মুদি দোকানি থেকে মানব পাচারকারী - দৈনিক মুক্ত আওয়াজ
My title
সারাদেশ

মুদি দোকানি থেকে মানব পাচারকারী

নিজস্ব প্রতিবেদক : এইচএসসি পাস টুটুল প্রথমে ছিলেন মুদি দোকানদার। ঢাকায় নিয়মিত আসা যাওয়া করতেন তিনি। একপর্যায়ে বেশি লাভের আশায় জড়িয়ে পড়েন মানব পাচার চক্রে। শুরুতে চক্রের দালাল হিসেবে কাজ করতেন টুটুল। পরে নিজেই খোলেন তিনটি ওভারসিজ প্রতিষ্ঠান। তবে ওই তিন প্রতিষ্ঠানের বৈধতা না থাকায় অন্য বৈধ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বেকার ও শিক্ষিত অর্ধশতাধিক নারী-পুরুষকে বিদেশে পাচার করেন তিনি। এভাবে হাতিয়ে নেন কোটি টাকা।

টুটুলের অন্যতম সহযোগী মো. তৈয়ব আলী (৪৫)। চায়ের দোকানদার হলেও পরিচয় দেন স্বনামধন্য এয়ারলাইন্সের ম্যানেজার হিসেবে। টুটুলের মানব পাচার চক্রের সহায়তায় অসংখ্য মানুষকে প্রতারণার মাধ্যমে বিদেশে পাঠানো এবং দেশে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরি দেওয়ার নামে প্রতারণা করে হাতিয়ে নেন লাখ লাখ টাকা।

মুদি দোকানদার থেকে তিন ওভারসিজ মালিক বনে যাওয়া মধ্যপ্রাচ্যে মানব পাচারকারী চক্রের অন্যতম হোতা টুটুল ও সহযোগী তৈয়বসহ আটজনকে গ্রেপ্তারের পর চাঞ্চল্যকর এসব তথ্য জানিয়েছে র‍্যাব-৪।

আজ বুধবার দুপুরে রাজধানীর কাওরানবাজার বাজারে র‍্যাব মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা জানান র‍্যাব-৪ এর অধিনায়ক অতিরিক্ত ডিআইজি মোজাম্মেল হক। তিনি জানান, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে গতকাল মঙ্গলবার রাতে র‌্যাব-৪ এর একটি আভিযানিক দল বাড্ডা থানার লিংক রোডে টুটুল ওভারসিজ, লিমন ওভারসিজ ও লয়াল ওভারসিজে অভিযান চালিয়ে চারজন ভুক্তভোগী (দুজন পুরুষ এবং দুজন নারী), ১০টি পাসপোর্ট, সাতটি ফাইল, চারটি সীল, ১৭টি মোবাইল, পাঁচটি রেজিষ্টার, মোবাইল সীম তিনটি, চারটি ব্যাংকের চেক বহি, দুইটি কম্পিউটার, তিনটি লিফলেট এবং নগদ টাকাসহ মানব পাচারকারী চক্রের অন্যতম হোতা টুটুল ও সহযোগী তৈয়বসহ আটজনকে গ্রেপ্তার করা হয়।

তারা হলেন- মো. সাইফুল ইসলাম ওরফে টুটুল (৩৮), মো. তৈয়ব আলী (৪৫), শাহ্ মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন লিমন (৩৮), মো. মারুফ হাসান (৩৭), মো. জাহাঙ্গীর আলম (৩৮), মো. লালটু ইসলাম (২৮), মো. আলামিন হোসাইন (৩০) ও মো. আব্দল্লাহ আল মামুন (৫৪)।

যেভাবে টুটুল ও তৈয়বের উত্থান

র‍্যাব জানায়, গোপন অনুসন্ধানে দেখা যায়, এইচএসসি পাশ টুটুল মেহেরপুরের গাংনী থানার কামন্দী গ্রামে মুদি দোকানদার হিসেবে কাজ করতেন। অল্পসময়ে বেশি টাকার মালিক হওয়ার লোভে ধীরে ধীরে মানব পাচারকারী কোনো চক্রের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে এবং চক্রের দালাল হিসেবে বিভিন্ন এজেন্সির মাধ্যমে বিদেশে লোক পাঠানোর কাজ করতে থাকেন। পরবর্তীতে নিজেই রাজধানীর বাড্ডা এলাকায় প্রতারণামূলকভাবে টুটুল ওভারসিজ, লিমন ওভারসিজ ও লয়াল ওভারসিজ নামে তিনটি ওভারসিজ এজেন্সির অফিস খুলে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের বেকার ও শিক্ষিত বহু নারী ও পুরুষকে বিদেশে পাঠানোর কথা বলে তাদের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা প্রতারণামূলকভাবে গ্রহণ করেন টুটুল।

টুটুলের এই প্রতারণার কাজে অন্যতম দালাল বা সহযোগী আবু তৈয়ব। ছিলেন চায়ের দোকানি। টুটুলের মানব পাচারকারী চক্রের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে এবং বহু লোককে প্রতারণামূলকভাবে বিদেশে পাঠানো এবং দেশে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরি দেওয়ার নামে প্রতারণামূলকভাবে টাকা পয়সা গ্রহণের অভিযোগ রয়েছে। তৈয়ব দেশের বিভিন্ন বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশনে চাকরি এবং দেশের মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরি দেওয়ার নাম করে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করেছেন। কিছু কিছু ক্ষেত্রে কয়েকজন ভুক্তভোগীকে চাকরি প্রদানের ভুয়া নিয়োগপত্র দিয়েছেন।

