সাংবাদিকতা না থাকলে করোনায় আরও বেশি মানুষের মৃত্যু হতো - দৈনিক মুক্ত আওয়াজ
My title
আন্তর্জাতিক

সাংবাদিকতা না থাকলে করোনায় আরও বেশি মানুষের মৃত্যু হতো

অনলাইন ডেস্ক : চীনের উহান থেকে সারা বিশ্বে মহামারি রূপ নেওয়া নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণে এখন পর্যন্ত ১৭ লাখ ৮১ হাজারের বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়েছে। এই ভাইরাসে মৃত্যু হয়েছে ১ লাখ ৮ হাজার ৮৫৪ জনের। এত বিপুলসংখ্যক মানুষের প্রাণহানির ঘটনা ১৯৪৫ সালের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আর কখনো ঘটেনি।

সবার জন্য উন্মুক্ত একটি বৈশ্বিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থা কতটা প্রয়োজনীয় এবং জিন ম্যাপিং, ভ্যাকসিন তৈরি আর বিজ্ঞানের যে কী হাল তা দেখিয়ে দিয়েছে এই করোনাভাইরাস। তবে অন্য সবকিছু ছাপিয়ে গেছে যে বিষয়টি তা হচ্ছে সাংবাকদিকতা। এটি প্রমাণিত যে, সাংবাদিকতা না থাকলে করোনায় আরও অনেক, অনেক বেশি মানুষের প্রাণহানি হতো।

ফ্লিট স্ট্রিট ফক্স ছদ্মনামে নিবন্ধ লেখা খ্যাতনামা কলামিস্ট সুসি বোনিফেসের এমন মতামতই প্রকাশ করেছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য মিরর।

করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাব মোকাবিলায় যা যা করণীয়, চিকিৎসা বিজ্ঞানের সফলতা-ব্যর্থতা, সরকারের এ সংক্রান্ত নানা কার্যকর পদক্ষেপ, লকডাউন, অর্থনৈতিক পরিস্থিতির পর্যালোচনাসহ বিভিন্ন বিষয় জনসাধারণের কাছে তুলে ধরতে সাংবাদিকতার গুরুত্বের কথা এই নিবন্ধে উল্লেখ করা হয়েছে।

এই নিবন্ধে বলা হয়েছে, সরকার কর্তৃক ঘরে থাকার বার্তা যদি সঠিক সময়ে যথাযথভাবে সাধারণ জনগণের কাছে না পৌঁছাতো তবে কোনো ওষুধ এমনকি চিকিৎসকদের যাবতীয় প্রশিক্ষণ করোনা ঝুঁকিতে থাকা সবাইকে বাঁচাতে পারত না। স্বাস্থ্য উপদেশ ছাড়াও প্রায় সব কিছু ছাপিয়ে একটি রাষ্ট্রের স্বাধীন গণমাধ্যমগুলোতে প্রকাশিত করোনা আক্রান্ত ও মৃত্যুর খবর সাধারণ জনগণের মাঝে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছে।

একটি ধনী দেশ স্বচ্ছলভাবে তার নিজস্ব অর্থনীতিতে বিধিনিষেধ আরোপের জন্য, একটি ডানপন্থী সরকার দারিদ্র্য থেকে রক্ষার জন্য সমাজতান্ত্রিক পরিবর্তনকে আলিঙ্গন করার জন্য এক ধরনের রাজনৈতিক চাপের প্রয়োজন। এই রাজনৈতিক চাপের চেয়েও বেশি কষ্টসাধ্য ব্যাপার কোটি কোটি মানুষকে ঘরে রাখা। এই কঠিন কাজটি সহজ করেছে সাংবাদিকতা। এর সবগুলো ক্ষেত্রেই সাংবাদিকদের প্রয়োজন রয়েছে। কেননা, সংবাদমাধ্যমগুলোই নানা বয়সের, নানা শ্রেণি-পেশার মানুষকে এসব বিষয়ে সচেতন করতে পারে।

বিবিসি, আল জাজিরা, দ্য গার্ডিয়ান, ডেইলি মেইল, ফিনান্সিয়াল টাইমস, নিউ ইয়র্ক টাইমস, দ্য টেলিগ্রাফ, স্কাই নিউজ, চ্যানেল ফোর, মেট্রো, দ্য সান, দ্য এক্সপ্রেসের মতো বিখ্যাত আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত করোনা সংক্রান্ত বিভিন্ন প্রতিবেদন, আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা উল্লেখ করা, চিকিৎসক পরামর্শ, রোগীদের সার্বিক অবস্থা, বিশেষজ্ঞদের মতামত, অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ ইত্যাদি এই মানব বিপর্যয় মোকাবিলায় অনবদ্য অবদান রেখে চলেছে।

সুসি বোনিফেস বলেন, সংবাদ মাধ্যমগুলোতে রিপোর্টার, ফটোগ্রাফার, সহসম্পাদক, প্রডিউসার, প্রেজেন্টার, ফ্লোর ম্যানেজার, ক্যামেরা অপারেটর, সাউন্ড টেকনিশিয়ান, প্রিন্টার্স, ডিজাইনার, আর্টিস্ট এবং প্রযুক্তিগতভাবে, বাস্তবিকভাবে বা নৈতিকভাবে আরও অনেকেই এই মহান কাজে সংশ্লিষ্ট। নানা ধাপে ফিল্টারিং হয়ে খবরের সত্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েই তা প্রচার করা হয়।

