শাহজাহান আকন্দ শুভ,হাসান আল জাভেদ ও মেহেদী হাসান : বরগুনার বহুল আলোচিত রিফাত শরীফ হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা হয়েছিল নয়ন বন্ডদের গোপন মেসেঞ্জার গ্রুপে। একইভাবে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ নির্যাতনের পরিকল্পনাও হয় মেসেঞ্জার গ্রুপে। ঘটনার একদিন আগেই এ নিয়ে বুয়েট ছাত্রলীগের একটি মেসেঞ্জার গ্রুপে নেতাকর্মীরা নিজেদের মধ্যে তথ্য আদান-প্রদান করেন। গ্রুপে ফাহাদকে পিটিয়ে হল-ছাড়া করার নির্দেশ দেওয়া হয়।
সেই নির্দেশনা বাস্তবায়ন করতে ফাহাদকে শেরেবাংলা হলের ২০১১ নম্বর কক্ষে ডেকে নেওয়া হয়। সেখানে দফায় দফায় প্রায় ৫ ঘণ্টার মারধরে ফাহাদ মারা যাওয়ার পর নির্যাতনে অংশ নেওয়া ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা বিচলিত হয়ে পড়েন। তারা রাতেই লাশ হলের বাইরে কোনো স্থানে ফেলে দেওয়ার পরিকল্পনা করেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাদের সেই পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। ফাহাদ হত্যা মামলায় রিমান্ডে থাকা আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদে এ ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উদঘাটন করেছে পুলিশ।
এদিকে ফাহাদ হত্যায় গতকাল বৃহস্পতিবার আরও ৩ জনকে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। তারা হলেন বহুল আলোচিত বুয়েট ছাত্রলীগ নেতা অমিত সাহা, ফাহাদের রুমমেট মিজানুর রহমান মিজান এবং হোসেন মোহাম্মদ তোহা। এ নিয়ে মামলাটিতে ১৭ জনকে গ্রেপ্তার করা হলো। তাদের মধ্যে ৩ জন মামলার ১৯ আসামির বাইরে ছিলেন। গতকাল গাজীপুর থেকে গ্রেপ্তার হন মামলার ১১ নম্বর আসামি তোহা।
বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের আইনবিষয়ক উপ-সম্পাদক অমিত সাহাকে গ্রেপ্তার করা হয় রাজধানীর সবুজবাগের কালীবাড়ির একটি বাসা থেকে। ঘটনার পর অমিত এই বাসায় আত্মগোপন করেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, হত্যাকা-ের আগের দিন শনিবার নিজেদের একটি মেসেঞ্জার গ্রুপে ফাহাদকে নির্যাতনের নির্দেশ দেন বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মেহেদি হাসান রবিন। সেখানে শনিবার দুপুর পৌনে ১টায় ১৬তম ব্যাচকে মেনশন করে রবিন লেখেন আবরার ফাহাদকে মেরে হল থেকে বের করে দিতে হবে দ্রুত। এজন্য দুদিন সময় বেঁধে দেওয়া হয়। পরদিন রবিবার রাত ৭টা ৫৫ মিনিটে সবাইকে হলের নিচে নামার নির্দেশ দেন মনিরুজ্জামান মনির। রাত ৮টা ১৩ মিনিটে ফাহাদকে নিজের কক্ষ থেকে ডেকে দোতলায় নিয়ে যান সাদাত, জেমি, তানিম, বিল্লাহসহ কয়েকজন। এর পর রাত ১টা ২৬ মিনিটে ইফতি মোশারফ সকাল মেসেঞ্জারে লেখেন, ‘ফাহাদ মরে যাচ্ছে। মাইর বেশি হয়ে গেছে’।
