সকালের ৪০ টাকার পেঁয়াজ রাতেই ৫০ - দৈনিক মুক্ত আওয়াজ
My title
সারাদেশ

সকালের ৪০ টাকার পেঁয়াজ রাতেই ৫০

রেজাউল রেজা : রাজধানীর কদমতলীর সাদ্দাম মার্কেটে গতকাল সন্ধ্যায় পেঁয়াজ কিনতে যান বেসরকারি চাকরিজীবী মো. আনিস রহমান। কিন্তু দাম শুনেই আকাশ থেকে পড়েন তিনি। সকালের বাজারে যে পেঁয়াজের কেজি ৪০ টাকা দেখে গেছেন, রাতেই সেই পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৫০ টাকায়। ২৪ ঘণ্টা পার না হতেই একটা পণ্যের দাম কীভাবে কেজিপ্রতি ১০ টাকা বেড়ে যায়, তা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারেন না সীমিত আয়ের এ ব্যক্তি। দোকানির সঙ্গে কিছুক্ষণ বিত-ার পর পেঁয়াজ না কিনেই বাড়ি হাঁটা দেন তিনি।

কথা হলে আনিস এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘সকালের বাজারে পেঁয়াজের কেজি ৪০ টাকা ছিল। পরশু কিনেছি ৩৫ টাকায়। দাম বাড়তে পারে এমন খবর পাওয়ায় অফিস থেকে ফেরার পথে ভাবলাম আরও কিছু পেঁয়াজ কিনে রাখি। কিন্তু এখন সকালের সেই পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৫০ টাকা কেজি দরে। এটি কীভাবে সম্ভব!’

এ বাজারের মুদি দোকানদার মো. মিলন জানান, ‘একদিনের মধ্যে পেঁয়াজের কেজিতে এক লাফে ১০ টাকা দাম বেড়ে গেছে। তিনি বলেন, সকালে পুরনো কিছু পেঁয়াজ ছিল, যা ৪০ টাকা কেজিতে বিক্রি করেছি। আজ পেঁয়াজের যে নতুন বস্তা (৮০ কেজি) কিনেছি, তার দাম আগের তুলনায় প্রায় এক হাজার টাকা বেশি। আড়তেই দাম ১০-১২ টাকা বেড়ে গেছে। দেশি পেঁয়াজের বস্তা এখন তিন হাজার ২০০ টাকা। ৪৫ টাকার নিচে বিক্রি করা সম্ভব নয়।’

আমদানির অনুমোদনের মেয়াদ শেষ হওয়ায় ভারত থেকে পেঁয়াজ আসা বন্ধ রয়েছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, মূলত এ কারণেই দেশে পেঁয়াজের দাম বাড়ছে। খুচরা ব্যবসায়ীদের তথ্যানুযায়ী, সপ্তাহের ব্যবধানে দেশি পেঁয়াজের দাম কেজিতে ১৫-২০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে।

মালিবাগ বাজারের গাজী স্টোরের ব্যবসায়ী মো. মাসুদ রানা বলেন, গত সপ্তাহে পেঁয়াজের কেজি বিক্রি হয় ৩০-৩৫ টাকায়। আজ (বৃহস্পতিবার) বিক্রি হচ্ছে ৪৫-৫০ টাকায়। পাইকারি বাজারে কেজিপ্রতি ১২-১৫ টাকা পর্যন্ত দাম বেড়ে যাওয়ায় এমনটি হয়েছে।