মানব পাচার চক্রের অন্যতম সহযোগী শাহ মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন লিমন ও মারুফ হাসান ছিলেন বেতনভুক্ত কর্মচারী। জাহাঙ্গীর আলম, লালটু ইসলাম, আলামিন হোসাইন ও আব্দুল্লাহ আল মামুন টার্গেট সংগ্রহ, প্রার্থীর পাসপোর্টের ব্যবস্থা, কথিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা, টাকা সংগ্রহ, প্রাথমিক মেডিকেল সম্পন্ন করাসহ অন্যান্য কাজে সহায়তা করে আসছিলেন।

যেভাবে মানব পাচার

র‍্যাব জানায়, এই পাচারকারী চক্রের কিছু সদস্য দেশের বেকার ও অস্বচ্ছল যুবক-যুবতীদের সৌদি আরব, জর্ডান ও লেবাননসহ বিভিন্ন দেশে লোভনীয় বেতনে কাজ দেওয়ার নাম করে রাজি করিয়ে ঢাকায় টুটুল ও তৈয়বের কাছে নিয়ে আসে। এরপর টুটুল ও তৈয়ব তাদের বিদেশে কাজের নামে পাঠানোর উদ্দেশ্যে দুই থেকে পাঁচ লাখ টাকা করে নিত।

তারপর প্রতারণার উদ্দেশ্যে এই পাচারকারী চক্রের কয়েকজন সদস্য নিজেদেরকে উচ্চশিক্ষিত বলে পরিচয় দিয়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আগত ভুক্তভোগীকে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের বাসাবাড়িতে কাজের প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা আদায় করতো।

বিক্রির উদ্দেশ্যে বিদেশে পাচার

র‍্যাব জানায়, চক্রের কয়েকজন সদস্য অফিস স্টাফ হিসেবে পরিচয় দিয়ে ভুক্তভোগীকে বিদেশে পাঠানোর জন্য পাসপোর্ট করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সংগ্রহ করতো। এতে তাদের মনে আর কোনো সন্দেহ থাকতো না। পাসপোর্ট অফিসের দালালের সঙ্গেও সখ্য ছিল চক্রের সদস্যদের। কথিত মেডিকেল টেস্ট শেষে নারীদের বাসাবাড়িতে বিক্রি এবং পুরুষদের অমানবিক কাজে নিয়োজিত করার উদ্দেশ্যে সৌদি আরবের জেদ্দা ও রিয়াদ, জর্ডান ও লেবাননে টাকার বিনিময়ে বিক্রি করত তারা। ভুক্তভোগীরা বিদেশে গিয়ে পরিবারের সঙ্গে আর যোগাযোগ করতে পারতো না। যাদের বিদেশে পাঠানো সম্ভব হতো না তারা টাকা ফেরতে যোগাযোগ করলে ভয়ভীতি প্রদর্শন করা হতো।

চক্রের অন্যতম মূলহোতা গ্রেপ্তার তৈয়ব নিজেকে স্বনামধন্য এয়ারলাইন্সের ম্যানেজার হিসেবে পরিচয় দিয়ে শিক্ষিত বেকার তরুণ-তরুণীদের উচ্চ বেতনে লোভনীয় চাকরির কথা বলে যোগাযোগ করে। এরপর নিজ কার্যালয়ে নিয়ে আসতো। বিভিন্ন বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশনে চাকরিসহ আরও কিছু প্রতিষ্ঠানে ভুয়া চাকরির যোগদানপত্র প্রদান করে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করে। বিষয়টি এরই মধ্যে জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছেন তিনি।

যেভাবে গ্রেপ্তার তারা

আশরাফুল ইসলাম নামের এক ভুক্তভোগী অভিযোগ করেন যে, তার ভাতিজি আসমা বেগমকে তৈয়ব ও টুটুলের প্রতারণার শিকার হয়ে গত ৯ জুন ২০২১ সালে জর্ডান যায়। তাকে বাসাবাড়িতে কাজের কথা বলে পাঠানো হলেও সে পাচার হয়েছে বলে তারা আশঙ্কা করেন। যাওয়ার প্রায় এক সপ্তাহ যোগাযোগ থাকলেও এখন আসমার কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। এরকম বেশ কয়েকজন নারী ও পুরুষকে প্রতারণামূলকভাবে সৌদিতে পাঠিয়ে বিক্রি করেছেন মর্মে তিনি জানতে পারেন বলে র‌্যাব-৪ এর কাছে অভিযোগ করেন।

এ ছাড়াও, মোরশেদা বেগম (৩৪), মোছা. হামিদা আক্তার (৩২), মোরশেদা বিবি (৩২) এবং মালেকা বেগম (৫১) একই উপায়ে তৈয়বের কাছে বিদেশে যাওয়ার জন্য পাসপোর্ট সহ অন্যান্য কাগজপত্র জমা দেয়। এর মধ্যে মোরশেদা বেগম (৩৪) ও হামিদা আক্তার (৩২) দুজনকে অভিযানকালে উক্ত কথিত টুটুলের অফিস থেকে উদ্ধার করা হয়। পরে র‌্যাব-৪ এর নিকট প্রতারণার ও পাচারের তথ্য প্রদান করেন।

 

Comment here