ফাহাদকে মারধরের প্রস্তুতি ও নির্যাতনের পরের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে আশিকুল ইসলাম বিটু গতকাল সাংবাদিকদের বলেন, ঘটনার আগে মনির তানিম ও জেমিকে ফোন দিয়ে বলে-ফাহাদকে ২০১১ নম্বর রুমে নিয়ে আসো। ২০১১ নম্বর রুমে এনে ফাহাদের মোবাইল, ল্যাপটপ সব চেক করা হয়। দুজন দুটি ফোন দেখে আর একজন ল্যাপটপ দেখে। কোথায় কোথায় ফাহাদের লাইক দেয় এবং কোথায় কমেন্ট করে এগুলো জিজ্ঞেস করা হয় দেখে দেখে। বিটু জানান, মারধরের পর কক্ষে ঢুকে তিনি দেখতে পান ফাহাদ অচেতন হয়ে পড়ে আছে। এ রকম কীভাবে হলো জিজ্ঞেস করলে মনির বলেন, ‘অনিক ভাই একটু বেশি মারছে’।
এ রকম অবস্থার পরও কাউকে জানানো হয়নি কেন জানতে চাইলে বিটু বলেন, আমি বুঝতে পারছিলামÑ অনেক মারা হয়েছে, ঢাকা মেডিক্যালে নিয়ে গেলে ঠিক হয়ে যাবে। হলে এ রকম হয় মাঝে মধ্যে।
ঘটনার রাতে ২০১১ নম্বর কক্ষের বাসিন্দা অমিত সাহার ঘটনাস্থলে উপস্থিতি নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। তবে মেসেঞ্জার গ্রুপে তার সক্রিয় থাকার তথ্য মিলেছে। নিজ কক্ষে এমন হত্যাকা-ের পর থেকে তিনি ছিলেন পলাতক। ঘটনার দিন অমিত সাহাও জড়িত ছিলেন বলে জানান বিটু। তবে ছাত্রলীগের তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন ও মামলায় অমিত সাহার নাম ছিল না। তবে হত্যাকা-ে অমিত যে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত, সেই অভিযোগ দুদিন ধরেই করে আসছিলেন বুয়েটের শিক্ষার্থীরা। জানা যায়, ফাহাদ হলে আছেন কিনা সে বিষয়ে প্রথম খোঁজ নিয়েছিলেন অমিত। ঘটনার দিন সন্ধ্যায় ফাহাদের এক বন্ধুকে ফাহাদ হলে আছে কিনা জানতে চেয়ে অমিত মেসেজ দেন।
জানা যায়, অমিত সাহার রুমে প্রথম দফায় মারধরের নেতৃত্ব দেন বুয়েট ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান রাসেল। তার সঙ্গে মারধর করেন বুয়েট ছাত্রলীগের বহিষ্কৃত সাংগঠনিক সম্পাদক মেহেদী হাসান রবিন ও উপ-সমাজসেবা সম্পাদক ইফতি মোশাররফ সকাল। পরে যোগ দেন অনিক, জিয়ন, মনির ও মোজাহিদসহ অন্যরা। প্রথম দফায় মারধর চলে রাত ১০টা পর্যন্ত। এর পর রাতের খাবার খাওয়ানো হয় ফাহাদকে। খাওয়ানো হয় ব্যথানাশক ট্যাবলেটও। দেওয়া হয় মলম। দ্বিতীয় দফা মারধরে অনিক ছিলেন সবচেয়ে মারমুখী।
ফাহাদ এ সময় বারবার বমি করছিলেন। একপর্যায়ে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় মুন্নার ২০০৫ নম্বর কক্ষে। সেখানে তার শরীরের ওপর অনিক ক্রিকেট স্টাম্প ভাঙেন। পরে আরেকটি স্টাম্প দিয়ে বেধড়ক পেটানো হয়। নির্মম পিটুনিতে ফাহাদ লুটিয়ে পড়েন। এর পর নিথর দেহ নিচে নামানোর চেষ্টা করেন ঘাতকরা। মাঝ সিঁড়িতে যেতেই তারা বুঝতে পারেন ফাহাদ মারা গেছেন। সিঁড়িতেই মরদেহটি রেখে তখন স্থান ত্যাগ করেন তারা। তার আগে তারা লাশ কী করা হবে এ নিয়ে আলোচনা করেন নিজেদের মধ্যে। তারা লাশ হলের বাইরে ফেলে দেওয়ারও পরিকল্পনা করেন। কিন্তু হলে সাধারণ শিক্ষার্থীদের উপস্থিতির কারণে তারা লাশ গুম না করেই সিঁড়িতে রেখে চলে যান।
গতকাল আসামি সকাল আদালতে ১৬৪ ধারায় দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরেছেন। গতকাল ঢাকা মহানগর হাকিম সাদবির ইয়াছির আহসান চৌধুরীর কাছে এই জবানবন্দি দেন তিনি।
