রাজধানীর বাড্ডায় কথিত ছেলেধরা সন্দেহে তাসলিমা বেগম রেনুকে গণপিটুনিতে হত্যাকারী ইবরাহীম হোসেন হৃদয়ের (১৯) ভাষ্য, সারাদেশে ছেলেধরা শুরু হয়ে গেছে, মহল্লায় অনেকের মতোই তার কাছে এমন গুজব বাস্তবসম্মত মনে হয়েছিল। গুজবে কান দিয়ে অন্যদের মতো সেও রেনুুকে পিটিয়ে হত্যা করে। আর পিটিয়ে হত্যার আগে তাসলিমা বেগম রেনুকে ছেলেধরা সন্দেহভাজন হিসেবে গুজব ছড়িয়ে দেন ঘটনাস্থল উত্তর বাড্ডা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এক নারী অভিভাবক।
ওই নারী রেনুকে দেখিয়ে গলাকাটা বলে চিৎকার করেন। তার প্ররোচনায় হৃদয় তার সবজি বিক্রির দোকান থেকে লাঠি এনে এলোপাতাড়ি রেনুুকে পেটাতে থাকে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) কাছে হৃদয় এসব কথা বলেন। হৃদয়ের তথ্য অনুযায়ী ডিবি সদস্যরা প্রযুক্তির সহায়তাসহ নানাভাবে ওই নারীকে শনাক্তের চেষ্টা করছে।
হৃদয় আরও জানায়, পিটিয়ে হত্যার পর নেতিবাচকভাবে তোলপাড় সৃষ্টির পর সে গুজবের বিষয়টি বুঝতে পারে। আর তখন গ্রেপ্তার এড়াতে মোবাইল ফোন ফেলে দিয়ে দ্রুত নারায়ণগঞ্জের ভুলতায় খালার বাসায় আশ্রয় নেয়। নিজেকে লুকানোর জন্য ন্যাড়া করে ফেলে মাথা। মঙ্গলবার রাতে হৃদয়কে গ্রেপ্তারের পর গতকাল দুপুরে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলন করা হয়।
এতে ডিবির অতিরিক্ত কমিশনার আবদুল বাতেন বলেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে হৃদয় জানিয়েছে-ঘটনার দিন রেনু স্কুলে প্রবেশ করার সময় গেটে থাকা অন্য এক নারী অভিভাবক তার পরিচয় এবং বাসার ঠিকানা জানতে চান। তখন রেনু ওই নারীকে তার নাম-ঠিকানা জানান। কিন্তু এরই মধ্যে ওই নারী রেনুুকে দেখিয়ে ছেলে ধরতে এসেছেন বলে চিৎকার শুরু করেন। এর পর হৃদয়সহ আরও কয়েকজনের সহায়তায় রেনুকে আটক করে স্কুলের একটি কক্ষে বন্দি করে রাখা হয়। দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এ খবর। মুহূর্তে হাজারো মানুষ ভিড় করে। তাদের মধ্যে কয়েকজন রেনুকে বের করে গণপিটুনি দেয়। হৃদয়ও তাদের সঙ্গে অংশ নেয়। ঘটনার পর হৃদয় যখন বুঝতে পারল সে গ্রেপ্তার হতে পারে, তখন নারায়ণগঞ্জে পালিয়ে যায়।
আবদুল বাতেন বলেন, রেনু এবং ওই নারী পূর্বপরিচিত কিনা সেটি খতিয়ে দেখতে হবে। ঘটনাটি পরিকল্পিত কিনা তা ওই নারীকে জিজ্ঞাসাবাদের পর বলা যাবে।
গ্রেপ্তারকৃত হৃদয়ের বাড়ি উত্তর বাড্ডার হাজিপাড়ায়। তিনি উত্তর বাড্ডা বাজারে সবজি বিক্রি করতেন। বিভিন্ন ফুটেজ দেখে হৃদয়কে এ হত্যাকা-ের মূল হোতা বলে চিহ্নিত করা হয়। হৃদয় ছাড়াও এর আগে বাড্ডা ও উত্তর বাড্ডা এলাকা থেকে ৭ জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
পুলিশ বলছে, স্কুলের গেটে এনে মাটিতে ফেলে ‘ছেলেধরা’ আখ্যা দিয়ে রেনুকে পিটিয়ে হত্যার সময় চারপাশ ঘিরে শতাধিক মানুষ ছিল। তাদের অনেকেরই হাতে ছিল মোবাইল ফোন। যাদের অধিকাংশই ছিল বয়সে কিশোর-তরুণ। কেউ কেউ ভিডিও করতে ব্যস্ত ছিল। নির্মমভাবে আঘাতের মধ্যেও প্রাণে বাঁচতে রেনুু নিজের পরিচয় দেয়। কিন্তু তার কথা কেউ বুঝতে চায়নি। আর হামলাকারীরা মুহূর্তের মধ্যে তাকে পিটিয়ে হত্যা করে।
এদিকে রেনুকে পিটিয়ে হত্যার নেতৃত্বদানকারী ও প্রধান আসামি হৃদয়কে জিজ্ঞাসাবাদে পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছে আদালত। দশ দিনের রিমান্ড আবেদনের শুনানি শেষে গতকাল বুধবার ঢাকা মহানগর হাকিম মোহাম্মদ জসিম এ রিমান্ড মঞ্জুর করেন। বিচারকের প্রশ্নের জবাবে হৃদয় বলেছে, এক মহিলা রেনুকে গলাকাটা বলায় আমি মেরেছি।
