বিএনপির গত শনিবারের মহাসমাবেশ প- হয়ে যাওয়ার পর দলটির শীর্ষ নেতাদের কেউ জেলে, কেউ আত্মগোপনে চলে গেছেন। এর মধ্যে দলের মহাসচিবসহ আড়াই হাজারের অধিক নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বিএনপিও শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি থেকে সরে এসে কঠোর কর্মসূচিতে ঝুঁকেছে। তবে কঠোর কর্মসূচি ঝুঁকিপূর্ণ ও সংবেদনশীল হওয়ায় নেতাকর্মীদের দিকনির্দেশনা দেওয়ার মতো কোনো শীর্ষ নেতৃত্ব মাঠে নেই। আবার সরকারও রাজপথে অ্যাকশন এবং ব্যাপক ধরপাকড় ও তল্লাশিসহ কঠোর অবস্থানে নিয়েছে। এ অবস্থায় চলমান পরিস্থিতি মোকাবিলা করে সামনে এগিয়ে যাওয়াকে বড় চ্যালেঞ্জ মনে করছে দলটি। এর মধ্যে পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে ‘চাপ ও প্রলোভনে’ নেতাদের মনোবল শেষ পর্যন্ত ঠিক থাকবে কিনা সেটাও ভাবনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সব মিলিয়ে দীর্ঘদিন আন্দোলন করে সাফল্যের অপেক্ষায়
থাকা দলটি কঠিন এক পরিস্থিতিতে পড়েছে।
এরই মধ্যে ক্ষমতাসীনদের দিক থেকেও বিরোধীদের আন্দোলন শেষ হয়ে গেছে বলে ধারণা দেওয়ার চেষ্টা চলছে। তবে দলটির নেতারা মনে করেন সরকারই বিএনপিকে কঠোর কর্মসূচিতে যেতে বাধ্য করেছে এবং এর মধ্য দিয়ে দেশে-বিদেশে আন্দোলনের গ্রহণযোগ্যতা আরও বেড়েছে। এ ছাড়া তাৎক্ষণিকভাবে উদ্ভূত পরিস্থিতি, সম্ভাব্য কর্মসূচি এবং শীর্ষ নেতাদের গ্রেপ্তারের আশঙ্কায় এক নেতা গ্রেপ্তার হলে নেতৃত্ব যেন আরেকজনের স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলে যায় সেটি আগেই ঠিক রেখেছে দলটি। যেমন মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গ্রেপ্তারের পর তার স্থলে কাজ করছেন দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী।
বর্তমান পরিস্থিতিতে দলের অবস্থান জানতে আমাদের সময়ের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয় রুহুল কবির রিজভী সঙ্গে। তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, এখন কোনো কিছু নেতাদের হাতে নেই। আন্দোলনের পুরো দায়িত্ব সাধারণ মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিয়ে নিয়েছে। যে আন্দোলন সাধারণ মানুষ অংশ নেয়, সেই আন্দোলন গ্রেপ্তার করে বন্ধ করা যায় না। এবারের আন্দোলনের সফলতা খুব দ্রুত দেশবাসী দেখতে পাবে।
বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সামনে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। বিএনপির সিদ্ধান্ত শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনা সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে অংশ নেবে না। বরং সরকারের পদত্যাগসহ একদফার আন্দোলন চালিয়ে যাবে। এ জন্য গত ২৮ অক্টোবর মহাসমাবেশ প- করার প্রতিবাদ এবং একদফা দাবিতে হরতাল এবং গত মঙ্গলবার থেকে টানা তিন দিন সর্বাত্মক অবরোধের মতো কঠোর কর্মসূচি করে দেওয়া হয়েছে, যা আগামীতেও অব্যাহত থাকবে। তবে বড় ভাবনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে চলমান কঠিন পরিস্থিতিতে ‘চাপ ও টোপে’ নেতাদের মনোবল শেষ পর্যন্ত ঠিক থাকবে কিনা।
বিএনপির শীর্ষ নেতাদের কাছে এমন খবর আছে যে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা একাধিক শরিক দলকে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ব্যাপারে লোভনীয় টোপ দেওয়া হয়েছে। যদিও কোনো শরিক দল সেই টোপে সাড়া দেয়নি। বরং তারা সবাই রাজপথে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। এ প্রসঙ্গে দলের গুরুত্বপূর্ণ এক নেতা আমাদের সময়কে বলেন, সরকারের পাতা ফাঁদে পা দিয়ে জনগণের গ্রহণযোগ্যতা হারানোর ঝুঁকিতে এখন কেউ যাবে না। কারণ ক্ষমতাসীন দলটির অবস্থা এখন পড়তির দিকে।