সুসি বোনিফেস উল্লেখ করেন, উহানে মহামারি ছড়িয়ে পড়ার নিরবতা ভেঙেছিল সাংবাদিকরা। যখন চীনা কর্তৃপক্ষ ভুল তথ্য প্রকাশ করছিল, বারবার একই তথ্য দিচ্ছিল তখনও তা সামনে আনে সাংবাদিকরা। যেখানেই এসব মিথ্যা প্রাণঘাতী হয়ে উঠেছে সেখানেই তা প্রকাশ করেছে সংবাদমাধ্যমগুলো। ইরানে, উত্তর কোরিয়াতেও এসব সত্যি হয়ে উঠছে। চীন যেভাবে সত্য থামিয়ে রাখতে পারেনি সেভাবেই এসব দেশগুলোও এখন তা পারছে না।

সংবাদমাধ্যগুলোতে প্রকাশিত এই খবরগুলো নিয়ে প্রথমে শোরগোল হলেও পরে তদন্ত শেষে এখন বিষয়গুলো পরিষ্কার হয়ে গেছে। এই মহামারির দ্বিতীয়, তৃতীয় এবং চূড়ান্ত পরিস্থিতি কেমন হবে তাও প্রকাশ করছে সংবাদমাধ্যমগুলো।

এই কলামিস্ট মনে করেন, সাংবাদিকতা না থাকলে মজুদদারী, লুটপাটের মতো ঘটনাও ঘটতে পারে। একই সঙ্গে মহামারিতে শৃঙ্খলার দায়িত্বে থাকা পুলিশ তার নতুন ক্ষমতা নিয়ে অনেক ভুল করতে পারে। যদি পত্রিকায় বা সন্ধ্যার খবরে লকডাউন ভঙ্গকারীদের ছবি ছাপা না হয় তবে আরও বেশি মানুষ সংক্রমিত হবে এবং আরও বেশি মানুষের মৃত্যু হবে।

তিনি বলেন, ‘আমরা নির্ভুল নই। আমরা আপনাদের প্রিয় পাত্র নই। আমরা কখনোই আপনাদের ধন্যবাদ চাই না; আমরা চাই আপনারা আপনাদের চিন্তাগুলো মেনে চলুন।’

মানবজাতি হিসেবে আমাদের অগ্রগতির সঙ্গে হাতে হাত ধরে এগিয়েছে আমাদের সাংবাদিকতা। লেখার সক্ষমতা, প্রকাশ করা, গল্প করা, তথ্য দেওয়া এসব কিছুই আমাদের বিকাশে সাহায্য করেছে।

এই ব্রিটিশ সাংবাদিক উল্লেখ করেন, ‘২০০৪ সালে ভারত মহাসাগরের সুনামির খবর সংগ্রহের সময় আমি এবং ফটোগ্রাফার ব্রায়ান ক্যাসি অন্যান্য জায়গার পাশাপাশি মিয়ানমারেও গিয়েছিলাম। আমরা জানতে পেরেছিলাম কয়েকজন ব্রিটিশ নাগরিক থাই সীমান্তের কাছে তাদের ভিসা নবায়ন করতে গিয়েছিলেন। তারা হয়তো ঢেউয়ের কবলে পড়ে থাকতে পারে বলেও শুনতে পেলাম। নদীর ওপারে যেতে আমরা একটি নৌকা ও একজন অনুবাদক যোগাড় করলাম। কয়েকজন স্থানীয়কেও পেলাম। আপনারা ঢেউ দেখেছেন? কোনও বিদেশিকে দেখেছেন? জানতে চাইলাম আমরা।’

মিয়ানমারের এসব নাগরিকেরা তাদের গ্রাম চেনে আর বড়জোর হয়তো পাশের গ্রামটি। তারা তাদের জাতি, তাদের অঞ্চল, তাদের সরকার এমনকি কাছাকাছি শহর সম্পর্কেও কিছু জানে না। এটা ছিল পিছিয়ে পড়া একটি জনপদ। সেখানে সাংবাদিকতা ছিলো না আর সে কারণে জ্ঞান, যাচাই, গণতন্ত্রসহ অন্য হাজার প্রকারের জিনিস নেই সেখানে।

তবে অনেকের জন্যই সাংবাদিকতা একটা সমস্যা। সন্ত্রাসী, অসদাচরণ করা রাজনীতিবিদ, অপরাধী, ব্যক্তিগত গোপনীয়তা নিয়ে আন্দোলনকারী ও সেলিব্রেটিরা একে সমস্যা বলে অভিযোগ করে থাকেন।

অন্য যেকোনও কাজের চেয়ে সাংবাদিকতাই যে সবচেয়ে বেশি মানুষের প্রাণ বাঁচিয়েছে তা প্রমাণ করার আর কোনো উপায় নেই। ওষুধ, শিক্ষা, স্যানিটেশন ও রাজনীতির পাশাপাশি আমরা আমাদের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছি । এই জন্য আমরা গুরুত্বপূর্ণ কাজের তালিকায় থাকি এবং সে কারণেই আমরাও করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হই।

এই মহামারিতে পত্রিকার কাটতি কমে গেলে লোকসান নিয়েও সংবাদ প্রকাশ করে যাচ্ছে অনেক সংবাদমাধ্যম। এই মহামারি নিয়ে মানুষ জানতে চায় আর মানুষকে জানানোর দায়বদ্ধতা থেকেই আমরা সংবাদ প্রকাশ করে যাচ্ছি। সাংবাদিকদের অবস্থান অনেকটা যুদ্ধে সৈনিকদের খাতের অবস্থানের মতো তাই করোনার বিরুদ্ধে চলমান যুদ্ধে সাংবাদিকদরা সম্মুখভাগে থাকছে।

Comment here