এদিকে রাজধানীর আড়তদার ও পাইকারি বিক্রেতারা বলছেন ভিন্নকথা। তাদের দাবি, পাইকারি পর্যায়ে দাম ততটা বাড়েনি, যতটা খুচরা বিক্রেতারা দাবি করছেন। রাজধানীর শ্যামবাজারের পাইকারি বিক্রেতারা জানান, এ বাজারে গতকাল প্রতিকেজি দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হয় ৩০-৩২ টাকায়। শ্যামবাজারের মিতালী আড়তের ব্যবসায়ী কানাই সাহা আমাদের সময়কে বলেন, ‘মঙ্গলবার আড়তগুলোতে পেঁয়াজের দাম এক ধাক্কায় ৫-৭ টাকা বেড়ে যায়। এতে প্রতিকেজিতে এখন দাম পড়ছে ৩০-৩২ টাকা। বুধবার থেকে দাম আর বাড়েনি। ভারত থেকে পেঁয়াজ আসা বন্ধ, আবহাওয়াও খারাপ, বৃষ্টিও হচ্ছে- এসবে সুযোগ নিয়ে একশ্রেণির ব্যবসায়ী বাজারে অস্থিরতা তৈরির চেষ্টা করছেন। এ হুজুগে অনেক পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতা রাতারাতি দাম বাড়াচ্ছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘এবার দেশে পেঁয়াজের উৎপাদন অনেক ভালো। কিছু দিন আগেও খবরে এসেছে পেঁয়াজে উৎপাদন বেড়ে যাওয়ায় চাষিরা ভালো দাম পাচ্ছেন না। আর এখন ভারতের পেঁয়াজ বন্ধ হওয়া কেন্দ্র করে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে দাম বাড়াতে অনেক অসাধু ব্যবসায়ী দেশি পেঁয়াজ মজুদ করছেন। এর প্রভাবে দামটা হঠাৎ লাফিয়ে বাড়ছে।’

এ বাজারের আজমীর ভা-ারের ব্যবসায়ী তপু সেন আমাদের সময়কে বলেন, ‘পাইকারিতে দাম বেড়েছে। তবে খুচরায় দামটা বেশি বেড়েছে। সপ্তাহের ব্যবধানে পাইকারি পর্যায়ে ৮ থেকে সর্বোচ্চ ১০ টাকা পর্যন্ত দাম বেড়েছে। খুচরায় ৪০ টাকার বেশি বিক্রি হওয়াটা অযৌক্তিক।’

জানা গেছে, স্থানীয় হাট থেকে রাজধানীর খুচরা বাজারে পেঁয়াজ পৌঁছাতে পাঁচ থেকে ছয় হাত বদল হয়। এই হাতবদলেই পেঁয়াজের দাম বেড়ে যায়। আমদানি বন্ধ, আবহাওয়া খারাপ, ভারতে দাম বেড়ে যাওয়া ইত্যাদি অজুহাতে হাতবদলের সময় কেউ কেউ দাম অস্বাভাবিকভাবে বাড়িয়ে দেন। অথচ পাঁচ থেকে ছয় হাত বদলে পাঁচ থেকে সাত টাকার বেশি দাম বাড়ার কথা নয়। কিন্তু অনেক মধ্যস্বত্বভোগী বাড়তি মুনাফার লোভে পেঁয়াজ মজুদ করেন, দামও বাড়িয়ে দেন।

শ্যামবাজার পেঁয়াজ ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ মাজেদ আমাদের সময়কে বলেন, ফরিদপুরে আজ (বৃহস্পতিবার) পেঁয়াজের মণ এক হাজার ২০০ টাকা বিক্রি হচ্ছে। অর্থাৎ ৩০ টাকা কেজির পেঁয়াজ ঢাকার খুচরা বাজারে ৩৫-৩৭ টাকায় বিক্রি হওয়ার কথা। সেখানে ৪০ টাকায় বিক্রি হলেও কথা ছিল না, কিন্তু তা হচ্ছে না। হাতবদলের কোনো না কোনো পর্যায়ে কেউ দামটা বাড়িয়ে দিচ্ছেন।

শ্যামবাজারের আশপাশে রয়েছে অনেক ঢাল দোকান (বস্তা ভেঙে পেঁয়াজ ঢেলে বিক্রি করা হয়)। সেসব পাইকারি দোকানে গিয়ে দেখা গেছে, আড়তে ৩২ টাকা কেজিতে পেঁয়াজ বিক্রি হলেও এসব দোকানে পেঁয়াজের কেজি বিক্রি হচ্ছে ৩৮-৪০ টাকা। জানতে চাইলে এখানকার বিক্রেতারা জানান, এ পেঁয়াজ পাবনার ভালো জাতের বাছাই করা পেঁয়াজ। তাই বাড়তি দাম।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী, প্রতিবছর দেশে ২৫ লাখ টন পেঁয়াজের চাহিদা রয়েছে। সেখানে ২০২০-২১ অর্থবছরে পেঁয়াজ উৎপাদন হয়েছে ২৯ লাখ ৫৫ হাজার টন। এ থেকে ২৫ শতাংশ পেঁয়াজ নষ্ট হলেও অবশিষ্ট থাকে ২২ লাখ ১৬ হাজার ২৫০ টন পেঁয়াজ। এ হিসাবে দেশে পেঁয়াজের সংকট প্রকট হওয়ার কথা নয়। আর কিছু দিন আগেও পেঁয়াজের দাম না পেয়ে আক্ষেপ জানিয়েছেন চাষিরা। আর কৃষকদের ঠকিয়ে পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে বাড়তি মুনাফা করছেন মধ্যস্বত্বভোগীরা।

