তাওহীদুল ইসলাম : রেলওয়ের চলমান তিনটি প্রকল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। এর মধ্যে একটি রেলপথ নির্মাণ, বাকিগুলো হচ্ছে লোকোমোটিভ ও কোচ কেনার প্রকল্প। ঠিকাদারের কারণে প্রকল্প তিনটির বাস্তবায়ন কঠিন হয়ে গেছে। ফলে এক রকম অসহায়ত্ব প্রকাশ করেছে রেল কর্তৃপক্ষ। এ জন্য করণীয় নির্ধারণে ভাবতে শুরু করেছে সরকারের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন অনুবিভাগ (আইএমইডি)। গত ১০ এপ্রিল এ নিয়ে অনুষ্ঠিত বৈঠকে আরও বিস্তারিত জানতে চাওয়া হয়।
সূত্রমতে, ব্রিটিশ আমলে মৌলভীবাজারের কুলাউড়া থেকে শাহবাজপুর রেলপথটি ভারতের আসাম রাজ্যের সঙ্গে যুক্ত ছিল। পরে এটি বন্ধ হয়ে যায়। রেলপথটি সংস্কারে প্রকল্প নেওয়া হয় ২০১১ সালে। উদ্দেশ্য, দ্রুত সময়ের মধ্যে অধিক যাত্রী পরিবহন ও মালবাহী ট্রেন পরিচালনা নিশ্চিত করা। ১০ বছর পর এসে সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে প্রকল্পে নিযুক্ত ঠিকাদারের কার্যাদেশ বাতিলের। কারণ ওই ঠিকাদার সময়মতো কাজ করছে না। উপরন্তু এ সময়ে খরচ বেড়েছে ৪৭৭ শতাংশ। সমস্যা হচ্ছে, ওই ঠিকাদারকে বাতিল করতে গিয়ে নতুন করে সময় ও খরচ বাড়ার অবস্থা তৈরি হয়েছে। তাই চুক্তি বাতিল করবে নাকি ঠিকাদারকে সময় দেবে এ নিয়ে দোটানায় পড়ে গেছে রেল কর্তৃপক্ষ।
এ ছাড়া ২০০টি মিটারগেজ কোচ কেনার প্রকল্প হাতে নেয় রেলওয়ে। ঠিকাদারের মাধ্যমে ব্যবস্থা করা ঋণে এসব ইঞ্জিন কেনার কথা।
এ প্রকল্পটি ২০১৬ সালের ৪ অক্টোবর অনুমোদন দেয় একনেক। এতদিন পর এসে ওই ঠিকাদারের যোগ্যতা নিয়ে চিন্তায় পড়ে গেছে খোদ রেল কর্তৃপক্ষ। একই অবস্থা ৭০টি লোকোমোটিভ কেনার প্রকল্পেও। ঠিকাদারের অর্থায়নে এসব লোকোমোটিভ কেনার প্রকল্পটি বাতিলের সিদ্ধান্ত হয়েছে। ২০১১ সালে নেওয়া প্রকল্পটি এখন অসমাপ্ত রেখে সমাপ্ত হচ্ছে। এসব প্রকল্পের অবস্থা নিয়ে আইএমইডির মহাপরিচালক জহির রায়হানের সভাপতিত্বে বৈঠক হয়েছে। ওই বৈঠকে প্রকল্প তিনটির বাস্তবায়নের করুণ হাল নিয়ে আলোচনা হয়। এর পর আরও বিস্তারিত জানাতে নির্দেশ দিয়েছে আইএমইডি।
জানা গেছে, কুলাউড়া-শাহবাজপুর সেকশনের পুনর্বাসন (১ম সংশোধিত) শীর্ষক প্রকল্পের ঠিকাদার বাতিল করতে চিন্তা করছে রেল কর্তৃপক্ষ। এ প্রকল্পের ঠিকাদার টেক্সমাকো রেলের সঙ্গে ২০১৭ সালের ১৫ নভেম্বর চুক্তি করে বাংলাদেশ রেলওয়ে। এখন পর্যন্ত অগ্রগতি মাত্র ২৫ শতাংশ। প্রকল্পটি নিয়ে রেল মন্ত্রণালয় গত ১ ফেব্রুয়ারি বৈঠক করে। সেখানে ঠিকাদারের চুক্তি বাতিলের বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। ওই বৈঠকে ইআরডির পক্ষ থেকে বলা হয়, চুক্তি বাতিল করলে নতুন করে প্রাক্কলন ও টেন্ডারিং কাজ করতে আরও দুই বছর বেশি সময় লাগতে পারে। সে ক্ষেত্রে প্রকল্প ঋণটি অনমনীয় ঋণে পরিণত হবে। তখন এ নিয়ে রেল জানায়, অর্থায়নের উৎস যাই হোক কাজ শেষ করা দরকার। ঠিকাদার সংক্রান্ত সমস্যা ও অর্থায়ন নিয়ে ত্রিপক্ষীয় সভা হয়। সেখানেও চুক্তি বাতিল ও অবশিষ্ট কাজ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। ওই সভার পর গত ১০ এপ্রিল বৈঠক হয় আইএমইডিতে। সেখানে ধীরগতির কারণ হিসেবে বলা হয়, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের ওয়ার্ক প্রোগ্রাম না থাকা, জনবল, যন্ত্রপাতি ও মালামাল অপর্যাপ্ত থাকার কথা বলা হয়েছে। এ ছাড়া পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের জনবল সংকট এবং মেয়াদ বৃদ্ধি জটিলতায় চুক্তি মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে পড়ে। সাইটে গাছ ও বিদ্যুতের খুঁটিকে বাধা হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করেছে ঠিকাদার। করোনায় ভারতীয় সীমান্ত বন্ধ থাকায় মালামাল আমদানিতে মন্থর গতির কথা তুলে ধরা হয়। এ নিয়ে প্রকল্প পরিচালক সুলতান আলী আমাদের সময়কে বলেন, আমরা চাই দ্রুত কাজ শেষ হোক।
