটনার পরের গত ১২ সেপ্টেম্বর দুপুর ১২টা ৪৫ মিনিটে মঙ্গলের পরিবারের লোকজন সংবাদ পান যে, দক্ষিণ জলিরপাড় সাকিনস্থ কুমোদ বাগচীর ধান ক্ষেত ও হলুদ ক্ষেতের মাঝখানে ফাঁকা জায়গায় ঘাসের ওপর মঙ্গল সরদারের লাশ হাত পা বাঁধা অবস্থায় পড়ে আছে। এরপর সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশকে খবর দেওয়া হয়।
যেভাবে গ্রেপ্তার হয় আসামিরা
পিবিআই ও সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশ থেকে জানা গেছে, এই ঘটনার পরে নিহত মঙ্গল সরদারের ভাতিজা দুলাল সরদার বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে মুকসুদপুর থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলা নম্বর-১০।
গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর থানা পুলিশ সুরতহাল রিপোর্ট প্রস্তুত করে ময়নাতদন্তের জন্য লাশ মর্গে পাঠায়। মুকসুদপুর থানা পুলিশের দীর্ঘ ৩ মাস তদন্তাধীন সময়ে অত্র মামলার হত্যাকাণ্ডের ঘটনার বিষয়ে কোনো রহস্য উদঘাটন করতে না পারায় গোপালগঞ্জের পুলিশ সুপারের মাধ্যমে মামলাটি পিবিআই/সিআইডি দ্বারা তদন্তের জন্য পুলিশ হেডকোয়াটার্স এ আবেদন করে। পুলিশ হেডকোয়াটার্স মামলাটি পিবিআই গোপালগঞ্জ জেলাকে তদন্তের নির্দেশ দেয়।
তদন্তভার গ্রহণ করে পিবিআইয়ের এই মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা উপপরিদর্শক (এসআই) মো. আল-আমিন শেখের নেতৃত্বে পিবিআই’র শ্বাসরুদ্ধকর এক অভিযান পরিচালনা করে। অভিযানকালে তারা গত ১ জানুয়ারি সকাল ১১ টায় খাগড়াছড়ি জেলার দীঘিনালা থানাধীন রশিদনগরের দুর্গম পাহাড়ি এলাকা থেকে ঘটনায় জড়িত মূল আসামি কালাম শিকদারতে (৫২) গ্রেপ্তার করে। পরে তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে গোপালগঞ্জ জেলার মুকসুদপুর থানার জলিরপাড় এলাকা থেকে ওই রাতেই অন্য আসামিদেরও গ্রেপ্তার করা হয়।
গ্রেপ্তার হওয়া আসামিরা হলেন- মো. লিটন শেখ ওরফে লিটু (৫২), আকবর শেখ (৪৮) ও মো. মুশিয়ার শেখ (৫৮)। সর্বশেষ ঢাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে সুশান্ত বেপারীকে। কিন্তু এই মামলার অন্যতম আসামি আলামিন এখনো গ্রেপ্তার হয়নি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পিবিআই গোপালগঞ্জ জেলার পুলিশের এসআই ও মামলাটির বর্তমান কর্মকর্তা মো. আল-আমিন শেখ বলেন, ‘মঙ্গল সরদার হত্যার ঘটনার প্রায় তিন মাস পরে যখন পিবিআই তদন্তে শুরু করে তখন কালাম পালাতে চেয়েছিলেন ভারতে। পরে খাগড়াছড়ি থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। এরপর বাকি আসামিদেরও গ্রেপ্তার করা হয়েছে।’
পুলিশের এই কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘গ্রেপ্তার আসামি কালাম শিকদার, আসামি মো. লিটন শেখ ওরফে লিটু ও সর্বশেষ সুশান্ত বেপারী তাদের অন্যান্য সহযোগী আসামিদের নাম প্রকাশ করে হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করে আদালতে ফৌজধারী কার্যবিধি ১৬৪ ধারা মোতাবেক স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। ’
Comment here