সম্প্রতি দলের স্থায়ী কমিটির সভায় দেশের পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। সেখানে বিএনপি নেতারা বলেছেন, তারা (বিএনপি) নিজে থেকে চলমান কঠোর পথে যেতে চাননি। এটা সবার কাছে প্রমাণ হয়েছে। এই পথে বিএনপিকে যেতে সরকার বাধ্য করেছে। ক্ষমতাসীনদের দিক থেকে কেউ কেউ বলার চেষ্টা করছে, এই ঘটনায় বিএনপি বা বিরোধী দলের আন্দোলন শেষ হয়ে গেছে বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কিন্তু বিএনপি মনে করে, এমনটি ভাবার কারণ নেই। বরং চলমান আন্দোলন ও মহাসমাবেশের মাধ্যমে বিএনপি তিনটি বিষয়ে সফলকাম হয়েছে। একটি হচ্ছে বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে সব বিরোধী দলকে ঐক্যবদ্ধ করা। দ্বিতীয়ত, এই দাবিতে অসংখ্য মানুষকে জমায়েত করা। একই সঙ্গে গণতান্ত্রিক বিশ্বের সমর্থন। তিনটি দিকই বিএনপি অর্জন করতে সমর্থ হয়েছে।
এদিকে গত ২৮ অক্টোবরের মহাসমাবেশ প- নিয়ে দলের মধ্যে এখনো বিশ্লেষণ চলছে। দলটির নেতারা মনে করেন, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ দেশে ও বিদেশে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ায় ক্ষমতায় টিকে থাকতেই মূলত পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে হামলা করে মহাসমাবেশ প- করেছে।
এদিকে চলমান পরিস্থিতিতে গত ২৮ অক্টোবর মহাসমাবেশের পর দলটির কোনো নেতা তাদের নিজ ঠিকানায় (বাসাবাড়ি) থাকছেন না। ব্যবহার করছেন না তাদের নির্ধারিত মোবাইল ফোন। বিশেষ করে মহাসচিবকে গ্রেপ্তারের পর এমন কৌশলের আশ্রয় নিয়েছে দলটির নেতাকর্মীরা। তবে এ কৌশলেও রক্ষা পাননি দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস ও যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল।
রুহুল কবির রিজভী জানান, গত ২৮ অক্টোবর থেকে গতকাল বিকাল পর্যন্ত বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ৫৫টি মামলা হয়েছে। এতে ২ হাজার ৫৬৩ জনের বেশি নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তিনি দাবি করেন, চলমান কর্মসূচিগুলোতে হামলায় তিন হাজার ৪৩৬ জনের অধিক নেতাকর্মী আহত এবং ৯ জন (এক সাংবাদিকসহ) নিহত হয়েছে।
তবে দলীয় সূত্রে জানা গেছে, সরকার পতনের কঠোর কর্মসূচিতে গেলে আন্দোলন ব্যর্থ করতে দলের সিনিয়রসহ বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের গ্রেপ্তার করতে পারেÑ এমন আশঙ্কা আগেই করেছিল বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব। সেই আশঙ্কা থেকে আগেভাগে আন্দোলনকেন্দ্রিক নেতৃত্ব গড়ে তোলে দলটি। এ ক্ষেত্রে জাতীয় নির্বাহী কমিটি এবং ইউনিট কমিটিকে মূল হিসেবে ধরা হয়েছে। গত ২৮ অক্টোবর মহাসমাবেশের আগেই এই নেতৃত্ব গড়ে তোলে দলটি। এ জন্য গত এক মাস আগ থেকে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন।
সেই বৈঠক থেকে নির্দেশনা দেওয়া হয়, কোনো কমিটির সভাপতি বা সাধারণ সম্পাদক গ্রেপ্তার হলে তার অনুপস্থিতিতে কমিটির পরবর্তী নেতা তিনি নিজে থেকে দায়িত্ব বুঝে নেবেন এবং তার নেতৃত্বে মাঠের আন্দোলন চলবে। জাতীয় নির্বাহী কমিটির নেতাদের ক্ষেত্রেও একই নির্দেশনা।
এ প্রসঙ্গে বিএনপির মিডিয়া সেলের আহ্বায়ক জহির উদ্দিন স্বপন আমাদের সময়কে বলেন, দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের আহ্বান দেশবাসী যেভাবে সাড়া দিয়েছে, এতে সরকারের মাথা খারাপ হয়ে গেছে। যার কারণে, তাদের কথা বলা থেকে শুরু করে সব কিছুতেই একটা পাগলামির ছাপ আছে। সরকারের সামনে দুটি পথ খোলা আছে একটি গণতন্ত্রের পথ, আরেকটি উত্তর কোরিয়ার পথ। গণতন্ত্রের পথ চাইলে পদত্যাগ করে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের ব্যবস্থা করবে সরকার।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার আমাদের সময়কে বলেন, গত ২৮ অক্টোবর বিএনপির মহাসমাবেশ পণ্ড করা, নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া, মহাসচিব মির্জা ফখরুলসহ নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার এসব কিছু সরকার বিএনপিকে চাপে ফেলার জন্য করেছে। হয়তো বিএনপি চাপে পড়েছিল। কিন্তু ঘুরেও দাঁড়িয়েছে। আসলে সরকার বিএনপিকে একটি সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে দেশে-বিদেশে পরিচিতি করাতে চায়। তারা কী সেটা করতে পেরেছে? আমার তো মনে হয় পারেনি।
এ অবস্থায় নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে গতকাল আলোচনার জন্য বিএনপিকে চিঠি দেওয়া প্রসঙ্গে বদিউল আলম মজুমদার বলেন, সরকার একটি ‘নির্বাচন নির্বাচন খেলা করছে’।
Comment here