২০০ মিটারগেজ কোচ কেনার প্রকল্প নিয়েও বেকায়দায় পড়েছে রেলওয়ে। চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সিআরআরসি সিফাংয়ের সঙ্গে বাণিজ্যিক চুক্তি করে রেলওয়ে। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী তারা ঋণ জোগাড় করে দেবে। ক্রেডিট এগ্রিকোল করপোরেট অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক এ সংক্রান্ত আর্থিক প্রস্তাব পাঠায়। এর পর ২০১৯ সালের ২৮ অক্টোবর অনমনীয় ঋণবিষয়ক স্থায়ী কমিটির ২৯তম সভায় শর্তসাপেক্ষে অনুমোদন দেওয়া হয়। শর্তটি হচ্ছে ঋণ চুক্তির আগে সরবরাহকারীর মানসম্পন্ন পণ্য উৎপাদনের সক্ষমতা যাচাই করতে হবে। এ ছাড়া সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান যেসব দেশে তাদের তৈরি যাত্রীবাহী কোচ সরবরাহ করেছে সেসব দেশে একটি প্রতিনিধিদল পাঠাতে হবে। তারা সেসব পণ্যের গুণগতমান ও কর্মদক্ষতা যাচাই এবং প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা যাচাই করবে। এর অংশ হিসেবে ৩ সদস্যের প্রতিনিধিদল চীনে পাঠাতে অফিস আদেশ জারি হয়। ২০২১ সালের ৩০ অক্টোবর যাওয়ার কথা নির্ধারিত ছিল। কিন্তু করোনার কারণে যাত্রা বাতিল হয়। ঋণচুক্তির খসড়া চূড়ান্ত পর্যায়ে। কিন্তু শর্ত পালন না হওয়ায় প্রকল্পের বাণিজ্যিক চুক্তি কার্যকর হয়নি। তাই ভৌত অগ্রগতি শূন্য। তবে শর্ত পরিমার্জনে রেল মন্ত্রণালয় থেকে ইআরডিতে চিঠি দেওয়া হয়। এখনো রাজি হয়নি ইআরডি।
অন্যদিকে, ৭০টি মিটারগেজ লোকোমোটিভ কেনার প্রকল্পের অবস্থা নাজুক। সরবরাহকারীর ঋণে কোরিয়া থেকে ইঞ্জিনগুলো কেনার কথা। ২০১১ সালে নেওয়া এ প্রকল্পের পণ্য দেবে হোন্দাই রোটেম লিমিটেড। সাপ্লায়ার্স ক্রেডিট বা অন্য যে কোনো সহজ শর্তে এসব লোকোমোটিভ কেনার কথা ছিল। ডিপিপি অনুযায়ী ২০১১ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর প্রথমবার এবং ২০১৩ সালের ৪ জুলাই দি¦তীয়বার আহ্বানকৃত দরপত্রে কোনো গ্রহণযোগ্য দরদাতা মেলেনি। পরে ২০১৪ সালের ২২ ডিসেম্বর তৃতীয় দফা টেন্ডার আহ্বান করলে ২০১৮ সালের ১৬ মে সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি অনুমোদন দেয়। এর পর কোরিয়ার হোন্দাই রোটেম এর সঙ্গে ওই বছরের ১০ অক্টোবর বাণিজ্যিক চুক্তি করে রেলওয়ে। এর পর ঠিকাদারের আর্থিক প্রস্তাবের এর অংশ সাপ্লায়ার্স ক্রেডিট প্রপোজালটি একই বছরের ৭ জুন লোন নেগোসিয়েশন ও ঋণ চুক্তি সই করতে ইআরডিতে পাঠানো হয়।
চুক্তির খসড়ার ওপর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান-সংস্থা থেকে মতামত সংগ্রহ করে ইআরডি জানায়, কোরিয়ান কোম্পানি কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পে অর্থায়নের জন্য ‘সরকার কর্তৃক এত উচ্চ সুদে অনমনীয় ঋণ গ্রহণের পরিবর্তে কোরিয়ান সরকারের নমনীয় উৎসের বা অন্য কোনো উৎসের নমনীয় প্রকৃতির ঋণ সংগ্রহ করা বাঞ্ছনীয় হবে’। এ নিয়ে গত ১৮ নভেম্বর ঠিকাদারকে চিঠি দেয় প্রকল্প কর্তৃপক্ষ। জবাবে প্রতিষ্ঠানটি জানায়, নমনীয় প্রকৃতির ঋণ প্রস্তাব দাখিলের পরিবর্তে ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর স্বাক্ষরিত বাণিজ্যিক চুক্তি বাতিল বিবেচনা করে পারফরমেন্স ব্যাংক গ্যারান্টি ফেরত চায়। অর্থ বিভাগ ও ইআরডির মতামত পেয়ে এখন চুক্তি বাতিল ও ব্যাংক গ্যারান্টি ফেরত দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে রেলওয়ে। ফলে কেনাকাটা ছাড়াই বাতিল হচ্ছে ৭০ লোকোমোটিভ কেনার প্রকল্পটি।
Comment here