ভোক্তা অধিকার সংগঠন ‘কনজুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের’ (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, ‘হাতবদলের সংখ্যা অনেক বেশি হওয়ার ফলে পণ্যের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাচ্ছে। পেঁয়াজের ক্ষেত্রে আগেও এমনটি হয়েছে। কিন্তু এ থেকে ভোক্তারা পরিত্রাণ পাননি। এতে একদিকে কৃষক ন্যায্যমূল্য না পেয়ে ঠকছেন। অন্যদিকে ভোক্তারাও প্রতারিত হচ্ছেন। মধ্য দিয়ে অসাধু ব্যবসায়ীরা অল্প সময়ের ব্যবধানে বিপুল অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছেন। উৎপাদন, মজুদ ও সরবরাহের সঠিক তথ্য এবং বিভিন্ন পর্যায়ে মূল্য মনিটরিং করলে এমনটি হওয়ার সুযোগ থাকে না।’

ফরিদপুর সদরসহ ৯ উপজেলায় কমবেশি পেঁয়াজ উৎপাদন হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি পেঁয়াজ উৎপাদন হয় সালথা ও নগরকান্দা উপজেলায়। এর পরই চরভদ্রাসন, সদরপুর, বোয়ালমারীতে পেঁয়াজ আবাদ করা হয়। সদরপুর উপজেলার কৃষক মো. আলী আক্কাস আক্ষেপ করে বলেন, ‘আমাদের পেঁয়াজ উৎপাদন খরচ বেশি পড়ে, সে অনুযায়ী দাম ওঠে না। তাই কয়েক বছর ধরে আমরা পেঁয়াজ আবাদ কমিয়ে দিয়েছিলাম। এখন বাড়িয়েছি। কিন্তু দাম পাইনি এবার। দামের বিষয়ে সরকার যদি দাম নির্ধারণ করে দেয়, তা হলে আমরা পেঁয়াজ আবাদ করে লাভবান হতাম।’

পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার বোয়ালমারী গ্রামের কৃষক আবদুল ওহাব বলেন, ‘এখন পেঁয়াজের মণ বিক্রি হচ্ছে এক হাজার ১০০ টাকা পর্যন্ত। অথচ কিছু দিন আগে দাম পেয়েছি ৮০০-৯০০ টাকা। আমরা কৃষকরা দাম পাইনি। যারা আমাদের কাছ থেকে কিনে মজুদ করেছেন, তারা এখন বাড়তি দামে ঢাকায় পাঠাচ্ছেন। তারাই মূলত আমাদের ঠকিয়ে অতিরিক্ত মুনাফা করেন এবং ভোক্তাদের পকেট কাটেন।’

রংপুর সিটি বাজার আড়তদার সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘আমদানি না থাকায় গত সপ্তাহে ভারতীয় পেঁয়াজ রংপুরের বাজারে ছিল না। তার ওপর বৃষ্টির কারণে সময়মতো নতুন পেঁয়াজ তুলতে না পারায় বাজারে প্রভাব পড়েছে। এক সপ্তাহের ব্যবধানে রংপুরের পাইকারি বাজারে প্রতিকেজি পেঁয়াজে ১০ টাকা দাম বৃদ্ধি পেয়েছে।’

গত বছর পেঁয়াজ নিয়ে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছে ভোক্তাদের। ২০২০ সালেও ভোক্তাদের চরমভাবে ভুগিয়েছে পেঁয়াজ। এ সময় কেজিপ্রতি পেঁয়াজের দাম রেকর্ড ভেঙে বিক্রি হয় ২৫০ টাকা পর্যন্ত। তখন পরিস্থিতি সামাল দিতে চীন, মিয়ানমার ও পাকিস্তানসহ কয়েকটি দেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানি করা হয়। সেবার বিমানে করেও দেশে পেঁয়াজ আসে।

 

Comment here