রিমান্ড শুনানিকালে বাড্ডা থানার জেনারেল রেকর্ডিং অফিসার (জিআরও) পুলিশের এসআই লিয়াকত আলী বলেন, ভিকটিম রেনুকে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। দেশবাসী এ ঘটনায় শঙ্কিত। এ আসামি হত্যার মাস্টারমাইন্ড। অন্যান্য আসামি শনাক্তের জন্য ১০ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করা প্রয়োজন।
ওই সময় বিচারক মামলার তদন্ত কর্মকর্তা বাড্ডা থানার ইন্সপেক্টর আবদুর রাজ্জাকের কাছে জানতে চান, আপনি কীভাবে নিশ্চিত হলেন, এই সেই হৃদয়। তখন তদন্ত কর্মকর্তা বিচারককে একটি ছবি দেখিয়ে বলেন, সে-ই হৃদয়। অন্যদিকে বাদীপক্ষে আইনজীবী জাহিদুল ইসলাম ও মাইদুল ইসলাম পলক শুনানিতে বলেন, ছেলেধরা গুজবে অনেককে নির্মমভাবে হত্যা করা হচ্ছে। এ মামলার ভিকটিমের ছোট একটা বাচ্চা আছে। বাচ্চাটা তার জন্য এখনো অপেক্ষা করছে তার মা আসবে। সে জানে না যে তার মা আর নেই। এ কথা বলে আইনজীবীরা আদালতে কেঁদে ফেলেন।
এর পর হৃদয়ের পক্ষে কোনো আইনজীবী না থাকায় বিচারক তার কাছে জানতে চান, কেন মারতে গিয়েছেন? তখন হৃদয় বলেন, এক মহিলা বলে তিনি গলাকাটা। ওই মহিলার ছবিও আছে। ওই মহিলাকে স্কুলের দ্বিতীয় তলায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তাকে মারা হয়। এর পর নিচে এনে তাকে অনেকে মারে। এর পর আমি মারি। ওই মহিলার কথায় তাকে আমি মেরেছি। স্যার আমার মা-বাবা নেই। আমাকে মাফ করে দেন। ওই সময় আদালতে রেনুর ১১ বছরের ছেলে তাসিন আল মাহিন মামলার বাদী নাসির উদ্দিন টিটুর সঙ্গে উপস্থিত ছিল। শুনানি শেষে আদালত ৫ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। এর আগে গত মঙ্গলবার সন্ধ্যায় হৃদয়কে নারায়ণগঞ্জের ভুলতায় নানির বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করা হয়।
মর্মান্তিক ওই ঘটনায় রেনুর ভাগ্নে নাসির উদ্দিন টিটু বাদী হয়ে অজ্ঞাত পরিচয় ৪শ-৫শ জনকে আসামি করে মামলা করেন। মামলায় হৃদয়ের আগে গ্রেপ্তারকৃত ছয়জনের মধ্যে জাফর গত সোমবার বিচারকের কাছে দোষ স্বীকার করে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন। পরে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়। এ ছাড়া শাহীন (৩১), বাচ্চু মিয়া (২৮) ও বাপ্পী (২১) নামে তিনজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ। গ্রেপ্তারকৃত অন্য দুজন হলেন-আবুল কালাম আজাদ (৫০) ও কামাল হোসেন (৪০)।
রেনুর ভাগ্নে টিটু জানান, রেনু লেখাপড়া শেষে আড়ং ও ব্র্যাকে চাকরি করেন। স্কুলেও শিক্ষকতা করেছেন। প্রায় ২ বছর আগে স্বামী তসলিম হোসাইনের সঙ্গে তার বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে। এর পর থেকে মায়ের সঙ্গে মহাখালীর ওয়্যারলেস গেটের একটি ভাড়া বাসায় ছেলেমেয়ে নিয়ে বসবাস করছিলেন। ছেলেকে ছয় মাস আগে তার বাবা গ্রামের বাড়ি নিয়ে যান। যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করা বড় ভাই মো. আজগার আলীর কাছে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেলেন রেনু।
সিসিটিভির ফুটেজে দেখা যায়, ছেলেধরা বলে বাইরে থেকে হট্টগোল শুরু হলে ৩ থেকে ৪ মিনিটের মধ্যেই স্কুলের কিছু অভিভাবক ও বাইরে থেকে আসা উচ্ছৃঙ্খল মানুষে ভরে যায় জায়গাটি। এর পর হাতেগোনা কয়েক যুবক মাটিতে ফেলে নির্মমভাবে লাঠি দিয়ে পেটায় রেনুকে। কেউ কেউ এলোপাতাড়ি লাথিও মারছিল।
Comment here