সকাল জবানবন্দিতে উল্লেখ করেছেন, ফাহাদকে মেরে ফেলার কোনো পরিকল্পনা তাদের ছিল না। নির্যাতনে যে সে মারা যাবে তাদের মাথাতেই ছিল না। সকাল হত্যাকাণ্ডে জড়িত সবার নাম প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেছেন, ফাহাদ মারা যাওয়ার পর তারা সবাই আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। পুলিশ ঢুকলে বিপদে পড়তে পারেন এ জন্য তারা পুলিশকে হলের গেট থেকেই ফেরত পাঠান।
এদিকে গতকাল ফাহাদ হত্যা মামলার তদন্তের সবশেষ অবস্থা নিয়ে গতকাল ঢাকা মহানগর পুলিশের মিডিয়া সেন্টারে ব্রিফিং করেন কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের (সিটিটিসি) প্রধান মনিরুল ইসলাম। তিনি বলেন, ফাহাদ নৃশংসভাবে খুন হওয়ার তথ্য পেয়েই পুলিশ তৎপর হয়। এজাহার দায়েরের আগেই পুলিশ কাজ শুরু করে। তারা ১০ জনকে তাৎক্ষণিকভাবে গ্রেপ্তার করে। এজাহারে নাম নেই অথচ পরে গ্রেপ্তার হয়েছেন তিনজন। তারা হচ্ছেন অমিত সাহা, মিজানুর রহমান ও শামসুল আরেফিন। এজাহারে নাম না থাকা সত্ত্বেও প্রাথমিক তদন্তে নাম আসায় তাদের গ্রেপ্তার করা হয় বলে তিনি জানান।
মনিরুল ইসলাম বলেন, আসামিদের অধিকাংশই তাদের দায় স্বীকার করেছেন। তারা আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন।
হত্যাকা-ের মোটিভ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটি আমাদেরও তদন্তের মূল বিষয়। প্রাথমিকভাবে যে তথ্য পেয়েছি, পরবর্তী তদন্তে যদি তা না মেলে তাই আমরা এখনই মোটিভ সম্পর্কে বলতে চাচ্ছি না। অমিত সাহা জড়িত কিনা জানতে চাইলে বলেন, কোনো অপরাধের সঙ্গে কেউ ঘটনাস্থলে থেকেও জড়িত হতে পারে, কেউ ঘটনাস্থলে না থেকেও জড়িত হতে পারে। তথ্যপ্রযুক্তি, ডাটা বিশ্লেষণ এবং জিজ্ঞাসাবাদের তথ্য অনুযায়ী তারা মনে করছেন, ঘটনাস্থলে হয়তো অমিত ছিলেন না, কিন্তু ঘটনার সঙ্গে তার পরোক্ষ সংশ্লিষ্টতা ছিল। শুধুই ফেসবুক স্ট্যাটাস ফাহাদকে হত্যার মূল কারণ কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, মোটিভটা আমরা পরে ক্লিয়ার করব।
এদিকে প্রকাশিত সিসি ক্যামেরার ফুটেজে দেখা যায়, ফাহাদ হত্যাকারীরা ঘটনার পর রাতে দীর্ঘ একটি সময় কাটিয়েছেন হল প্রভোস্ট জাফর ইকবাল খান ও বুয়েট ছাত্রকল্যাণ পরিচালক মিজানুর রহমানের সঙ্গে। ঘটনার পর তারা বেরিয়ে হলের গেটেই অবস্থান করেন। সকালের দিকে হল সরগরম হয়ে উঠলে শুরু হয় ঘাতকদের ছোটাছুটি। সবচেয়ে বেশি মারধর করা অনিক দৌড়ে চলে যান তার রুমের দিকে। পরে ডাকা হয় ডাক্তার। তিনি ফাহাদকে দেখে মৃত ঘোষণা করেন। এর দুই মিনিট পর খুনিরা একটি স্ট্রেচারের ব্যবস্থা করেন। স্ট্রেচারটি সিঁড়ির মুখে বারান্দায় রাখা হয়। এর ২০ মিনিট পর লাশের কাছে আসেন প্রভোস্ট জাফর ইকবাল খান এবং ছাত্রকল্যাণ পরিচালক মিজানুর রহমান। প্রভোস্ট ও ছাত্রকল্যাণ পরিচালককে খুনিরা নিজেদের মতো করে ঘটনার বর্ণনা দিতে থাকেন।
Comment here