লাশবাহী একটি গাড়ি ফেনীর সোনাগাজী পৌরসভার উত্তর চর চান্দিয়া গ্রামে পৌঁছেছিল। সেই গ্রামের একটি স্কুল মাঠে জড়ো হয়েছিল হাজারো মানুষ। এখানেই জানাজা হয়েছে নুসরাত জাহান রাফির।
জানাজায় অংশ নেওয়া বেশিরভাগ মানুষই জীবনে একবারের জন্যও দেখেননি নুসরতাকে। কিন্তু তাদের চোখও আজ পানিতে ভাসে। নীরবে কেঁদেছেন অনেকেই।
হাজারো মানুষের চোখের পানিতে এভাবেই শেষ বিদায় নিলো নিজ মাদ্রাসার অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে লড়াই করা নুসরত। তার বান্ধবীরা আজও পরীক্ষা দিতে গিয়েছিল সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদরাসা কেন্দ্রে।
ওখানেই গত শনিবার পরীক্ষা দিতে গেলে তার গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন দেওয়া হয়। এরপর টানা পাঁচ দিন হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে গতকাল বুধবার রাতে শেষ নিশ্বাঃস ত্যাগ করেন নুসরাত।
বৃহস্পতিবার সোনাগাজী সাবের পাইলট সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে বড় বোনের জানাজায় হাজির হয়েছিল ভাই রাশেদুল হাসান রায়হানও। ছোটবেলার খেলার সঙ্গীকে এত তাড়াতাড়ি হারাতে হবে তা মনে হয় কখনও ভাবতে পারেনি এই কিশোর। বোনের শোকে বারবার জানাজার মাঠেই জ্ঞান হারাচ্ছিল সে। একই অবস্থা নুসরাতের বড় ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান, বাবা একেএম মুসা ও মা শিরিনা আক্তারেরও। ওই স্কুল মাঠে তারাও একাধিকবার অজ্ঞান হয়েছেন।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬টায় জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে দাদির কবরের পাশে সমাহিত করা হয় নুসরাতকে। জানাজায় ইমামতি করেন বাবা একেএম মূসা নিজেই।
এর আগে সকাল থেকে আত্মীয়-স্বজনসহ জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে দলে দলে মানুষ তাদের বাড়িতে ভিড় জমান। বিকেল ৫টায় সোনাগাজী পৌরসভার উত্তর চর চান্দিয়া গ্রামের বাড়িতে নুসরাতের লাশবাহী গাড়িটি পৌঁছালে হৃদয় বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়।
বোনের জন্য দোয়া চাইলেন নোমান:
নুসরাত জাহান রাফির জানাজায় বোনের জন্য দোয়া চাইলেন বড় ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান। জানাজার আগে দেওয়া বক্তব্যে কান্না জড়িত কন্ঠে দেশবাসীর কাছে দোয়া প্রার্থনা করেন তিনি।
নোমান বলেন, ‘গত পাঁচ দিন ধরে সারা দেশের মানুষ আমার বোনের প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজের ডাক্তাররা বোনের সুস্থতার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন।’ দেশবাসীর প্রতি নোমান কৃতজ্ঞতা জানান। এ সময় বোনের হত্যাকারীদের বিচারের দাবি করেন তিনি।
প্রসঙ্গত, গত ২৭ মার্চ সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলার বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানির অভিযোগে মামলা করেন ওই ছাত্রীর মা। মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে, ২৭ মার্চ সকাল ১০টার দিকে অধ্যক্ষ তার অফিসের পিয়ন নূরুল আমিনের মাধ্যমে ছাত্রীকে ডেকে নেন। পরীক্ষার আধাঘণ্টা আগে প্রশ্নপত্র দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে ওই ছাত্রীর শ্লীলতাহানির চেষ্টা করেন অধ্যক্ষ। পরে পরিবারের দায়ের করা মামলায় গ্রেপ্তার হন অধ্যক্ষ।
পরে গত ৬ এপ্রিল আলিম পর্যায়ের আরবি প্রথমপত্র পরীক্ষা দিতে সকাল ৯টার দিকে সোনাগাজীর ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসাকেন্দ্রে গেলে কৌশলে নুসরাতকে পাশের ভবনের ছাদে ডেকে নেওয়া হয়। সেখানে চার থেকে পাঁচ জন বোরকা পরা ব্যক্তি ওই ছাত্রীর শরীরে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। এতে তার শরীরের ৮০ শতাংশ পুড়ে যায়।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় নুসরাতকে গতকাল বুধবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসকরা।
Comment here